Saturday, January 31, 2015

রফতানি বাণিজ্যে বিপর্যয়:যুগান্তর

রাজনৈতিক অস্থিরতায় দেশের রফতানি খাত বড় ধরনের ইমেজ সংকটের মুখে পড়েছে। বিদেশী ক্রেতারা আদেশ অনুযায়ী পণ্য না পাওয়ার আশংকায় এখন রফতানির আদেশ বাতিল করে দিচ্ছেন। ইতিমধ্যে তৈরি পোশাক খাতের ১৩৫ কোটি টাকার আদেশ বাতিল করে দিয়েছেন বিদেশী ক্রেতারা। এ পর্যায়ে রয়েছে আরও প্রায় শত কোটি টাকার অর্ডার। একই কারণে দেড় হাজার কোটি টাকার হিমায়িত চিংড়ি রফতানি আটকে রয়েছে। চামড়াজাত পণ্য রফতানির আদেশ কমে গেছে। অবরোধে পরিবহন
সংকটের কারণে ব্যাহত হচ্ছে সবজি রফতানি। এসব মিলে রফতানি খাতে বড় ধরনের বিপর্যয় আসছে। রফতানিকাকরা বলেছেন, রাজনৈতিক অস্থিরতা আরও দীর্ঘায়িত হলে রফতানি খাতে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি হবে। তখন আর ক্রেতারা বাংলাদেশে আসবেন না। চলে যাবেন অন্য দেশে। এ অবস্থা হলে রফতানির পাশাপাশি দেশের রফতানিমুখী শিল্প ধ্বংস হয়ে যাবে। তাদের মতে, রফতানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্পে ক্ষতি সবচেয়ে বেশি। এর পরেই রয়েছে চিংড়ি, চামড়া, সবজি রফতানি খাতের অবস্থা। এ প্রসঙ্গে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের বলেছেন, উদ্ভূত পরিস্থিতি দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য খুবই খারাপ। রাজনৈতিক অস্থিরতাজনিত সহিংসতা ও অর্থনীতির ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি সারা বিশ্বেই বাংলাদেশ সম্পর্কে একটা খারাপ মেসেজ যাচ্ছে। এটি দেশের অর্থনীতির জন্য মোটেই শুভকর নয়। আমরা আশা করছি, খুব দ্রুতই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে। তৈরি পোশাক : রাজনৈতিক অস্থিরতায় এখন পর্যন্ত পোশাক খাতের ১৩৫ কোটি ডলারের রফতানির আদেশ বিদেশী ক্রেতারা বাতিল করে দিয়েছেন। সময়মতো পণ্য জাহাজে তুলতে না পারায় ১ লাখ ৬৮ হাজার ডলারের পণ্য বিশেষ কমিশন দিয়ে বিক্রি করতে হয়েছে উদ্যোক্তাকে। আরও প্রায় ২৭ লাখ ৫২ হাজার ডলারের পণ্য রফতানি করা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। পণ্য তৈরিতে দেরি হওয়ায় ক্রেতা ধরে রাখতে বিমানে পাঠাতে হচ্ছে। ফলে অবরোধের প্রথম ১০ দিনে আরও ৪ লাখ ৫৬ হাজার ডলারের পণ্য বিমানে পাঠাতে হয়েছে। এছাড়া অবেরোধ ও হরতালে নাশকতায় আক্রান্ত হয়ে ক্ষতি সাধিত হয়েছে ৩৮ লাখ ৩৯ হাজার ডলারেরও বেশি। রফতানির আদেশও কমে যাচ্ছে। এমবি নিট ফ্যাশনের ৩৮ লাখ ডলারের আদেশ বাতিল হয়েছে। ম্যাগপাই গ্রুপের একাধিক প্রতিষ্ঠানের ৩৬ লাখ ডলারের আদেশ বাতিলসহ ১৬ লাখ ডলারের রফতানি অর্ডার সরবরাহে জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। ক্রিয়েটিভ ওলওয়্যারের ১১ লাখ ডলারের রফতানির আদেশ বাতিল হয়েছে। প্রতিষ্ঠানের আরও ৫৩ লাখ ডলারের পণ্যের শিপমেন্ট দেরি হয়েছে। মোহাম্মদী গ্র“পের সাড়ে ৪ লাখ ডলারের পণ্য শিপমেন্ট না হওয়ার অর্ডার ধরে রাখতে বাড়তি দেড় লাখ ডলার ব্যয়ে বিমানে পাঠাচ্ছে। স্টার অ্যাপারেলসের ৪৮ হাজার ডলারের রফতানি আটকে গেছে। এ পণ্য নিতে ক্রেতা ১০ শতাংশ কমিশন দাবি করেছে। রফতানি আদেশ বাতিলের মুখে পড়েছে ফ্রেন্ডস স্টাইলওয়্যার। প্রতিষ্ঠানটিকে স্বাভাবিক ব্যয়ের চেয়ে ১ লাখ ৫৯ হাজার ডলার বাড়তি ভাড়া দিয়ে বিমানে পণ্য পাঠাতে হচ্ছে। ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে পাঠানোর সময় প্রতিষ্ঠানটির ৩৩ লাখ ৮৮ হাজার ডলারের পণ্য নাশকতার কবলে পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাদের ক্ষতির পরিমাণ ৬৭ লাখ ৭৬ হাজার ডলার। সাসকোটেক্সের রফতানি আদেশ বাতিল হয়েছে ১ লাখ ১০ হাজার ডলারের। বিশেষ কমিশন দিয়ে ৩৪ হাজার ডলারের পণ্য বিক্রি করতে হয়েছে। সময়মতো পণ্য জাহাজে তুলতে ব্যর্থ হওয়ায় ২৭ হাজার ৩০০ ডলার বাড়তি ভাড়া দিয়ে বিমানে পণ্য পাঠাতে হয়েছে। সব মিলে প্রতিষ্ঠানটির ক্ষতি ১ লাখ ৭১ হাজার ৩০০ ডলার। জুলফিকার ফ্যাশনের ক্ষতির পরিমাণ ৩ লাখ ৩০ হাজার ৬০০ মার্কিন ডলার। এর মধ্যে রফতানির আদেশ বাতিল হয়েছে ২ লাখ ২৫ হাজার ডলারের। এছাড়া মূল্য ছাড় দিতে হয়েছে ৪৪ হাজার ডলারের, বিমানে পণ্য পাঠাতে বাড়তি ভাড়া দিতে হয়েছে ৫৬ হাজার ডলারের এবং নাশকতার মুখে ক্ষতি হয়েছে ৫ হাজার ৬০০ ডলারের। বাংলা পোশাকের ৪ লাখ ৬৫ হাজার ডলারের বেশি পণ্য জাহাজিকরণে দেরি হওয়ায় প্রতিষ্ঠানটির ক্ষতি হয়েছে ১ হাজার ২৮২ ডলার। আর্ভা টেক্সটাইলের ১ লাখ ৪৮ হাজার ডলারের রফতানির আদেশ বাতিল, মূল্য ছাড় দিতে হয়েছে ৩২ হাজার ডলার। বিমানে পণ্য পাঠাতে বাড়তি ব্যয় হয়েছে ৫৫ হাজার ৩৫৩ মার্কিন ডলার। বিলম্বিত হওয়ায় ১ লাখ ৯৮ হাজার ডলারের রফতানি পণ্য আটকে গেছে। এতে প্রতিষ্ঠানটির ক্ষতি হয়েছে ৩ লাখ ৯ হাজার ৩৮ ডলার। হাই ফ্যাশন কম্পোজিটের রফতানির আদেশ বাতিল হয়েছে ১ লাখ ৪৩ হাজার ২৩৬ ডলারের। বিশেষ কমিশন দিয়ে পণ্য বিক্রি করায় ক্ষতি হয়েছে ৩৫ হাজার ৩১৭ ডলার। বিমানে পণ্য পাঠাতে বাড়তি ব্যয় হয়েছে ৩৪ হাজার ৫১ ডলার। পণ্য পরিবহন সংকটে শিপমেন্ট আটকে আছে ৫৩ হাজার ডলার পণ্যের। নাশকতার মুখে প্রতিষ্ঠানটির ক্ষতি ২ লাখ ৬৫ হাজার ৬০৫ ডলারের। তাদের সার্বিক ক্ষতির পরিমাণ ৫ লাখ ৩১ হাজার ২০৯ ডলার। জেডএসবি কোম্পানির পণ্য বিমানে পাঠাতে বাড়তি ব্যয় হয়েছে ৪৩ হাজার ডলার। রফতানি আদেশ বাতিল হয়েছে ৭৫ হাজার ৪৭০ ডলার। ৬২ হাজার ডলার পণ্যের জাহাজিকরণ আটকে গেছে। সহিংসতায় ক্ষতি হয়েছে ১ লাখ ৮০ হাজার ডলার। তাদের সার্বিক ক্ষতি ৩ লাখ ৬০ হাজার ডলারের বেশি। করিম টেক্সটাইলের ৫ লাখ ডলারের আদেশ বাতিল, ১০ হাজার ডলারের পণ্য বিশেষ কমিশন দিয়ে বিক্রি, বিমানে পণ্য পাঠাতে বাড়তি খরচ ১৫ হাজার ডলার এবং ৩ লাখ ডলারের শিপমেন্ট ব্যর্থ হওয়ায় এদের ক্ষতির পরিমাণ ৮ লাখ ২৫ হাজার ডলার। এ সম্পর্কে বিজিএমইএ সিনিয়র সহ-সভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম