Sunday, April 26, 2015

নলকূপের পানিও আর নিরাপদ নয়:কালের কন্ঠ

নলকূপের পানি পান করলে ডায়রিয়াসহ পানিবাহিত রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে- এমন বিজ্ঞাপন নব্বই দশকের গোড়ার দিকে বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ সরকারি গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচার করা হতো। তাতে কাজও হয়েছে। মানুষ উদ্বুদ্ধ হয়ে ঘরে ঘরে নলকূপ বসিয়েছে। ব্যক্তি উদ্যোগের পাশাপাশি এ ক্ষেত্রে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতাও ছিল। তবে দুই যুগ পরে এসে এখন জানা যাচ্ছে, নলকূপের পানিও আর নিরাপদ নেই। এতে ঢুকে পড়েছে পানিবাহিত রোগের উপাদান ব্যাকটে
রিয়া, সেটাও ভয়াবহ মাত্রায়। দেশের ১০০টি নলকূপের মধ্যে ৪০টির পানিতেই ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ১৯ শতাংশ নলকূপের পানিতে মাত্রাতিরিক্ত ব্যাকটেরিয়া রয়েছে। সম্প্রতি এনজিও ফোরাম ফর পাবলিক হেলথ পরিচালিত ওয়াটার কোয়ালিটি টেস্টিং ল্যাবরেটরির (ডাব্লিউকিউটিএল) পরীক্ষায় এমন ফল মিলেছে। ওই গবেষণায় বাংলাদেশের অধিকাংশ নলকূপের পানিতে ব্যাকটেরিয়া ছাড়াও ম্যাঙ্গানিজ নামের একটি ভারী ধাতুর উপস্থিতিও পাওয়া গেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ভারী এ ধাতুটি স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। ম্যাঙ্গানিজের কারণে পারকিনসন্স, অকাল গর্ভপাত, ক্যান্সার, ডায়াবেটিস ছাড়াও মস্তিষ্কের বেশ কিছু রোগ হতে পারে। এ ছাড়া শিশুর মানসিক বিকাশকেও ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে ম্যাঙ্গানিজ। বাংলাদেশে নলকূপের পানিতে এই প্রথম ম্যাঙ্গানিজের উপস্থিতি ধরা পড়ল। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহায়তায় ডাব্লিউকিউটিএল ওই গবেষণা করে। গবেষণা সম্পর্কে জানতে চাইলে এনজিও ফোরামারে নির্বাহী পরিচালক এস এম এ রশীদ কালের কণ্ঠকে বলেন, অস্ট্রেলিয়ার নিউ ক্যাসেল বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেলথ বিভাগের শিক্ষক ড. আবুল হাসনাত মিলটনের নেতৃত্বে দেশের বেশ কিছু গবেষক এবং ডাব্লিউকিউটিএলের গবেষকরা এ গবেষণার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাঁরা দেশের সাত বিভাগের সাতটি থানার নলকূপের পানি পরীক্ষা করেন। এর মধ্যে ৪০ শতাংশ নলকূপের পানিতে ব্যাকটেরিয়ার অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। আর পরীক্ষার আওতাধীন প্রায় সব নলকূপের পানিতে ম্যাঙ্গানিজের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। গবেষকরা ২০০৫ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত দেশের তিন হাজার ৬৫৪টি নলকূপের পানি পরীক্ষা করেন ডাব্লিউকিউটিএলের গবেষণাগারে। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি রাজধানীতে আনুষ্ঠানিকভাবে পরীক্ষার ফল প্রকাশ করেন এনজিও ফোরামের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। এতে জানা যায়, তিন হাজার ৬৫৪টির মধ্যে ৪০ শতাংশ নলকূপের পানিতেই ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি রয়েছে। ১৯ শতাংশ নলকূপের পানিতে ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি রয়েছে মাত্রাতিরিক্ত পর্যায়ে। গবেষণার আওতাধীন অধিকাংশ নলকূপের পানিতে মিলেছে ম্যাঙ্গানিজ। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডাব্লিউকিউটিএল গবেষক এস এম শহীদুল্লাহ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমাদের পরীক্ষায় দেশের ৪০ শতাংশ নলকূপের পানিতে ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি পাওয়া গেছে। সুপেয় পানিতে ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি দেশের মানুষকে ভয়ংকর স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। পানিতে ম্যাঙ্গানিজের উপস্থিতি ধরা পড়ায় সাধারণ মানুষের পক্ষে নিরাপদ পানি পাওয়া অত্যন্ত কঠিন হয়ে গেল।' গবেষকরা বলছেন, মাটির নিচে পানির স্তরে ভারী ধাতুর উপস্থিতির কারণে তা পানের অযোগ্য হয়ে পড়ছে। এ ছাড়া নলকূপের কাছে পায়খানা স্থাপন করার কারণে সেখান থেকেও ব্যাকটেরিয়া সংক্রমিত হয়ে থাকে। নলকূপের মাথা উন্মুক্ত থাকায় অনেক ধরনের ময়লা আবর্জনও পানিতে মিশে ব্যাকটিরিয়ার সংক্রমণ ঘটায়। গবেষকরা বলছেন, দেশে গর্ভবতী নারীর মৃত্যুর মধ্যে অন্তত ১০ শতাংশের মৃত্যুর কারণ পানিবাহিত রোগ। এর মধ্যে অন্যতম হলো হেপাটাইটিস 'ই'। এ ছাড়া ডায়রিয়ার মতো রোগেরও প্রার্দুভাব ঘটে ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে। আর ম্যাঙ্গানিজের কারণে ক্যান্সার, পারকিনসন্সের মতো রোগও হতে পারে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বাংলাদেশে তিন কোটি ২০ লাখ মানুষের নিরাপদ সুপেয় পানির কোনো ব্যবস্থা নেই। এদের একটি বড় অংশই পানিবাহিত রোগে সহজে আক্রান্ত হয়। দেশের মোট রোগবালাইয়ের মধ্যে পানিবাহিত রোগের পরিমাণ ২৪ শতাংশ। এর মধ্যে পানিতে ব্যাকটেরিয়ার কারণে ডায়রিয়া অন্যতম। শুধু ডায়রিয়ায় প্রতিবছর এক লাখ শিশু মারা যায়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পানি ফোটালে ম্যাঙ্গানিজ দূর হবে না। বিকল্প উৎস থেকে পানি পান করার জন্য জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার কথা বলেছেন তাঁরা। যেসব নলকূপে ম্যাঙ্গানিজের অস্তিত্ব ধরা পড়ছে, সেগুলোর পানি পান না করার পরামর্শ দিয়েছেন গবেষকরা। ম্যাঙ্গানিজ আক্রান্ত এলাকার মানুষকে পুকুরের পানি ফুটিয়ে কিংবা বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে কিংবা অন্য কোনো বিকল্প উৎস থেকে পানি পানের পরামর্শ দিয়েছেন তাঁরা।

No comments:

Post a Comment