Thursday, January 22, 2015

হিন্দি সিনেমা ঠেকাতে কাফনের কাপড় পরে শিল্পীদের মিছিল:নয়াদিগন্ত

আগামীকাল শুক্রবার থেকে দেশের ৬০টি হলে একসাথে মুক্তি পেতে যাচ্ছে ভারতের হিন্দি সিনেমা। আর এই হিন্দি সিনেমার আমদানি ঠেকাতে দেশে আন্দোলনে নেমেছেন চলচ্চিত্র শিল্পী-পরিচালক-প্রযোজক-কলাকুশলী ও কর্মীরা। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র ঐক্যজোটের ব্যানারে চলছে এ আন্দোলন। আন্দোলনকারীরা স্বাধীনতা-উত্তরকালে বঙ্গবন্ধুর দেয়া নির্দেশনা অনুসারে উপ-মহাদেশের অপর কোনো দেশ থেকে সিনেমা আমদানি ও প্রদর্শন বন্ধ করার দাবি করেছেন। সেজন
্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চেয়েছেন তারা।   গতকাল বুধবার আন্দোলনের দ্বিতীয় দিনে কাফনের কাপড় পরে মিছিল করেন শিল্পীরা। প্রথম দিন গত মঙ্গলবার চলচ্চিত্র ঐক্যজোটের ব্যানারে সংবাদ সম্মেলন, মানববন্ধন পালন করা হয়। পরে বিকেল থেকে সব ধরনের শুটিং বন্ধ করে দেয়া হয়েছে বলে খ্যাতিমান নির্মাতা সোহানুর রহমান সোহান নয়া দিগন্তকে নিশ্চিত করেছেন। পরিচালক সমিতির সভাপতি দেলোয়ার জাহান ঝন্টু নয়া দিগন্তকে বলেন, সরকার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন না করা পর্যন্ত তাদের আন্দোলন চলবে।   শিল্পী এ টি এম সামসুজ্জামান বলেন, প্রধানমন্ত্রী আমাদের কথা না শুনলে আমরা কার কাছে যাবো। তাকে আমাদের কথা শুনতে হবে। তিনি বলেন, আমদানিকারকেরা যেসব কথা বলছেন, যেসব যুক্তি দিয়ে সিনেমা আমদানি করেছেন, এসব ঠিক নয়, সিনেমা এখন ঘুরে দাঁড়াচ্ছে।   অন্য দিকে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান ইনউইন এন্টারপ্রাইজের কর্ণধার ইফতেখার উদ্দিন নওশাদ নয়া দিগন্তকে বলেন, আমরা আইন মেনে সিনেমা আমদানি করেছি, প্রদর্শনের জন্য প্রস্তুত আমরা।   চলচ্চিত্রের পুরনো কর্মীরা বলেছেন, ষাটের দশকে ‘মুখ ও মুখোশ’ দিয়ে যে বাংলা সিনেমার যাত্রা শুরু হয়েছিল, সে সিনেমা দিনে দিনে তার ঐতিহ্য হারিয়ে এখন তলানিতে ঠেকেছে। কিছু অশিতি অর্ধশিতি সিনেমা নির্মাতা ও পরিচালকের খপ্পরে পড়ে সিনেমা দেউলিয়া হওয়ার সুযোগ করে দিয়ে একটি প এখন ভারত থেকে সিনেমা আমদানি করছে।   এতে করে দেশী চলচ্চিত্র শিল্প হুমকির মুখে পড়বে উল্লেখ করে চলচ্চিত্র নির্মাতা ও খ্যাতিমান গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ার নয়া দিগন্তকে বলেছেন, একটা অসম প্রতিযোগিতায় দেশের সিনেমাকে ঠেলে দেয়ার সুযোগ নেই। এখানে যে প্রযুক্তিগত সুবিধা নিশ্চিত করা দরকার সেটি না করে, পরিচালক ও শিল্পীদের পড়াশোনার ও দতা বৃদ্ধির ব্যবস্থা না করে, ভারতের সিনেমা এনে দেশী সিনেমাকে ধ্বংস করা ছাড়া কিছুই দেখছি না। বিষয়টি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উপলব্ধি করে ভারতীয় সিনেমা আমদানি রহিত করেছিলেন বলে তিনি জানান।   মিশা সওদাগর নয়া দিগন্তকে বলেন, যেকোনো মূল্যে বাংলাদেশে ভারতীয় সিনেমা প্রদর্শনী বন্ধ করা হবে। কারণ এখানে কোনোভাবেই একটা অসম প্রতিযোগিতা চলতে পারে না। তিনি বলেন, সিনেমা হল মালিকেরা কেবল টাকা চেনেন। তারা এখানকার সিনেমা নিয়ে তাই মনগড়া সব অভিযোগ করে থাকেন। তাদের এসব অভিযোগের ভিত্তি নেই। তারাই এখানকার সিনেমাতে কাটপিস ঢুকিয়ে পরিবেশ নষ্ট করেছেন।   নয়া দিগন্তের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ১৯৯৬ সালের দিকে বাংলা সিনেমায় প্রথম অশ্লীলতার আবির্ভাব ঘটে। অবশ্য এর আগে আশির দশকে গোপন কথা নামে একটি এডাল্ট রেটিংয়ের সিনেমা দেশে সেন্সর ছাড়পত্র পেয়েছিল। দ্বিতীয়বারের মতো মোহাম্মদ হোসেন পরিচালিত ‘ফায়ার’ সিনেমাটি এডাল্ট রেটিংয়ের সিনেমা হিসেবে সেন্সর সনদের জন্য আবেদন করেছিল। তবে তারা তা পায়নি।   