Wednesday, January 7, 2015

শরীরের সঙ্গে দগ্ধ স্বপ্নও:কালের কন্ঠ

সম্প্রতি খুদে বিজ্ঞান উৎসব প্রতিযোগিতায় জেলা পর্যায়ে প্রথম হয়েছিল ফেনী সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের এসএসসি পরীক্ষার্থী শাহরিয়ার হৃদয় (১৫) ও তার দুই বন্ধু। রোবট, স্বয়ং
ক্রিয় ট্রেন ইঞ্জিন, বিদ্যুৎ উৎপাদন নিয়ে প্রজেক্ট উপস্থাপন করেছিল তারা। ঢাকায় চূড়ান্ত প্রতিযোগিতায় তারা হয়েছিল চতুর্থ। মা-বাবা, শিক্ষক ও সহপাঠীদের স্বপ্ন ছিল শাহরিয়ার ও তার বন্ধুরা সবার মুখ উজ্জ্বল করবে। কিন্তু হঠাৎ সব এলোমেলো হয়ে গেছে। সোমবার ফেনী সদরের ট্রাংক রোডে শহীদ মিনার চত্বরে আওয়ামী লীগের সমাবেশের পাশে ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনায় ডান চোখে গুরুতর আঘাত লেগেছে শাহরিয়ারের। আগামী মাসেই শুরু হচ্ছে পরীক্ষা, অথচ পড়ার টেবিল বাদ দিয়ে এখন তার ঠাঁই হয়েছে হাসপাতালে। সে আগের মতো চোখে দেখতে পারবে কি না, তা-ও অনিশ্চিত। ঘটনার সময় হৃদয়ের সঙ্গে ছিল তার বন্ধু মিনহাজুল ইসলাম অনিক (১৫)। বোমার আঘাতে তার মুখ, নাক ও কপালের উপরের অংশ মারাত্মক জখম হয়েছে। হৃদয় ও অনিক পরীক্ষা দিতে পারবে কি না, তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের চিকিৎসাধীন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র তানজিমুল হক অয়ন ও তাঁর মা শামসুন্নাহারের অবস্থা এখনো আশঙ্কাজনক। ২৯ ডিসেম্বর বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের ডাকা হরতালের আগের সন্ধ্যায় রাজধানীর কাজীপাড়ায় সিএনজি অটোরিকশায় দুর্বৃত্তদের ছোড়া পেট্রলবোমায় দগ্ধ হন তাঁরা। শাহরিয়ার, অনিক ও অয়নের মতোই হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে কাতরাচ্ছেন বগুড়ার ট্রাকচালক পটল প্রামাণিক (৪৫)। যন্ত্রণাকাতর কণ্ঠে আর্তনাদ করছেন, 'ইংকে করে বাঁচে থাকার কুনু মানে হয় না। কুনু হরতাল-অবরোধ নাই, তাও ক্যা হামার গাড়িত বোমা মারলো তারা। এ্যার বিচার হামি কুটি পামো। হামার ছোট ব্যাটা-বেটিকেরে কী গতি হবি এ্যাকন?' পটল প্রমাণিকের এ অবস্থা হয়েছে গত রবিবার রাতে। ঢাকা-বগুড়া মহাসড়কে বগুড়া শহরতলির বারপুর মোড়ে দুর্বৃত্তদের ছোড়া পেট্রলবোমায় দুই হাত, পা, মুখসহ তার শরীরের বেশির ভাগ অংশ ঝলসে গেছে। ময়মনসিংহ সদরে ইজিবাইক চালান সিদ্দিকুর রহমান (৩৫)। গত সোমবার সন্ধ্যায় জিলা স্কুল মোড়ে ২০ দলীয় জোটের বিক্ষোভ চলাকালে পেট্রলবোমা বিস্ফোরণে মারাত্মক দগ্ধ হয়েছেন তিনি। তাঁরও ঠাঁই হয়েছে ঢামেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে। 'আমি কি পরীক্ষা দিতে পারব না?' : আহত হওয়ার পর শাহরিয়ারকে প্রথমে নিয়ে যাওয়া হয় ফেনী সদরের প্রাইম চক্ষু হাসপাতালে। অবস্থার অবনতি হওয়ায় সেখানে থেকে সোমবার রাতেই তাকে নিয়ে যাওয়া হয় চট্টগ্রাম মহানগরের পাহাড়তলী চক্ষু হাসপাতালে। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে তার চোখে অস্ত্রোপচার হয়েছে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, আঘাত গুরুতর। ডান চোখে কর্নিয়া ও রেটিনায় গুরুতর আঘাত লেগেছে। সে আগের মতো আর দেখতে পারবে কি না, তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। কাল (আজ) চোখের ব্যান্ডেজ খোলা হবে। গতকাল অস্ত্রোপচারের পর শাহরিয়ার কালের কণ্ঠকে বলে, 'আমি কোনো রাজনীতি করি না। সোমবার বিকেল পৌনে ৩টায় প্রাইভেট পড়তে বাসা থেকে বের হই। মাস্টারপাড়ায় প্রাইভেট পড়া