Saturday, March 28, 2015

ক্রেস্টের সোনা জালিয়াতির তদন্তে জট:প্রথম অালো

বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে অবিস্মরণীয় অবদানের জন্য বিদেশি বন্ধু ও সংগঠনকে দেওয়া ক্রেস্টে সোনা জালিয়াতির ঘটনার কোনো তদন্তই শেষ হয়নি। প্রায় এক বছর ধরে একাধিক তদন্ত চলতে থাকায় এই জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে বিচারের মুখোমুখি করার কাজও থমকে আছে। ‘ক্রেস্টের স্বর্ণের ১২ আনাই মিছে!’ শিরোনামে গত বছরের ৬ এপ্রিল প্রথম আলোয় খবর প্রকাশিত হওয়ার পর তদন্ত কমিটি, অধিকতর তদন্ত কমিটি, সংসদীয়
তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। থানায় মামলা এবং হাইকোর্টে রিটও হয়। প্রথম তদন্ত কমিটি একটি প্রতিবেদন দিলেও পরে অধিকতর তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটি এখনো প্রতিবেদন দেয়নি। একই অবস্থা সংসদীয় তদন্ত কমিটিরও। দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্তেরও কোনো অগ্রগতি নেই। আলোচিত এই ক্রেস্ট জালিয়াতি ঘটনায় সরবরাহকারী দুটি প্রতিষ্ঠানের মালিকের বিরুদ্ধে প্রতারণা ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে মামলা করেছিল মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। সে মামলারও তেমন অগ্রগতি নেই। একই বিষয়ে শহীদ পরিবারের সদস্য নাসরিন আহমেদের পক্ষ থেকে রিট আবেদন করা হয় হাইকোর্টে। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক গত বুধবার এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘মামলা করার পর এ বিষয়ে আমাদের কাছে কেউ কিছু জানতে চায়নি। তা ছাড়া এখন পর্যন্ত জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের গঠন করা অধিকতর তদন্ত কমিটির কোনো প্রতিবেদনও পাইনি। তাই পুরো বিষয়টি থমকে আছে।’ ক্রেস্ট জালিয়াতির খবর প্রকাশের পর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব মাসুদ সিদ্দিকী, অতিরিক্ত সচিব গোলাম মোস্তফা, যুগ্ম সচিব আবুল কাশেম ও জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব মো. বাব ুল মিঞাকে ওএসডি করা হয়। ওএসডি থাকা অবস্থায় মাসুদ সিদ্দিকী অবসরোত্তর ছুটিতে গেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়ে চাকরির মেয়াদ বাড়ানোরও অভিযোগ ছিল। পরে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় তাঁর সনদ বাতিল করে। সাত পর্বে দেওয়া ওই সম্মাননায় ব্যক্তি ও সংগঠনের জন্য তৈরি করা ক্রেস্ট জাতীয় মান সংস্থা বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) কাছে পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে করা ওই পরীক্ষায় দেখা গেছে, ক্রেস্টে এক ভরি বা ১১ দশমিক ৬৬৪ গ্রাম সোনা থাকার কথা থাকলেও পাওয়া গেছে মাত্র ২ দশমিক ৩৬৩ গ্রাম (সোয়া তিন আনা)। এক ভরির মধ্যে প্রায় ১২ আনাই নেই। আর রুপার জায়গায় ৩০ ভরি বা ৩৫১ গ্রাম পিতল, তামা ও দস্তামিশ্রিত সংকর ধাতু দেওয়া হয়েছে ক্রেস্টে। তদন্ত কমিটি: প্রথমে গত বছরের ৯ এপ্রিল ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার জিল্লার রহমানকে প্রধান করে তিন সদস্যের কমিটি করা হয়েছিল। কমিটি ক্রেস্টে জালিয়াতির জন্য সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী এ বি এম তাজুল ইসলাম, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সচিব কে এইচ মাসুদ সিদ্দিকীসহ ১৩ কর্মকর্তা এবং দুই সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে দায়ী করে প্রতিবেদন দেয়। ওই বছরের ৫ মে এ প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়। কিন্তু যাঁদের বিরুদ্ধে ক্রেস্টের সোনা জালিয়াতির অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে, তাঁদের মধ্যে সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তা ছিলেন। তাঁরা বিভাগীয় কমিশনার পর্যায়ের কর্মকর্তাদের দিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্ত করানো নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে অধিকতর তদন্তের জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের গঠিত অধিকতর তদন্ত কমিটি: বাণিজ্যসচিব হেদায়েতুল্লাহ আল-মামুনকে প্রধান করে গত বছরের ৩ আগস্ট গঠন করা হয়েছিল অধিকতর তদন্ত কমিটি। কমিটি সূত্রে জানা গেছে, দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে থাকা চারটি ক্রেস্ট সিলগালা করার নির্দেশ দেয় এই কমিটি। এরপর এ-সংক্রান্ত সব নথিপত্র কমিটির কাছে নিয়ে আসা হয়। বিএসটিআইয়ের কর্মকর্তাদের সাক্ষাৎকার ও অভিযুক্ত সচিবসহ অন্য কর্মকর্তাদের বক্তব্য নেওয়া হয়েছে। আগামী সপ্তাহে যুগ্ম সচিব পর্যায়ের আরও কয়েকজনের বক্তব্য নেওয়া হবে। জানতে চাইলে জনপ্রশাসনসচিব কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রতিবেদন দেওয়ার কাজ শেষ পর্যায়ে বলে কমিটি আমাদের জানিয়েছে।’ কমিটির প্রধান হেদায়েতুল্লাহ আল-মামুন গত বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা তদন্তকাজ প্রায় শেষ করে এনেছি। ইতিমধ্যে ২০ জনের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে অনেক জটিলতা রয়েছে, তাই একটু সময় লাগছে। আশা রাখি, ৩০ এপ্রিল মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেওয়া যাবে।’ সংসদীয় কমিটি: সোনা জালিয়াতি তদন্ত করতে গত বছরের ১০ জুন সংসদীয় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। ওই তদন্ত শেষ হয়েছে বলে দাবি করেছেন কমিটির প্রধান। তবে সংসদীয় কমিটির বৈঠক না ডাকায় এখন পর্যন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে পারেননি তদন্ত কমিটির প্রধান আফছারুল আমীন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের প্রতিবেদন অনেক আগেই তৈরি করে রাখা আছে। বৈঠক ডাকলেই আমরা সংসদীয় কমিটির কাছে তা উপস্থাপন করব।’ তিনি বলেন, তদন্তে অনেক অনিয়ম উঠে এসেছে। তবে এ বিষয়ে এখন কোনো মন্তব্য করা ঠিক হবে না। প্রসঙ্গত. এই জালিয়াতির সময় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রনালয়ের প্রতিমন্ত্রী ছিলেন এ বি এম তাজুল ইসলাম। তিনি এখন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রনালয়সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির সভাপতি। দুদকের অনুসন্ধান: দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এ বিষয়ে অনুসন্ধানের দায়িত্ব নিয়ে নথিপত্র জব্দ করেছে। দুদকের উপপরিচালক মির্জা জাহিদুল আলমকে অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তদন্তের অগ্রগতির বিষয়ে জানতে চাইলে দুদকের চেয়ারম্যান বদিউজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘খুব বেশি দূর আগাতে পারিনি। ওইভাবেই পড়ে আছে।’ মামলার অবস্থা: ক্রেস্টে নির্ধারিত পরিমাণে সোনা না দেওয়ায় সরবরাহকারী দুটি প্রতিষ্ঠানের মালিকের বিরুদ্ধে প্রতারণা ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে গত বছরের ১০ জুন মামলা করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। এতে রাজধানীর বনানীতে অবস্থিত ক্রেস্ট সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান এমিকনের মালিক মীর দাউদ আহমেদ ওরফে নাজিম এবং শান্তিনগরের মেসার্স মহসিনুল হাসানের স্বত্বাধিকারী মো. মোহসিনুল হাসানের বিরুদ্ধে প্রতারণা করে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়। শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সিরাজুল ইসলাম এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘দুদক এ মামলাটি তদন্ত করবে। এ বিষয়ে আমরা প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পাঠিয়ে দিয়েছি।’ হাইকোর্টে রিট: গত ১৯ মে শহীদ পরিবারের সদস্য নাসরিন আহমেদের পক্ষে আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বিদেশি নাগরিক ও সংগঠনকে সম্মাননা হিসেবে আবার যথাযথভাবে ক্রেস্ট তৈরি করে দেওয়ার নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন। একই সঙ্গে ওই অনিয়ম তদন্তে গঠিত কমিটির প্রতিবেদন জনসমক্ষে প্রকাশ করতে নির্দেশনা চান। মনজিল মোরসেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘রিট আবেদনের সময় বলা হয়েছিল, মক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেবে। কিন্তু যেহেতু বিষয়টি আর এগোয়নি, এখন আমরা আবার আদালতের হস্তক্ষেপ কামনা করছি।’ একাধিক তদন্তের প্রয়োজনীয়তা ও এর ফলাফলের বিষয়ে জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, এতগুলো কমিটি করার অর্থ হচ্ছে বিচারপ্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত করা। এতে অভিযুক্তরা পার পেয়ে যাওয়ার মতো ফাঁকফোকরও তৈরি হতে পারে। আর যেখানে সংসদীয় কমিটির প্রধানই অভিযুক্ত ব্যক্তি, সেখানে সংসদীয় তদন্ত কমিটি তাঁকে কতটা দায়ী করতে পারবে তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাবে। তিনি বলেন, এই বিচারপ্রক্রিয়া যদি ব্যর্থ হয়, তা হবে খুবই দুঃখজনক।

No comments:

Post a Comment