কেক ও ফুল নিয়ে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে বাসায় ঢুকেন বিআরটিএর এক উপপরিচালক, তাঁর স্ত্রী ও দুই মেয়েকে হাতুড়িপেটা করে বাসায় আগুন ধরিয়ে দিয়েছে এক ব্যক্তি। এই হামলায় গৃহকর্ত্রী কলেজশিক্ষিকা কৃষ্ণা কাবেরী বিশ্বাস (৩৫) প্রাণ হারিয়েছেন। রাজধানীর মোহাম্মদপুরের ইকবাল রোডে গত সোমবার রাতে নৃশংস এ ঘটনা ঘটে। হামলায় আহত বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) প্রকৌশল বিভাগের উপপপরিচালক সিতাংশু শেখর বিশ্
বাস (৪৮), তাঁর দুই মেয়ে শ্রোভনা বিশ্বাস (১৫) ও অদিতিয়া বিশ্বাসকে (৮) মহাখালীর মেট্রোপলিটন মেডিকেল সেন্টারে ভর্তি করা হয়েছে। নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) থাকা সিতাংশু ও অদিতিয়ার অবস্থা গুরুতর বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা। কৃষ্ণা কাবেরী আদাবরে মিশন ইন্টারন্যাশনাল কলেজের সমাজকল্যাণ বিভাগের প্রভাষক ছিলেন। শ্রোভনা মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুলের দশম শ্রেণির বিজ্ঞান বিভাগে ও অদিতিয়া স্থানীয় গ্রিন হেরাল্ড স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে। কৃষ্ণার মৃত্যুর খবর তাঁর স্বামী ও সন্তানেরা জানেন না। সিতাংশুর ঘনিষ্ঠজনেরা জানান, সিতাংশুর পূর্বপরিচিত জহির আহমেদ এ ঘটনা ঘটিয়েছেন। জহির গুলশানের একটি ব্রোকারেজ হাউসের ব্যবস্থাপক। সিতাংশু তাঁর মাধ্যমে শেয়ারবাজারে প্রায় ১৫ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেন। ওই টাকা আত্মসাৎ করতেই জহির পরিকল্পনা অনুযায়ী সপরিবারে সিতাংশুকে হত্যার জন্য হামলা ও গানপাউডার ছিটিয়ে বাসায় আগুন লাগিয়ে দেন। পরে তিনি পালিয়ে যান। মেট্রোপলিটন মেডিকেল সেন্টারে চিকিৎসাধীন শ্রোভনা বিশ্বাস গতকাল মঙ্গলবার প্রথম আলোকে জানায়, সোমবার রাত পৌনে নয়টার দিকে শেয়ার ব্যবসায়ী জহির আহমেদ তাদের বাসায় আসেন। তিনি সঙ্গে কেক, ফুল ও জুস নিয়ে এসে তার বাবাকে জানান, তাঁকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে এসেছেন। তিনি বাবার পূর্বপরিচিত। কয়েক দিন আগে ছিল বাবার জন্মদিন। বাবা একপর্যায়ে মা ও তাদের দুই বোনকেও বসার ঘরে ডেকে নেন। জহির সবার উপস্থিতিতে বাবাকে দিয়ে কেক কাটান। সেই কেক বাবার মুখে তুলে দেন এবং নিজেও খান। জহির এসবের ছবিও তোলেন। জহির বাবাকে জুস খাইয়ে দেন। তাঁর পরনে কালো রঙের কোর্ট, প্যান্ট ও টাই পরা ছিল। তাঁরা কথা শুরু করায় তারা দুই বোন ও মা ভেতরে শোয়ার ঘরে চলে যান। কিছুক্ষণ পর জহির শোয়ার ঘরে এসে বলেন, ‘স্যার পড়ে গেছেন’। এ কথা শুনে তার মা বসার ঘরের দিকে দৌড় দিলে জহির হাতুড়ি দিয়ে পেছন থেকে মায়ের মাথাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাত করেন। জহির সাদা পাউডার ছিটিয়ে দেশলাই জ্বালিয়ে দিলে মায়ের পরনের শাড়িতে আগুন ধরে যায়। শ্রোভনা জানায়, জহির তাকেও হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করতে গেলে সে হাত দিয়ে ঠেকায়। এতে তার বাঁ হাতের একটি আঙুল ভেঙে যায়। পরে জহির তার বোনকে হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করেন। এ সময় সে বোনকে নিয়ে পাশের শোয়ার ঘরে ঢুকে ছিটকিনি লাগিয়ে