Wednesday, January 14, 2015

কোচিংবাজ শিক্ষকেরা আবারো বেপরোয়া:নয়াদিগন্ত

শিক্ষকদের কোচিংবাণিজ্য আবারো চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। নতুন শিক্ষা বর্ষের শুরুতেই কোচিংয়ে নেমে পড়েছেন তারা। স্কুলে কাসের সাথে পাল্লা দিয়েই চলছে এসব কোচিং। শিক্ষার্থী আকষর্ণে কোচিংবাজ শিক্ষকেরাও নানা ফাঁদ পেতে বসেছেন। এর বাইরে স্কুল কোচিংও থেমে নেই। রাজধানীর সব ক’টি স্কুলেই পঞ্চম ও অষ্টম এবং নবম-দশম শ্রেণীর সব শিক্ষার্থীর কোচিং বাধ্যতামূলক করেছে স্কুল কর্তৃপক্ষ। এর জন্য বাড়তি ফিও দিতে হয়েছে নতুন বছরে নতুন
কাসে ভর্তির সময়েই।   গত কয়েক দিনে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় নামীদামি স্কুলের শিক্ষার্থীদের সাথে আলাপ করে জানা গেছে, নতুন বছরের শুরুতেই তারা ‘ অন্য স্কুলের ভালো টিচার’-র কোচিং কাসে যোগ দিয়েছেন। ওই স্যার নিজ বাসভবনে বা কোনো বাড়ির ডুপ্লেক্স ভাড়া করে সেখানে কাস শুরু করেছেন। সেখানে বাংলা থেকে শুরু করে ধর্ম বিষয়েও কোচিং করানো হয়। এসব কোচিংয়ে পঞ্চম ও অষ্টম এবং নবম-দশম শ্রেণীর সব শিক্ষার্থী ছাড়াও অন্য শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা অংশ নিচ্ছে। স্কুলে কোনো পড়াশোনা হচ্ছে না। শ্রেণী শিক্ষকেরা শুধু বইয়ের অধ্যায় ধরে পড়া দেন। পড়া বুঝিয়ে দেন না বলে অভিযোগ বেশ কিছু শিক্ষার্থীর। পঞ্চম ও অষ্টম এবং নবম-দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা স্কুল কোচিংয়ে কাস শেষ করে অন্য শিক্ষকদের কাছে গিয়ে পড়ছে। অভিভাবকেরাও সন্তানের ভালো রেজাল্ট এবং উজ্জ্বল ভবিষ্যতের চিন্তায় ছুটছেন এক কোচিং থেকে অন্য কোচিংয়ে।   কোচিং বন্ধ এবং একে নিয়ন্ত্রণের জন্য শিক্ষামন্ত্রীর হুঁশিয়ারি আর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জারি করা নীতিমালার কোনো তোয়াক্কাই করছেন না এসব কোচিংবাজ শিক্ষক বা স্কুল কর্তৃপক্ষ। দু’টো পক্ষই পাল্লা দিয়ে কোচিং চালিয়ে যাচ্ছে। জানা গেছে, আগে ভালো স্কুলের শিক্ষকেরা কোনো না কোনো কোচিং সেন্টারের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। তারা এখন নিজেই ব্যাচ করে কোচিং চালিয়ে যাচ্ছেন। কোনো কোনো শিক্ষক অন্য স্কুলের ও এলাকার শিক্ষার্থীদের নিয়ে কোচিং সেন্টার খুলে বসেছেন। কোচিং সেন্টারে এ বছর কোচিং ফি’র পরিমাণও বেড়ে গেছে।   শিক্ষাবিদেরা বলছেন, পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণীর সমাপনীর মতো অহেতুক পাবলিক পরীক্ষার বোঝা কোচিং বাণিজ্যকে আরো উৎসাহিত করেছে। অভিভাবকেরা এ-প্লাস, গোল্ডেন এ-প্লাসের আশায় পড়ে কোচিংয়ের পেছনে ছুটছেন। অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা কোচিংবাজ শিক্ষকদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছেন। সেভ দ্য চিলড্রেন অস্ট্রেলিয়ার সহায়তায় পরিচালিত শিশু সংগঠন চাইল্ড পার্লামেন্টের জরিপে দেখা যায়, ৮২ শতাংশ ছাত্রছাত্রী গৃহশিক্ষকের কাছে পড়ে বা কোচিংয়ে অংশ নেয়। জরিপে মন্তব্য করা হয়, বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রয়োজনীয় গুণগত শিক্ষা দিতে পারছে না। ফলে শিক্ষার্থীরা ভালো ফলের জন্য গৃহশিক্ষক বা কোচিংয়ের শরণাপন্ন হচ্ছে। পরিবারের ওপর কোচিং বাড়তি আর্থিক চাপ সৃষ্টি করছে এবং এ ব্যয় নির্বাহে অভিভাবকেরা হিমশিম খাচ্ছেন। অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি জিয়াউল কবীর দুলু নয়া দিগন্তকে বলেন, কোচিং বাণিজ্যের সাথে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) কর্মকর্তারা জড়িত। তা না হলে এসব বন্ধে তাদের কোনো পদক্ষেপ কার্যকর হচ্ছে না কেন? তাদের সদিচ্ছা নেই। তিনি আরো বলেন, ‘শিক্ষামন্ত্রীর কথাবার্তায় কোচিং বাণিজ্য উৎসাহিত হয়েছে।’ তিনি বলেন, কোচিং বন্ধে মনিটরিং কমিটি লোক দেখানো ও আইওয়াশ। কোচিংবাজ শিক্ষকদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।   গত ডিসেম্বরে প্রকাশিত প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী ও জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষার ফলাফলে যেসব প্রতিষ্ঠান শীর্ষ তালিকায় স্থান পেয়েছে তার প্রতিটির কোচিংবাজ শিক্ষকেরা নতুন বছরের শুরুতে কোচিং শুরু করেছেন বলে জানা গেছে। সবারই কোচিং ফির পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান আবার পঞ্চম ও অষ্টম এবং নবম-দশম শ্রেণীর সব শিক্ষার্থীর স্কুল কোচিং বাধ্যতামূলক করেছে। সেখানে বাড়তি ফি দিতে হয়েছে সবাইকে।   সরেজমিনে দেখা গেছে, ভিকারুননিসা স্কুল অ্যান্ড কলেজকে কেন্দ্র করে সিদ্ধেশ্বরী এলাকা ও এর আশপাশে বিভিন্ন ফ্যাট ভাড়া করে শিক্ষকেরা কোচিং সেন্টার চালান। মনিপুর হাইস্কুলের মূল ক্যাম্পাস এবং শাখাগুলোর আশপাশে গড়ে উঠেছে অসংখ্য কোচিং সেন্টার। একই অবস্থা এ কে স্কুল অ্যান্ড কলেজকে ঘিরে। এই কলেজের অধ্যক্ষ মো: সেলিম ভূঁইয়া বলেন, আমাদের কোনো শিক্ষকের পঞ্চম ও অষ্টম এবং নবম-দশম শ্রেণীর কোনো শিক্ষার্থীকে কাসের বাইরে কোচিং করানোর ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তবে এসব শিক্ষার্থী অন্য কোথাও কোচিং করলে আমরা তাদের বারণ করতে পারি না।   এ কে স্কুলের পাশের এক কোচিং সেন্টারের মালিক নয়া দিগন্তকে বলেন, এখানে যে হারে কোচিং সেন্টার রয়েছে তা রাজধানীর অন্য কোনো এলাকায় নেই। এসব কোচিংয়ের কোনোটির মালিকানা শিক্ষকদের সরাসরি, আবার কিছু সেন্টার পরোক্ষভাবে তারা তাদের স্ত্রী, ভাই, শ্যালকসহ নিকট আত্মীয়দের দিয়ে চালাচ্ছেন। মতিঝিল, বাসাবো, মুগদা, ফার্মগেট, ইন্দিরা রোড, শনির আখড়া, পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজার ও নারিন্দা এলাকায় ভাড়া করা ফ্যাটে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের কোচিং সেন্টারের জন্য এলাকাগুলো পরিচিত। ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণীর এক ছাত্রীর মা জানান, সকালে মেয়েকে নিয়ে তিনি বের হন আর রাত ৯টায় বাসায় ফেরেন। স্কুল শেষে তার মেয়ে প্রতিদিন তিনটি করে কোচিং করে। এক বিষয়ের পড়া শেষে অন্য বিষয়ের শিক্ষকের বাড়িতে তাকে ছুটতে হয়। তিনি বলেন, যত নামকরা স্কুল, কোচিংয়ের চাপ তত বেশি। স্কুলে লেখাপড়া হয় না, তাই কোচিংই ভরসা।   অভিভাবক সমন্বয় পরিষদের মহাসচিব নীপা সুলতানা নয়া দিগন্তকে বলেন, আগে শিক্ষকেরা কোচিং সেন্টারের সাথে যুক্ত ছিলেন; এখন নিজেরা ফ্যাট ভাড়া করে কোচিংবাণিজ্য করছেন। কোচিং নিয়ন্ত্রণে কোনো কিছু কাজে আসছে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, শিক্ষকেরা আগের চেয়েও এখন আরো বেপরোয়া। আর অভিভাবকেরা তাদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছেন।   ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের কোচিং বন্ধ নীতিমালা-২০১২’ অনুযায়ী কোনো শিক্ষক তার নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীকে কোচিং করাতে পারবেন না। নীতিমালা অনুযায়ী অন্য প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীকে নিজ বাসায় পড়ানোর জন্য প্রতিষ্ঠান প্রধানের অনুমতি লাগবে। এ ক্ষেত্রে লিখিতভাবে ছাত্র-ছাত্রীর তালিকা, রোল ও শ্রেণী উল্লেখসহ প্রতিষ্ঠানপ্রধানকে জানাতে হবে।

No comments:

Post a Comment