Monday, January 19, 2015

অসুখ হলেই বিপদ:কালের কন্ঠ

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তানজিমুল হক তাঁর অসুস্থ মা শামসুন্নাহার বেগমকে চিকিৎসার জন্য হাতিয়া থেকে নিয়ে এসেছিলেন ঢাকায়। শান্তিনগরের পপুলার হাসপাতালে ডাক্তার দেখিয়ে ফিরছিলেন মিরপুর ৭ নম্বরে মামার বাসায়। সঙ্গে ছোট বোন হাতিয়া কলেজের উচ্চ মাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী আনিকাও ছিলেন। তাঁদের বহনকারী সিএনজি অটোরিকশাটি কাজিপাড়ায় পৌঁছতেই ছুটে আসে পেট্রলবোমা। জ্বলে ওঠে অটোরিকশাটি। অগ্নিদগ্ধ হন মা,
মেয়ে ও ছেলে। স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় তাঁদের ভর্তি করা হয় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে। গত ২৯ ডিসেম্বর বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের আহ্বানে হরতালের আগের দিন সন্ধ্যাবেলার ওই ঘটনার পর হাসপাতালের বেডে শুয়ে তানজিমুল বলেন, 'চিকিৎসার জন্য এসেও নিরাপত্তা নেই। ডাক্তার দেখাতে গিয়ে রাজনীতির আগুনে পুড়তে হলো!' ৫ জানুয়ারি বিএনপি চেয়ারপারসন অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করতে না করতেই ওই দিন সন্ধ্যায় রাজধানীর মহাখালী এলাকায় পেট্রলবোমার আগুনে পুড়ে যায় একটি অ্যাম্বুল্যান্স। ৭ জানুয়ারি ঢাকা-বগুড়া মহাসড়কে জ্বালিয়ে দেওয়া হয় জরুরি ওষুধ সরবরাহকারী একটি ওষুধবাহী কাভার্ড ভ্যান। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের ডাকা অবরোধ ও হরতালে এমন সব ঘটনার জের ধরে রীতিমতো অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে দেশের চিকিৎসাসেবা ও ওষুধ সরবরাহ পরিস্থিতি। জরুরি চিকিৎসাসেবা, রোগী বহনকারী ও ওষুধ সরবরাহকারী পরিবহন হরতাল-অবরোধের বাইরে থাকার কথা থাকলেও এর তোয়াক্কা করছে না অবরোধকারীরা। ফলে আতঙ্কে জরুরি চিকিৎসার জন্যও মানুষ ঘর থেকে বেরিয়ে হাসপাতাল কিংবা ডাক্তারের কাছে যাওয়ার সাহস পাচ্ছে না। ঢাকার বাইরে থেকে চিকিৎসা নিয়ে ডাক্তারের পরামর্শ মতো আর ঢাকায় আসতে পারছে না অনেকেই। রোগী নিয়ে ঢাকায় আসা-যাওয়া করতে চায় না অ্যাম্বুল্যান্স বা অন্য সব পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা। এর প্রভাবে ঢাকার বেশির ভাগ হাসপাতালেই অনেকটাই ফাঁকা ফাঁকা অবস্থা। অন্যদিকে ভাঙচুর বা অগ্নিসংযোগের ভয়ে ঢাকা থেকে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ওষুধ সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে ওষুধ কম্পানিগুলো। ফলে বিভিন্ন এলাকায় দেখা দিয়েছে ওষুধ সংকট ও মূল্যবৃদ্ধি। এ ছাড়া পথে চোরাগোপ্তা হামলার কারণে চিকিৎসাকর্মীদেরও কর্মস্থলে আসা-যাওয়ার ক্ষেত্রে ভীতির সঞ্চার হয়েছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চিকিৎসাসেবা জরুরি বিষয়। মানুষের বাঁচা-মরার ব্যাপার। যেকোনো আন্দোলনেই সব