চলচ্চিত্র শিল্পের সাথে জড়িতরা বলেছেন, ১৯৯৭ সালের দিকে বাংলা সিনেমায় অশ্লীলতা ঢোকানোর সূত্রপাত ঘটে। সে সময় ভারতীয় নায়িকাদের দিয়ে বাংলা সিনেমা নির্মাণও বেড়ে যায়। পরবর্তী সরকারের সময়েও একই হাল ছিল। তবে এটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এসেছিল। সে সময় এসব সিনেমার সাময়িক লাগাম টেনে ধরার জন্য সেন্সর সনদ সাময়িকভাবে বাতিল করে সে সময়কার সরকার।   চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছেন, বর্তমান সরকার মতায় আসার পর চলচ্চিত্রে অশ্লীল দৃশ্য সংযোগ বহু গুণে বেড়ে যায়। চলমান সময়ে মুক্তি পাওয়া সিনেমার বদলে পুরনো সিনেমাগুলোর সাথে আধা ঘণ্টা থেকে এক ঘণ্টা পর্যন্ত কাটপিস লাগিয়ে দেখানো চলতে থাকে। ঢাকার কাছের ‘লাভলী’, ‘হীরা’, ‘অভিসার’, ‘রংধনু’, ‘বন্ধু’ ও ‘রাজমহল’র মতো সিনেমা হলে অশ্লীল সিনেমা দেখানো অব্যাহতভাবে চলছে।   বাংলাদেশের সিনেমার এমন দুর্দিনকে সামনে রেখে ভারতের সিনেমা আমদানি করা হচ্ছে, এমন কথা বলছেন প্রদর্শকেরা। তারা এও বলছেন, সিনেমা হল বাঁচাতে হলে ভালো সিনেমা লাগবে, যেটি বাংলাদেশে হচ্ছে না। তবে এ অভিযোগ নাকচ করে মিশা সওদার বলছেন, বাংলা সিনেমা এখন অনেক বড় বাজেটে তৈরি হচ্ছে, ভালো সিনেমা হচ্ছে। এসব ভারতীয় সিনেমা আমদানির একটা কৌশল মাত্র।   ২০১১ সালের জুলাই মাসে ভারত থেকে আসে বাংলা সিনেমা ‘জোর’, ‘বদলা’ ও ‘সংগ্রাম’। এ তিনটি সিনেমা এখন বাংলাদেশে দেখানোর প্রস্তুতি নেয়া হয়। এর মধ্যে একটি ভারতীয় বাংলা সিনেমা মুক্তিও দেয়া হয়েছিল। তবে সেটি ব্যবসা করতে পারেনি।   চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির নেতা মিয়া আলাউদ্দিন বলছেন, তারা এখন সেন্সর বোর্ডে আবেদন করবেন, যাতে সিনেমাগুলো দেখানো সম্ভব হয়। সামনে আরো অন্তত ৯টি হিন্দি সিনেমা বাংলাদেশের বাজারে আসছে। এর মধ্যে ওম শান্তি, কাভি আল বিদা না কেহ না, থ্রি ইডিয়টস, মাই নেম ইজ খান, দাবাং, রং দে বাসন্তী এবং ম্যায় হু না অন্যতম।   এসব সিনেমা কৌশলে আনা হচ্ছে। ২০১০ সালে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বিদেশী সিনেমা বিশেষ করে ভারতীয় সিনেমা আমদানির বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। এই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার পরপরই প্রদর্শকেরা ১২টি সিনেমা আমদানির জন্য ঋণপত্র (এলসি) খোলেন। এসব সিনেমার মধ্যে তিনটি এসেছে। বাকিগুলোও আসছে, সহসা।   মিয়া আলাউদ্দিন বলেন, তারা আদালতের রায় নিয়েই সিনেমাগুলো আমদানি করেছেন। সূত্র মতে, গত বছর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার পর এর বিরোধিতা করেন চলচ্চিত্র নির্মাতা ও শিল্পীরা। পরে সরকারের প্রধানমন্ত্রী সিনেমা আমদানি করা হবে না বলে ঘোষণা দেন। এতে আন্দোলন থেমে যায়।   সেন্সর বোর্ডেও সে সময়কার ভাইস চেয়ারম্যান সুরথ কুমার সরকার বলেছিলেন, এ ১২টি সিনেমা মূলত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার পরপরই ঋণপত্র খোলা সিনেমা, যেগুলোর ছাড় করার বিষয়ে আদালতের নির্দেশনা ছিল। তাই তারা এর অনুমোদন দিয়েছেন।   চলচ্চিত্র নির্মাতা গাজী মাজহারুল আনোয়ার বলছেন : তারা বিষয়টি সম্পর্কে উদ্বিগ্ন। শিল্পী মিশা সওদাগর বলছেন, যে সিনেমা হলের মালিকেরা ভারতীয় সিনেমা আনার পে বলছেন, তারাই বাংলা সিনেমায় পর্নোগ্রাফি ঢুকিয়ে এ শিল্পকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছেন। তাদের বিপক্ষে আন্দোলন চলবে।

No comments:

Post a Comment