Wednesday, January 14, 2015

মামলার আলামতের স্তূপ যেন ময়লার ভাগাড়!:প্রথম অালো

প্রথম দেখায় মনে হবে ময়লার ভাগাড়। খোলা জায়গায় ধুলার পুরু আস্তরণ নিয়ে ও মরচে ধরা অবয়ব পড়ে আছে। এগুলো গাড়ি, মোটরসাইকেল, রিকশা, রিকশাভ্যানসহ বিভিন্ন যানবাহনের। এসবই বিচারাধীন বিভিন্ন মামলার গুরুত্বপূর্ণ আলামত। মামলার দীর্ঘসূত্রতায় বছরের পর বছর পড়ে থেকে সঠিক সংরক্ষণের অভাবে এমন হাল এসব যানের। পুরান ঢাকার রায়সাহেব বাজারে অবস্থিত ঢাকা জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের সামনের খোলা জায়গায় দেখা যায় এ দৃশ্য।
মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ায় এসব আলামত ধ্বংস বা কোনো গতি করা যাচ্ছে না। এ নিয়ে বিপাকে পড়েছে সংশ্লিষ্ট দপ্তর। এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর আদালতের সরকারি কৌঁসুলি আবদুল্লাহ আবু বলেন, অনেক ক্ষেত্রে মামলা নিষ্পত্তি হওয়ার পরও পুলিশ আলামত ধ্বংস করে না। আলামত ধ্বংস করলে মালখানায় এত আলামত জমে থাকত না। অবশ্য পুলিশের অপরাধ তথ্য ও প্রসিকিউশন বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার আনিসুর রহমান বলেছেন, মামলা প্রমাণের জন্য আলামত একটি উপাদান। জায়গার অভাবে সঠিকভাবে সংরক্ষণ করতে পারছেন না। মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ায় তাঁরা আলামত ধ্বংসও করতে পারছেন না। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পুলিশ মামলায় জব্দ করা জিনিস আলামত হিসেবে দাখিল করে। এসব আলামত পাঠানো হয় আদালতের মালখানায়। রায় না হওয়া পর্যন্ত আলামত মালখানায় থাকে। ঢাকার আদালতের মালখানা দুটি। একটি জেলা মালখানা, অন্যটি মহানগর মালখানা। মহানগর মালখানা পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর ও দক্ষিণ—এই চার ভাগে বিভক্ত। জেলা মালখানা ঢাকার কালেক্টরেট ভবনের নিচতলায় এবং মহানগর মালখানা মুখ্য মহানগর হাকিম (সিএমএম) আদালতের ভূতলে। টাকা, অস্ত্র ও ছোট অন্যান্য আলামত মালখানার ভেতরেই রাখা হয়। এই দুই মালখানায় জায়গা না থাকায় যানবাহনের মতো আলামত রাখা হচ্ছে বাইরের খোলা চত্বরে। বাইরে আলামত জমতে জমতে পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের সামনে থেকে শুরু করে বিচারিক হাকিম আদালতের সামনের চত্বর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। সেখানে গুরুত্বপূর্ণ মামলাগুলোর শত শত আলামত রয়েছে ছড়িয়ে–ছিিটয়ে। রোদ-বৃষ্টিতে নষ্ট হচ্ছে কোটি কোটি টাকা মূল্যের এসব আলামত। আইনজীবীরা বলছেন, আলামত নষ্ট হওয়ায় সুবিধা পাচ্ছে অপরাধীরা। সরেজমিনে দেখা যায়, পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের সামনে স্তূপাকারে ও ধুলায় ডুবে থাকা যানগুলো দেখে চেনার উপায় নেই। অযত্ন-অবহেলায় আলামতের এমন চেহারা হয়েছে যে তা শনাক্ত করতে পুলিশকেও গলদঘর্ম হতে হয়। সংরক্ষণের সঠিক ব্যবস্থা না থাকায় যানগুলোর ভেতরের অধিকাংশ যন্ত্রপাতি খোয়া গেছে। মালখানা কর্তৃপক্ষের দেওয়া নম্বরও মুছে গেছে অনেক আলামত থেকে। অনেক আলামতের ওপর আগাছা জন্মেছে। আলামত হিসেবে থাকা যানকে চা-পানের স্থান হিসেবেও ব্যবহার করতে দেখা গেল। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, অধিকাংশ মামলার ক্ষেত্রে সাক্ষীরা দিনের পর দিন অনুপস্থিত থাকায় মামলার নিষ্পত্তি হচ্ছে না। এভাবে কাটছে বছরের পর বছর। মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ায় আদালত আলামতের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারছেন না। আবার অনেক ক্ষেত্রে যানবাহনের মালিকেরা আলামত নিজ জিম্মায় নিতে চাইলেও বিভিন্ন কাগজপত্র, প্রমাণের অভাব ও আইনি জটিলতায় তা হয় না। মহানগর আদালতের মালখানার দায়িত্বরত পুলিশ কনস্টেবল ইসমাইল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, বছরের পর বছর যায়, মামলার নিষ্পত্তি হয় না। আবার নতুন আলামত আসে। এভাবে আলামত জমতে থাকে। খোলা জায়গায় রোদ-বৃষ্টি-ঝড়ে নষ্ট হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ আলামত। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে আলামতের স্তূপের কাছে আগাছা গজানো একটি চেসিস দেখা গেল। বোঝার উপায় নেই এটি গাড়ি, বাস, না মিনি ট্রাক। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, ডাকাতির কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে সন্দেহে কাফরুল থানার পুলিশ ২০০২ সালের ৫ অক্টোবর একটি প্রাইভেট কার আটক করে। ওই ঘটনায় ডাকাতির মামলা করে পুলিশ। আটক গাড়িটি মামলার আলামত হিসেবে পাঠানো হয় মালখানায়। ওই গাড়ির দাবিদার না থাকায় গাড়িটি সেখানে পড়ে আছে। সবকিছু চুরি যাওয়ার পর এখন কেবল চেসিস রয়ে গেছে। পাশেই থাকা আরেকটি গাড়ির কেবল খোল (বডি) রয়েছে, ভেতরে কোনো যন্ত্র নেই। এটি মাদকদ্রব্য বহন করায় তেজগাঁও থানার পুলিশ আটক করেছিল একই বছরের ১১ নভেম্বর। এ দুই মামলায় আসামিদের পলাতক দেখিয়ে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। দুটি মামলাই ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৩-এ বিচারাধীন। সাক্ষী না আসায় তারিখের পর তারিখ পড়ছে, মামলা নিষ্পত্তি হচ্ছে না। এ বিষয়ে আবদুল্লাহ আবু বলেন, সাক্ষী না আসায় কিছু কিছু মামলা শেষ হচ্ছে না। এ জন্য মালখানায় অনেক আলামত জমে রয়েছে। পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার আনিসুর রহমান বলেন, মামলা নিষ্পত্তির আদেশের আলোকে প্রতিনিয়ত আলামত ধ্বংস করা হচ্ছে। আদালতের আদেশ ছাড়া কোনো আলামত ধ্বংস করা সম্ভব নয়। অস্ত্র, মাদক, চুরিসহ কয়েক হাজার মামলার আলামত রয়েছে। আলামত সংরক্ষণের জন্য জায়গা বরাদ্দের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। তিনি বলেন, ২০১৩ সালের ৬৭০টি ও গত বছরের ৫৬০টির মতো মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। আদালতের আদেশ পাওয়ার পরপরই এসব মামলার আলামত ধ্বংস করা হয়েছে।

No comments:

Post a Comment