যুগান্তরকে বলেন, রাজনৈতিক অস্থিরতায় রফতানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এই অবস্থা চলতে থাকলে পোশাক খাতকে টিকিয়ে রাখা যাবে না। লোকসান দিয়ে রফতানি করা হলেও এখন ক্রেতারা আর ঢাকায় আসতে চাচ্ছেন না। ফলে আদেশ কমে যাচ্ছে। চামড়া : চামড়া খাতেও রফতানির আদেশ বাতিল হওয়ার আশংকা দেখা দিয়েছে। সময়মতো পণ্য জাহাজে তুলতে না পারলে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝিতে একটি প্রতিষ্ঠানেরই ১৩ লাখ ডলারের রফতানির আদেশ বাতিল হতে পারে। আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের রফতানির আদেশ বাতিল হওয়ার পর্যায়ে চলে গেছে। ইতিমধ্যে চামড়া পণ্য ও জুতা রফতানিতে ক্রেতাদের আদেশ আসার পরিমাণ কমে গেছে। বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ চামড়াজাত পণ্য প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতির একটি প্রতিনিধি দল বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদের সঙ্গে দেখা করে তাদের রফতানির আদেশ আসার পরিমাণ কমে যাওয়ার বিষয়টি জানিয়েছেন। এ বিষয়ে সমিতির সভাপতি আবু হায়দার যুগান্তরকে বলেন, রফতানি অর্ডার কমায় ভবিষ্যতে এর পরিমাণ কমে যাবে। তবে এখনও রফতানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েনি। সবজি : রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রভাব পড়েছে সবজি রফতানিতেও। অবরোধে পরিবহন সংকটের কারণে রফতানিকারকরা গ্রাম থেকে সবজি ঢাকায় আনতে পারছে না। ফলে তাদের রফতানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ খাতের পণ্য বিমানে পাঠানো হয় বলে এখনও ক্ষতির পরিমাণ কম। তবে রাজনৈতিক অস্থিরতা দীর্ঘায়িত হলে তাদের রফতানি আয় কমে যাবে। এদিকে বিমানে রফতানি করতে গিয়ে এমনিতেই বেশি খরচ হচ্ছে। বাংলাদেশ ফ্রুটস ভেজিটেবল অ্যান্ড অ্যালাইড প্রোডাক্ট এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এসএম জাহাঙ্গীর হোসেইন বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বাংলাদেশ থেকে ব্যাপক পরিমাণে সবজি রফতানি হয়। রাজনৈতিক সংকটের কারণে আমরা তা করতে ব্যর্থ হলে তারা অন্য দেশ থেকে সবজি আমদানি করবে। চিংড়ি : সময়মতো পণ্য জাহাজে তুলতে না পারায় চিংড়ি রফতানিতেও বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। ক্রেতাদের রফতানি অর্ডার যেমন কমে গেছে, তেমনি পরিবহন সংকটের কারণে বন্দরে পাঠানো যাচ্ছে না পণ্য। এতে তাদের প্রতিদিন ক্ষতি হচ্ছে প্রায় ৮ থেকে ১০ কোটি টাকা। এদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে চিংড়ির দাম কমে যাওয়ায় এমনিতেই রফতানিকারকরা ক্ষতির মুখে পড়েছেন। দাম কম হওয়ায় তাদের গুদামে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার চিংড়ি আটকে রয়েছে, যা রফতানি করতে পারছেন না।  

No comments:

Post a Comment