সময় চিকিৎসাসেবা সুরক্ষিত থাকার কথা। কিন্তু গত বছর ৫ জানুয়ারির আগে এবং এবার চলমান আন্দোলনে এর ব্যত্যয় দেখা যাচ্ছে। যেভাবে প্রতিদিন পথে পথে পেট্রলবোমার শিকার হয়ে মানুষ পুড়তে দেখা যাচ্ছে তাতে রোগীরাও চিকিৎসার জন্য যানবাহনে উঠে চিকিৎসাকেন্দ্রে যাওয়ার ভরসা পাচ্ছে না। ফলে চিকিৎসাও একরকম অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে। গতকাল রবিবার সকাল ১০টায় রাজধানীর শেরে বাংলানগর এলাকার ন্যাশনাল ইউরোলজি অ্যান্ড কিডনি ইনস্টিটিউট হাসপাতালের প্রবেশপথে দাঁড়িয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে বারবার ফোনে কথা বলছিলেন এক ব্যক্তি। জানতে চাইলে একটি বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত রিয়াজুল ইসলাম নামের ওই ব্যক্তি কালের কণ্ঠকে বলেন, 'ছোট বোনটার দুটি কিডনিই নষ্ট, ডায়ালিসিস দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা হচ্ছে। প্রতি সপ্তাহে ডায়ালিসিস করাতে হয়। গত ১ জানুয়ারি ডায়ালিসিস করিয়ে দুই দিন পর গ্রামের বাড়ি যশোরে পাঠিয়ে দিয়েছি, যাতে কয়েকটা দিন মা-বাবার সঙ্গে কাটাতে পারে। ওকে আবার ৭ জানুয়ারি ঢাকায় নিয়ে আসব ঠিক করেছিলাম। অবরোধ শুরু হওয়ায় পথে গাড়িতে হামলা, ভাঙচুর, আগুনের শিকার হওয়ার ভয়ে মা-বাবা ওকে ঢাকায় পাঠানোর সাহস পাচ্ছেন না। এদিকে হাসপাতালের নিয়মিত শিডিউলও বাতিল হয়ে গেল। এর মধ্যে দুই সপ্তাহ চলে গেছে। তাই এখানে এসে ডাক্তারদের সঙ্গে আলাপ করলাম। কিন্তু ডাক্তাররা জানিয়েছেন, পরপর দুই সপ্তাহ ডায়ালিসিস বাদ গেলে রোগীর অবস্থার মারাত্মক অবনতি ঘটতে পারে। এখন বোনটাকে নিয়ে খুবই দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছি। কবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে আর কবে তাকে নিয়ে এসে ডায়ালিসিস করাতে পারব তা বুঝতে পারছি না।' ন্যাশনাল ইউরোলজি অ্যান্ড কিডনি ইনস্টিটিউট হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. জামানুল ইসলাম ভূইয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, 'কোনো রোগী শিডিউল অনুসারে না আসতে পারলে বা ডায়ালিসিস না করা গেলে স্বাভাবিকভাবেই তার জীবন ঝুঁকির মুখে পড়ে যায়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে অবরোধ-হরতালে অনেক রোগীই শিডিউল ঠিক রাখতে পারছে না।' জাতীয় স্বাস্থ্য আন্দোলনের সভাপতি ও বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ ই মাহাবুব কালের কণ্ঠকে বলেন, হরতাল-অবরোধ আহ্বানকারী দলগুলোর মানুষের চিকিৎসার দিকটি ভালোভাবে দেখা দরকার। কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচিই যাতে চিকিৎসা ও ওষুধ সরবরাহ বাধাগ্রস্ত করতে না পারে সে রকম পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। সরকারের দিক থেকেও উচিত জরুরি সেবা বাধাহীন করার জন্য উপযুক্ত পদক্ষেপ নেওয়া। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. আবদুল মজিদ ভূইয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এ হাসপাতালের আউটডোরে ঢাকার ভেতরের রোগী খুব একটা না কমলেও ঢাকার বাইরের রোগীর উপস্থিতি কম বলে মনে হচ্ছে।' তিনি বলেন, 'হরতাল-অবরোধে রোগীদের জীবন ঝুঁকির মুখে পড়ছে। অনেক রোগী জরুরি চিকিৎসা নিতে পারছে না। আবার অনেকে নানা দুর্ভোগ পোহায়ে এলেও তাদের অবস্থা তখন একেবারেই সংকটাপন্ন হয়ে পড়ছে। বিশেষ করে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ, হৃদরোগ, কিডনি রোগ বা ক্যান্সারে আক্রান্তের মতো রোগীরা সময়মতো প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নিতে না পারলে তাদের বাঁচিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। তবে চিকিৎসার প্রয়োজনে অনেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়েও হাসপাতালে আসার চেষ্টা করেন।' গতকাল রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল, ঢাকা মেডিক্যাল, মহাখালী বক্ষব্যাধি হাসপাতাল, শিশু হাসপাতাল, ন্যাশনাল ইউরোলজি অ্যান্ড কিডনি ইনস্টিটিউট, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালসহ আশপাশের আরো কয়েকটি হাসপাতালে রোগীর উপস্থিতি ছিল অন্য দিনের চেয়ে অনেক কম। বহির্বিভাগ ও ভর্তি রোগীর উপস্থিতিও কম দেখা যায়। সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. এ কে এম মজিবুর রহমান বলেন, 'আমাদের এ হাসপাতালে স্বাভাবিক সময়ে আউটডোরে প্রতিদিন প্রায় দুই হাজার রোগী হয়। কিন্তু অবরোধ-হরতালের ফলে এ সংখ্যা দিনে অর্ধেকের নিচে নেমে এসেছে। এ ছাড়া ইনডোরেও রোগী অনেক কমে যায়। কারণ সেখানকার বেশির ভাগ রোগী আসে ঢাকার বাইরে থেকে।' ইনডোরে ভর্তি থাকা রোগীর জন্য আরেক সমস্যার কথা জানান পরিচালক। তিনি বলেন, 'আগে থেকে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে ওঠা কেউ কেউ এই পরিস্থিতির মধ্যে বাড়ি ফিরতে পারছে না পথে কোনো সমস্যা হওয়ার আশঙ্কায়। ফলে এসব রোগী তাদের রিলিজ না করার অনুরোধ জানায়। বিশেষ করে যাদের ঢাকায় কোনো থাকার জায়গা বা আত্মীয়স্বজন নেই তাদের অবস্থা বিবেচনা করে এমন কাউকে কাউকে আমরা মানবিক কারণে ছাড়তেও পারছি না।' কেবল সরকারি বা বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসাসেবাই বাধাগ্রস্ত হচ্ছে না, বিঘ্ন ঘটছে প্রাইভেট প্রাকটিশনার ডাক্তারদের চিকিৎসাসেবায়ও। ঢাকার একটি প্রাইভেট হাসপাতালে নিয়মিত বসেন, দেশের এমন একজন খ্যাতিমান চিকিৎসক বলেন, 'স্বাভাবিক সময়ে রোগীর ভিড় সামলাতে পারি না। চিকিৎসাপ্রার্থী রোগীদের সিরিয়াল নিতে হয় অনেক আগে থেকে। গত কয়েক দিনে ওই সিরিয়ালে নাম থাকা অনেকেই অবরোধের কারণে আসতে পারেনি। আবার কবে তারা সিরিয়াল পাবে তাও নিশ্চিত নয়।' খ্যাতিমান মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'সব