Friday, April 24, 2015

টাকা দিতে হবে, না দিলে কপাল খারাপ:যুগান্তর

ঢাকার একটি শিল্প গ্রুপের কর্মকর্তা মো. মোখলেছুর রহমান। থাকেন মিরপুরের রূপনগরের এস-৩০ ইস্টার্ন হাউজিংয়ের নিজ বাড়িতে। নির্মাণাধীন ছয়তলা এই বাড়ির মালিক হলেন মোখলেছুর রহমান। ৭ এপ্রিল সন্ধ্যা ৭টার দিকে তার বাড়িতে একটি মিষ্টির প্যাকেট পাঠায় কে বা কারা। ওই প্যাকেটের ভেতরে পাঠানো হয় পাঁচ লাখ টাকা চাঁদার দাবিতে মৃত্যু পরোয়ানা। বাড়ির মালিক এ ঘটনায় রূপনগর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। জিডি নম্বর ২৮৭।
চাঁদাবাজরা মিষ্টির প্যাকেটে এক পৃষ্ঠার একটি সাদা কাগজে এপিঠ-ওপিঠ লিখে ‘হুমকিপত্র’ দেয়। যেখানে মোখলেছুর রহমানের স্ত্রীকে উদ্দেশ করে লেখা হয়, ‘খালাআম্মা আশা করি সবাই মিলে ভালো আছেন, আর আমরাও চাই ভালো থাকেন- আমাদেরও ভালো রাখেন। আপনার কাছে আমাদের ছোট দাবি মাত্র পাঁচ লাখ টাকা। না দিলে কপাল খারাপ। আপনার কাছে একটি নমুনা পাঠালাম- চুপচাপ টাকা দিয়ে দেন আপনার খবর সবই জানি।’ চাঁদাবাজদের হুমকিপত্রে আরও লেখা হয়, ‘পুলিশ বা কাউকে জানালে আমাদের কিছুই হবে না, ক্ষতি আপনার। আর দেরি করলে আপনি আপনার ছেলে, মেয়ে ও স্বামী যাকে পাওয়া যাবে পেট্রলবোমা মেরে দেব। তার পরেরটা নিজেই বুঝবেন এত টাকাকড়ি, গাড়ি কি করবেন? এই বাড়ি ছেড়ে অন্য বাড়িতে গেলেও লাভ নেই। কারণ আমরা সব জানি। আমরা চাইলে আপনাকে নিমিষেই শেষ করে দিতে পারি। ছোট ব্যাপার ছোটই থাক। ইতি আপনার আশপাশের ভাগিনারা।’ মোখলেছুর রহমানের মেয়ে মৌসুমী রহমান বলেন, একজন অপরিচিত যুবক আমাদের কাছে পৌঁছে দিতে বাড়ির দারোয়ানকে মিষ্টির প্যাকেট দিয়ে যায়। ওই যুবক বলে যায়, পাশের একটি গ্যারেজে মিলাদ হয়েছে। তাই সেখান থেকে মিষ্টি পাঠানো হয়েছে। তিনি বলেন, পরদিন সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত ০১৯৮০২৬৬৬২৮ ও ০১৯৮০৮৯৬১৭৮ নম্বর থেকে আমার মায়ের মোবাইল ফোনে কল করে তারা পাঁচ লাখ টাকা দাবি করে। পরে তারা চারটি বিকাশ নম্বর প্রদান করে। পুলিশ ও গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে, শুধু মোখলেছুর রহমানের পরিবার নয়, মিরপুরসহ রাজধানীর বিভিন্ন অঞ্চলে তার মতো আরও অনেক পরিবার নিরাপত্তাঝুঁকিতে আছে। প্রাণ বাঁচাতে অনেকে গোপনে চাঁদা দিচ্ছে সন্ত্রাসীদের। হুমকির বিষয়ে সংশ্লিষ্ট থানাগুলোতে জিডি হলেও বেশিরভাগ ঘটনার তদন্ত হচ্ছে ঢিমেতালে। আর হুমকিদাতারা ধরাও পড়ছে খুব কমই। ৫০ হাজার টাকা দাবি করে না পেয়ে শনিবার (১৮ এপ্রিল) রাজধানীর মালিবাগে দুই ব্যবসায়ীকে কুপিয়ে জখম করে সন্ত্রাসীরা। আহত দুই ব্যবসায়ী হলেন- সজিব দাস ও দীপক চন্দ্র ভৌমিক। তারা জানান, এসডি পিওর ওয়াটার নামে বোতলজাত পানির ব্যবসা করেন তারা। ১৬ এপ্রিল স্থানীয় সন্ত্রাসীরা তাদের কাছে চাঁদা দাবি করলে এ ঘটনায় শাহজাহানপুর থানায় জিডি করা হয়। জিডি নম্বর ৬৬৩। তারা অভিযোগ করেন, জিডিতে চাঁদাবাজ-সন্ত্রাসীদের নাম উল্লেখ করে আসামি করা হলেও থানা পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এ কারণে সন্ত্রাসীরা টাকা না পেয়ে আমাদের কুপিয়ে জখম করেছে। দুই ব্যবসায়ী বলেন, পুলিশ তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিলে এ ঘটনা ঘটত না। পুলিশের তথ্যানুযায়ী, গত ৬-৭ মাসে অন্তত ২০ জন ব্যবসায়ী ও পরিবারকে চাঁদার দাবিতে হুমকি দেয়া হয়েছে। মিরপুর ৬ নম্বরের ব্যবসায়ী