শেষে আমি ও অনিক হেঁটে ট্রাংক রোডের সামনে এসে রিকশা নিই। খেজুর চত্বরে রিকশাতে ওঠার সময় বোমার শব্দ পাই। হঠাৎ দেখি ডান চোখ থেকে রক্ত ঝরছে। একপর্যায়ে রিকশা থেকে পড়ে যাই। পরে স্থানীয় একজন আমাকে প্রাইম চক্ষু হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখান থেকে অ্যাম্বুল্যান্সে করে মা-বাবা আমাকে পাহাড়তলীতে নিয়ে আসেন।' করুণ কণ্ঠে শাহরিয়ার আকুতি করে, 'আমি কি পরীক্ষা দিতে পারব না? আমি তো কোনো অপরাধ করিনি। এখন আমার কী হবে? আমি কি চোখে দেখব না?' শাহরিয়ারের বাবা কুয়েতপ্রবাসী আবুল খায়ের। তিনি বলেন, 'তিন ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার জন্য গ্রাম থেকে ফেনী সদরে এসে বাসা ভাড়া করে বসবাস করছি। আমার পরিবারের কেউ রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নয়। রাজনৈতিক দলগুলোর কারণে আমার নিরপরাধ ছেলের এ অবস্থা হয়েছে। চিকিৎসকরা বলছেন, সে ডান চোখে আর দেখতে পারবে না। যাদের বোমার আঘাতে আমার মেধাবী ছেলেকে চোখ হারাতে হচ্ছে তাদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার দাবি করছি।' 'আমার ছেলে কি পরীক্ষা দিতে পারবে?' : ঢামেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের নিচতলায় ১০৩ নম্বর ওয়ার্ডের বিছানায় শুয়ে কাতরাচ্ছে অনিক। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, বোমা ও দাহ্য পদার্থে অনিকের মুখ, কপাল ও নাকের ওপরের অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তার অবস্থা আশঙ্কাজনক। গতকাল বার্ন ইউনিটে গিয়ে দেখা যায়, অনিকের পাশে বসে অঝরে কাঁদছেন তার মা জেসমিন রহমান। ধরা গলায় বললেন, 'আমার ছেলে কি পরীক্ষা দিতে পারবে? কী দেশে বসবাস করি আমরা, আমাদের নিরাপত্তা কোথায়?' অনিকের বাবা মিজানুর রহমান ওমানপ্রবাসী। তাঁদের গ্রামের বাড়ি ফেনীর দাগনভূঞা উপজেলার উত্তর জয়লস্কর গ্রামে। সন্তানের লেখাপড়ার জন্যই ফেনী শহরের হাড্ডাবাড়ী এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে থাকেন অনিকের মা। ছেলের আহত হওয়ার বিষয়ে জেসমিন রহমান বলেন, সোমবার বিকেলে ফেনী সদরের মাস্টারপাড়ায় প্রাইভেট পড়তে যায় অনিক ও শাহরিয়ার। পড়া শেষে বিকেলে বাসায় ফিরছিল তারা। পথে ডাক্তারপাড়া এলাকায় আওয়ামী লীগের সমাবেশ চালাকালে হামলার ঘটনায় অনিক ও শাহরিয়ার আক্রান্ত হয়। স্থানীয়রা তাদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নেয়। সেখান থেকে সোমবার রাতেই অনিককে ঢাকায় আনা হয়। আমাদের ফেনী প্রতিনিধি জানান, শাহরিয়ার ও অনিকের ওপর বোমা হামলাকারীদের দ্রুত গ্রেপ্তারের দাবিতে গতকাল দুপুরে ফেনী পাইলট হাই স্কুলের সামনে মানববন্ধন করেছে স্কুলের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। এতে সংহতি জানিয়ে বক্তব্য দেন ফেনী-২ (সদর) আসনের এমপি নিজাম উদ্দিন হাজারী, সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান, পরশুরাম উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কামাল মজুমদার, ফেনী পৌর মেয়র হাজী আলাউদ্দিন, স্কুলের প্রধান শিক্ষক হোসনে আরা প্রমুখ। অয়ন ও তাঁর মা এখনো শঙ্কায় : ২০ দলীয় জোটের সর্বশেষ হরতালের আগের দিন ২৮ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় বোমায় দগ্ধ হন অয়ন এবং তাঁর মা শামসুন্নাহার। ঢামেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের চিকিৎসক পার্থ শংকর পাল বলেন, 'আগুনে তাঁদের শ্বাসনালি ক্ষতি হয়েছে। আর এ কারণেই ঝুঁকির মধ্যে আছেন তাঁরা।' 