Saturday, March 28, 2015

পদদলিত হয়ে ১০ পুণ্যার্থীর মৃত্যু:প্রথম অালো

গতকাল শুক্রবার সকাল আনুমানিক পৌনে আটটা। হাজার হাজার পুণ্যার্থীর সমাগম। কেউ স্নান শেষে বাড়ির পথ ধরেছেন। আবার কেউ স্নানের জন্য ঘাটের দিকে যাচ্ছেন। রাজঘাট-সংলগ্ন লাঙ্গলবন্দ বাজারের তিন রাস্তার মোড়ে তখন তিল ধারণের ঠাঁই নেই। হঠাৎ মোড়ের পাশের একটি বেইলি ব্রিজের ওপর থেকে চিৎকার ‘ব্রিজ ভেঙে গেল’। সঙ্গে সঙ্গে শুরু হলো হুড়োহুড়ি, ছোটাছুটি। একের পর এক নারী-পুরুষ মাটিতে লুটিয়ে পড়তে থাকেন। শত শত মানু
ষের পায়ের নিচে চাপা পড়েন তাঁরা। ভিড় কমে গেলে দেখা যায়, অনেক নারী-পুরুষ পড়ে আছেন। কেউ যন্ত্রণাহীন নিথর হয়ে, কেউবা যন্ত্রণায় কাতর। প্রায় ৩০ মিনিটের এই হুড়োহুড়িতে সেখান থেকে ১০ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। আহত হন আরও প্রায় ২০ জন। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে সাতজন নারী ও তিনজন পুরুষ। মরদেহগুলো বাজারের কাছেই একটি স্থানে রাখা হয়। সেখান থেকে প্রশাসন স্বজনদের কাছে লাশ হস্তান্তর করে। স্বজনেরা প্রিয়জনের মরদেহ শনাক্ত করার সময় কান্নায় ভেঙে পড়েন। হাজােরা মানুষ তখন নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে ছিলেন। সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা তাঁরা খুঁজে পাচ্ছিলেন না। প্রতিবছর চৈত্র মাসের শুক্ল তিথির অষ্টমীতে নারায়ণগঞ্জের লাঙ্গলবন্দে ব্রহ্মপুত্র নদে হিন্দুধর্মাবলম্বীদের এই পুণ্যস্নান অনুষ্ঠিত হয়। এখানে স্নানের জন্য মোট ১৬টি ঘাট আছে। এর মধ্যে রাজঘাটে স্নানের জন্য পুণ্যার্থীদের মধ্যে বেশি আগ্রহ দেখা যায়। ফলে এখানে ভিড় থাকে সবচেয়ে বেশি। ঘটনার সময় ওই স্থানে দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশের পরিদর্শক মো. রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ব্রিজের ওপর থেকে কয়েকজন বলে উঠল, ব্রিজ ভেঙে যাচ্ছে। তখন ব্রিজের ওপরই শত শত লোক। এই চিৎকার শোনার সঙ্গে সঙ্গে পুরো এলাকায় হুড়োহুড়ি লেগে যায়। ছোট একটু জায়গার মধ্যে এত চাপ অনেকেই সহ্য করতে পারেননি। যাঁরা মারা গেছেন, তাঁদের বেশির ভাগই বয়স্ক। কিন্তু ব্রিজটি আসলে ভাঙেনি, ঠিকই আছে। ঘটনাস্থলের পাশে দোকান আছে এমন কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী সাহাবুদ্দিন, ওমর ফারুক ও আলী নুরের বক্তব্যও পুলিশের বক্তব্যের সঙ্গে মিলে যায়। তাঁরা বললেন, ভয়ংকর চিৎকার এখনো তাঁদের কানে বাজে। আলী নুর বললেন, চোখের সামনে দেখলাম লুটিয়ে পড়া মানুষগুলোকে পায়ে পিষ্ট করে শত শত মানুষ চলে যাচ্ছে। মানিকগঞ্জ থেকে পুণ্যস্নানে আসা ছায়া রানী বলেন, ‘অল্পের জন্য বেঁচে যাই। ধাক্কা দিয়ে ফেলে আমার পায়ের ওপর পাড়া দিয়ে একের পর এক মানুষ চলে গেছে। পা সরাব, সেই শক্তিটুকু ছিল না। একজন দোকানদার আমাকে টেনে ভেতরে নিয়ে যায়।’ পরে ছায়া রানীকে তাঁর দুই আত্মীয় কোলে করে নিয়ে যান। তাঁর ডান পায়ের মাংস থেঁতলে গেছে। ঘটনাস্থলে শত শত জোড়া জুতা-স্যান্ডেল পড়ে থাকতে দেখা যায়। কিছু ইটের সঙ্গে রক্তের ছাপও দেখা যায়। নিহত ব্যক্তিদের সবাই যে পায়ের নিচে পড়ে নিহত হয়েছেন, তা নয়। অনেকে ভিড়ের চাপেই মারা গেছেন। জানালেন কয়েকজন চিকিৎসক। মরদেহগুলোর মধ্যে কারও কারও শরীরের বিভিন্ন স্থানে থেঁতলে যাওয়ার চিহ্ন স্পষ্ট। বেলা দুইটার মধ্যে লাশ নিজ নিজ পরিবারের সদস্যদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসন মৃত ব্যক্তিদের পরিবারপ্রতি ২৫ হাজার টাকা করে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। নিহত ব্যক্তিরা হলেন মাদারীপুরের চরমুগরিয়া কলেজের শিক্ষক নকুল সাহা (৫৫), মানিকগঞ্জ জেলার ঘিওর উপজেলার জাবরা গ্রামের বলাই দাসের স্ত্রী মালতি দাস (৭০), তাঁর ছেলে নিত্য গোপাল দাস, ঢাকার জিগাতলার নিতাই চন্দ্র দাসের স্ত্রী ভগবতী দাস (৬০), তাঁর মেয়ে ঢাকার লালবাগের শেখসাহেব বাজারের রাহী দাস (২৫), কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার পরিমল সাহার স্ত্রী কানন সাহা (৫২), নোয়াখালী জেলার কবিরহাটের অনীল নাথের স্ত্রী ভানুমতি নাথ (৫০), কুমিল্লা জেলার চান্দিনা উপজেলার কালিপদ নন্দীর ছেলে রণজিৎ নন্দী (৫৫), মুরাদনগর উপজেলার পরিমল দেবনাথের স্ত্রী তুলসী দেবনাথ (৫৫) এবং পটুয়াখালী জেলার বাউফল উপজেলার দ্বিজেন্দ্র লাল সেনের স্ত্রী সুচিত্রা সেন (৫০)। স্নান উদ্যাপন কমিটির সাধারণ সম্পাদক বাসুদেব চক্রবর্তী প্রথম আলোকে বলেন, শুক্রবার ভোর পাঁচটা ৪৭ মিনিট ৪৮ সেকেন্ডে লগ্ন শুরু হয়। এর আগে থেকে পুণ্যার্থীরা পাপ মোচনের আশায় স্নানের মাধ্যমে প্রার্থনার জন্য নদীর তীরে আসতে থাকেন। আজ শনিবার সকাল ছয়টা ৫৯ মিনিট ৩৮ সেকেন্ডে লগ্ন শেষ হবে। তবে স্নান উৎসব উপলক্ষে তিন দিন মেলা চলবে। মাধব কুণ্ড নামের এক ব্যবসায়ী বললেন, পদদলিত ও ভেতরের চাপে মৃত্যুর ঘটনা আগে ঘটেছে বলে মনে পড়ে না। চার-পাঁচ বছর আগে এক পুণ্যার্থী এখানে গাড়ির সঙ্গে ধাক্কা লেগে মারা গিয়েছিলেন। তাঁর অভিযোগ, পুলিশ ও প্রশাসন মানুষ চলাচলের জন্য শৃঙ্খলা তৈরি করতে পারেনি। এ জন্য এমন ঘটনা ঘটেছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, রাজঘাট এলাকায় রাস্তাটি খুবই সরু। তাই দুই দিক থেকে আসতে থাকা পুণ্যার্থীদের প্রচণ্ড ভিড় জমে যায় এবং একপর্যায়ে হুড়োহুড়ির সৃষ্টি হয়। এলাকাবাসীর অভিযোগ, দীর্ঘ ৮-১০ কিলোমিটার সরু রাস্তায় হাজারো পুণ্যার্থীর চলাচলে সহায়তায় পর্যাপ্তসংখ্যক স্বেচ্ছাসেবী ছিলেন না। এই দীর্ঘ হাঁটা পথে এত লোকের ভিড় সামলানো এমনিতেই বেশ কঠিন। তার ওপর বছরের পর বছর এ সরু রাস্তার দুই পাশের পরিত্যক্ত সম্পত্তি বেদখল করে বিভিন্ন দলের প্রভাবশালীরা অবৈধ দোকানপাট তুলে ভাড়া দিয়ে রেখেছেন। তবে নারায়ণগঞ্জ পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোখলেছুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, এখানে পুলিশের তৎপরতায় কোনো ঘাটতি ছিল না।

No comments:

Post a Comment