সালাহউদ্দিন আহমেদের কাছে পাঁচ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে সন্ত্রাসীরা। ওই ব্যবসায়ী জানান, মাসুদ নাম পরিচয় দিয়ে ফোন করে তার কাছে চাঁদা দাবি করা হয়েছে। কিন্তু এ ঘটনায় আটক বা গ্রেফতার না হওয়ায় তিনি এখন আতংকগ্রস্ত। একইভাবে সন্ত্রাসী বিহারি মহসিনের নামে তার কাছে ১০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করা হয়। ফোন করে বলা হয়, টাকা না দিলে তোর ছেলে ফজলে রাব্বীকে কবরে পাঠানো হবে। পল্লবী এভিনিউ ৫-এর ডিশ ব্যবসায়ী মজিবুর রহমানের কাছে পাঁচ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করা হয়েছে। তাকেও বলা হয়েছে, টাকা দিতে হবে। তা না হলে জানে শেষ হবি। পল্লবী এলাকার পরিবহন ও রড-সিমেন্টের ব্যবসায়ী ফজলুর রহমান লাভলুর কাছেও ১০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করা হয়েছে। তাদের মতো ব্যবসায়ী আবদুল শাহীন, আবিদ ইকবাল, ইকরামুর রহমান, এসএম নজরুল ইসলাম, ইয়াসিন আক্তার, সাজ্জাদ হোসেন, মো. নজরুল, হাসান ও মো. সোহেলের পরিবারের কাছে গত কয়েক মাসে ফোনে চাঁদা দাবি করে সন্ত্রাসীরা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, তদন্তে বেরিয়ে এসেছে পুলিশকে না জানিয়ে চাঁদাবাজদের টাকা দিয়েছে কেউ কেউ। এটা ভয়ানক অপরাধের জন্ম দেয়। এখন চাঁদার রেট বেড়ে যাওয়ায় ওই ব্যবসায়ীরা পুলিশের দ্বারস্থ হয়েছেন। ওই কর্মকর্তা বলেন, কেউ যেন কোনো হুমকিতে ভয় না পান। কারণ পুলিশ এ ধরনের চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার (ডিসি) শেখ নাজমুল আলম যুগান্তরকে বলেন, অনেকে গোপনে চাঁদা দিয়ে থাকেন। এ কারণে সমাজে অপরাধের জন্ম হয়। তাই হুমকিতে ভয় না পেয়ে পুলিশের তাৎক্ষণিক সহায়তা নেয়ার পরামর্শ দেন তিনি। ওই গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, এখন প্রযুক্তির যুগ। হুমকির শিকার ব্যক্তি যথাসময়ে যোগাযোগ করলে হুমকিদাতাকে শনাক্ত করা সম্ভব। কিন্তু অনেক ঘটনা তদন্তে দেখা গেছে, হুমকির শিকার ব্যক্তি সন্ত্রাসীদের সঙ্গে কথা বলে সময় নষ্ট করেছে। এতে সন্ত্রাসীরা আড়াল হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। কাজেই অপরাধীদের কোনো ধরনের সুযোগ করে দেয়া যাবে না। তার আগেই তাকে মোকাবেলা করতে হবে। পল্লবীতে গঠিত চাঁদাবাজ প্রতিরোধ টিমের তথ্যানুযায়ী, এ এলাকায় চাঁদা দাবির ঘটনায় দেশী এবং বিদেশী ৫০টি ফোন নম্বরের তথ্য পাওয়া গেছে। আর এ সংক্রান্ত ৭০টি অভিযোগ রয়েছে পুলিশের কাছে। চাঁদাবাজ প্রতিরোধ টিমের নেতৃত্বে থাকা পুলিশের পল্লবী জোনের সিনিয়র সহকারী কমিশনার (এসি) মুহাম্মদ কামাল হোসেন যুগান্তরকে বলেন, সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজরা শ্রেণীভেদে টার্গেট করে থাকে। বিশেষ করে নিরীহ ব্যবসায়ী, সরকারি ও বেসরকারি চাকরিজীবীরাই তাদের টার্গেট বেশি। গোয়েন্দা পুলিশের একটি সূত্র জানায়, রাজধানীর ৮টি ক্রাইম জোনে যত চাঁদা দাবি ও চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটে এর মধ্যে মিরপুর অঞ্চলেই ঘটে ৭০ ভাগ ঘটনা। পলাতক ও আত্মগোপনে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নামেই বেশিরভাগ সময় চাঁদা দাবির ঘটনাগুলো ঘটছে। এসব ঘটনায় জিডি ও মামলাও হয়েছে। কিন্তু অভিযুক্তরা ধরা পড়ছে তুলনামূলক কম। ফলে অভিযোগকারীর শংকা থেকেই যাচ্ছে।  

No comments:

Post a Comment