'কার কাচে অ্যার বিচার চামো' : পটল প্রামাণিক এখন চিকিৎসাধীন বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজ (শজিমেক) হাসপাতালে। তাঁর বাড়ি বগুড়া সদর উপজেলার শেখেরকোলা ইউনিয়নের মহিষবাথান সরকারপাড়ায়। তাঁর আয়েই স্ত্রী, তিন মেয়ে ও এক ছেলেকে নিয়ে গড়া সংসার চলে। চিকিৎসাধীন পটল প্রামাণিক জানান, রবিবার জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার ইটাখোলা হাট থেকে ঢাকার কয়েকজন ব্যাপারী আলু কেনেন। সেই আলু ঢাকার কারওয়ান বাজারে পৌঁছে দিতে রবিবার সন্ধ্যার পর ট্রাক ছাড়েন তিনি। বারপুর মোড় পার হওয়ার সময় ১৫ থেকে ২০ যুবককে মহাসড়কের ওপর দৌড়াতে দেখেন। হঠাৎ তারা রংপুরগামী একটি ট্রাক লক্ষ্য করে কিছু একটা ছুড়ে মারে। সঙ্গে সঙ্গে ট্রাকটিতে আগুন ধরে যায়। তিনি ঘাবড়ে গিয়ে নিজের ট্রাকের গতি কমিয়ে দেন। হঠাৎ তিন দিক থেকে ওই যুবকরা তাঁর ট্রাক ঘিরে ধরে তিনটি পেট্রলবোমা ছোড়ে। বোমাগুলো ট্রাকের সামনে এবং পাশের কাচ ভেঙে ভেতরে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আগুন ধরে যায়। তিনিও লাফিয়ে নিচে নামেন। কিন্তু ততক্ষণে তাঁর শরীরে আগুন ধরে যায়। আগুনে শরীরের নিম্নাংশ, হাত ও মুখ ঝলসে যায়। এরপর তিনি জ্ঞান হারান। হাসপাতালে পটল প্রামাণিকের সঙ্গে ছিলেন তাঁর স্ত্রী তুহিন বেগম। তিনি বলেন, 'গোটাল গাও পুড়ে কয়লার লাকান কালো হয়্যা গ্যাচে। হামরা গরিব মানুষ, হরতাল হলে সেই দিন এমনিতেই বাড়িত থ্যাকে বাড়াবেন দেইনে। আর কুনু হরতাল না ডাকেই ইংকে করে একটা মানুষোক বোমা মারল ক্যা। হামরা কার কাচে অ্যার বিচার চামো।' পটল বলেন, 'ডাক্তার কচ্চে ম্যালা দিন চিকিসসে করান লাগবি। এত দিন বাড়ির লোকজনের প্যাট চলবি কী করে?' শজিমেক হাসপাতালের সহকারী রেজিস্ট্রার ডা. শফিক আমিন কাজল জানান, পটলের শরীরের প্রায় ২৫ শতাংশ পুড়ে গেছে। জীবন সংশয় না থাকলেও ক্ষত সারতে সময় লাগবে। 'ভাইয়ের অবস্থা ভালো না' : ইজিবাইক চালক সিদ্দিকুরের বাড়ি ময়মনসিংহ শহরের কাশর এলাকায়। বোমার আগুনে দগ্ধ হওয়ার পর প্রথমে তাঁকে নেওয়া হয়েছিল ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। অবস্থার অবনতি হওয়ায় সোমবার রাতেই তাঁকে ঢামেকে স্থানান্তর করা হয়। ধার করে তাঁকে ঢাকায় এনেছেন পরিবারের সদস্যরা। পুলিশ ও স্থানীয়রা জানায়, সোমবার বিকেলে ময়মনসিংহ সদরের হরিকিশোর রায় রোডের বিএনপি কার্যালয়ের সামনে মিছিল ও সমাবেশ করেন ২০ দলীয় জোটের নেতা-কর্মীরা। সমাবেশ শেষে সন্ধ্যার পর চলে যাওয়ার সময় জিলা স্কুল মোড়ের কাছে কয়েকটি অটোরিকশা ভাঙচুর করেন তাঁরা। এরপর সেখানে পেট্রলবোমার বিস্ফোরণ ঘটে। বোমার আগুনে মারাত্মকভাবে দগ্ধ হন সিদ্দিকুর। গতকাল দুপুরে সিদ্দিকুরের বাড়ি গেলে তাঁর মা ফিরোজা বেগম জানান, বড় ছেলে সিদ্দিকুরের আয় দিয়েই যৌথ পরিবারের বেশির ভাগ খরচ চলে। প্রায় এক বছর আগে দুটি গরু বিক্রি করে সিদ্দিকুর ইজি বাইকটি কিনেছে, নিজেই চালাত। সোমবার দুপুরে সিদ্দিকুর বাসা থেকে বের হয়। সন্ধ্যার পর পরিবার তাঁর দগ্ধ হওয়ার খবর পায়। ফিরোজা বেগম বলেন, 'আমরা গরিব মানুষ। আশপাশের লোকজনের কাছ থাইক্যা ধার নিয়া ৪০ হাজার টেহার মতো তুলি। হেই টেহা লইয়াই হেরা ঢাকা গেছে।' গতকাল দুপুরে মোবাইল ফোনে কথা হয় সিদ্দিকুরের ভাই আবদুল মালেকের সঙ্গে। ঢাকা থেকে তিনি বলেন, 'ভাইয়ের (সিদ্দিকুর) অবস্থা ভালো না।'    

No comments:

Post a Comment