জায়গায়ই চিকিৎসাপ্রার্থীর ভিড় কম নাশকতায় পড়ার ভয়ে। এটার বিরূপ প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিকভাবেই রোগীর শরীর ও মনের ওপর পড়ছে। রোগের জটিলতা বেড়ে যাচ্ছে। আন্দোলনের ক্ষেত্রে চিকিৎসাসেবাকে মুক্ত রাখা উচিত।' ঢাকার বাইরেও বিপর্যয় : ঢাকার বাইরেও অবরোধ-হরতালে স্থানীয় পর্যায়ের চিকিৎসাসেবা থেকে প্রতিদিন বঞ্চিত হচ্ছে অনেক রোগী। অনেকেই যেমন ঢাকায় আসতে পারছে না, তেমনি উপজেলা থেকে জেলা পর্যায়ে কিংবা জেলা থেকে বিভাগীয় শহরে যাওয়া-আসা করতে পারছে না। এ ছাড়া প্রয়োজনীয় জরুরি সব ওষুধও পাওয়া যাচ্ছে না ঢাকার বাইরের বিভিন্ন এলাকায়। চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. খোন্দকার শহিদুল গণি কালের কণ্ঠকে বলেন, 'অবরোধের কারণে এ হাসপাতালে ১০০ থেকে ১৫০ জন রোগী ভর্তি কমেছে। মনে হচ্ছে রোগীরা দূর-দূরান্ত থেকে আসতে পারছে না।' চট্টগ্রামের কিছু রোগী ও তাদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, টানা অবরোধের কারণে গণপরিবহন কম চলাচল করায় রোগীদের দুর্ভোগ বেড়ে গেছে। জরুরি চিকিৎসাসেবা নিতে বিভিন্ন হালকা যানবাহনে করে যেসব রোগী হাসপাতালে আসছে, তাদের অবর্ণনীয় দুর্ভোগের শিকার হতে হচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চট্টগ্রাম মহানগর ও জেলার অন্য সরকারি ও বেসরকারি অর্ধশতাধিক হাসপাতাল ও ক্লিনিকেও অবরোধের কারণে রোগী আসতে পারছে না। চিকিৎসাকেন্দ্রগুলোর পাশাপাশি চিকিৎসকের ব্যক্তিগত চেম্বারেও রোগী কমেছে। বরিশাল শেরে বাংলা মেডিক্যালের জরুরি বিভাগের দায়িত্বে থাকা আবদুল হালিম বলেন, অবরোধের কারণে এখন দিনে গড়ে ৪০ জন করে রোগী ভর্তি হচ্ছে। সাধারণত দুর্ঘটনায় আহত বা জরুরি চিকিৎসার রোগী ছাড়া অন্য রোগীরা তেমন একটা আসছে না। যশোর শহরের ষষ্ঠীতলাপাড়ার কলেজছাত্র জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, 'আমার বাবার অ্যাজমার জরুরি উপশমের জন্য ইনহেলার বিভিন্ন দোকানে খুঁজেও পাচ্ছি না।' জানতে চাইলে শহরের এম এম আলী রোডের ফ্রেন্ডস মেডিক্যালের স্বত্বাধিকারী মনিরুজ্জামান মুকুল বলেন, 'হরতাল-অবরোধের কারণে বেশ কিছু জরুরি ওষুধের সংকট সৃষ্টি হয়েছে। বিভিন্ন ওষুধ কম্পানি ওষুধ সরবরাহ করতে পারছে না। শীতের কারণে এখানে এখন বেশি ইনহেলার দরকার ছিল, উল্টো সরবরাহের অভাবে এখন সংকট সৃষ্টি হয়েছে।' ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সেখানেও অন্য সময়ের তুলনায় ওয়ার্ডগুলোতে রোগী ভর্তি কমেছে। আউটডোরেও রোগীর সংখ্যা কম। হাসপাতালের একজন কর্মকর্তা বলেন, আউটডোরে আগের তুলনায় চার ভাগের এক ভাগ রোগী কমে গেছে। (প্রতিবেদনটির জন্য তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন চট্টগ্রাম, বরিশাল, রাজশাহী, যশোর ও ময়মনসিংহ কার্যালয়ে কর্মরত কালের কণ্ঠের নিজস্ব প্রতিবেদকরা)।

No comments:

Post a Comment