দেয়। বিষয়টি সে ফোনে স্বজনদের জানায় এবং চিৎকার শুরু করে। এ সময় জহির বাসার মেইন সুইচ বন্ধ করে পালিয়ে যান। জহির পালিয়ে গেছেন, টের পেয়ে সে দরজা খুলে চিৎকার দেয়। এ সময় বাড়ির বিভিন্ন তলার লোকজন ছুটে এসে তাদের আসাদগেটসংলগ্ন কেয়ার হাসপাতালে নিয়ে যায়। তার ধারণা, জুসের সঙ্গে তার বাবাকে নেশাজাতীয় কিছু মিশিয়ে খাওয়ানো হয়েছিল। এতে তিনি প্রায় অচেতন হয়ে পড়লে তাঁর মাথায় হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করা হয়। তারা বাবাকে বসার ঘরের মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখে। পুলিশ জানায়, রাত সোয়া দুইটার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে কৃষ্ণা কাবেরী মারা যান। চিকিৎসকেরা জানান, আগুনে কৃষ্ণার শরীরের ১৬ শতাংশ পুড়ে গেছে। সিতাংশুর পাশের ফ্ল্যাটের বাসিন্দা শিখা আহমেদ জানান, দরজার কড়া নাড়ার শব্দে বেরিয়ে দেখেন করিডরে সিতাংশু ও তাঁর দুই মেয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় কাতরাচ্ছে। বাসা থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে। ভেতরে আগুন জ্বলছে। এ সময় তাঁরা অগ্নিদগ্ধ কৃষ্ণাকে উদ্ধার করেন। বাড়ির বাসিন্দারা বালতিতে করে পানি ঢেলে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন। পরে ফায়ার সার্ভিস এসে আগুন নেভায়। শিখা আহমেদ জানান, তাঁরা মেঝেতে সাদা পাউডার দেখেছেন। আগুনে সিতাংশুর বাসার সোফাসেট, টিভি, ফ্রিজ, আসবাবসহ বিভিন্ন মালামাল পুড়ে গেছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে কৃষ্ণা বিশ্বাসের মামা পিন্টু বিশ্বাস বলেন, তাঁর বাসা ধানমন্ডিতে। রাত ১০টায় সিতাংশুর ফোন পেয়ে ২০ মিনিটের মধ্যে তাঁদের বাসায় যান। অবস্থা খারাপ দেখে তিনি কৃষ্ণাকে প্রথমে মোহাম্মদপুরের দুটি হাসপাতালে নিয়ে যান। অবস্থার অবনতি হওয়ায় তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে নেওয়ার পর তিনি মারা যান। গতকাল দুপুরে ইকবাল রোডে সিতাংশুর বাসা তালাবদ্ধ দেখা যায়। প্রতিবেশীরা জানান, ঘটনার পর পুলিশ বাসাটিতে তালা দিয়েছে। ওই বাড়ির একজন ফ্ল্যাট মালিক জানান, আগতদের নাম-ঠিাকানা খাতায় নিবন্ধন করার নির্দেশ থাকলেও কর্তব্যরত নিরাপত্তাকর্মী তা মানে না। অনেক সময় যোগাযোগ না করে কেউ এলে তাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয়। নিরাপত্তা নিয়ে ফ্ল্যাট মালিক সমিতি বৈঠকে বসবে। জানতে চাইলে বাড়িটির তত্ত্বাবধানকারী আবদুর রহিম জানান, অতিথি এলে ফ্ল্যাটের বাসিন্দাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে পাঠানো হয়। আগুন লাগার খবরে নিরাপত্তাকর্মীর ওপরে যাওয়ার সুযোগে খুনি পালিয়েছে। সিতাংশুর বাসায় কে এসেছিলেন—জানতে চাইলে তিনি বলেন, সোমবার রাতে কর্তব্যরত নিরাপত্তাকর্মী আতিক এ বিষয়ে বলতে পারবেন। পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার প্রথম আলোকে বলেন, চিকিৎসকদের বিধিনিষেধের কারণে আহতদের প্রয়োজনমতো জিজ্ঞাসাবাদ করতে না পারায় তাৎক্ষণিকভাবে হত্যাকাণ্ডের কারণ জানা যায়নি। তবে হত্যাকারী সিতাংশুর পূর্বপরিচিত। এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। তিনি বলেন, আহত ব্যক্তিরা মাথায় হাতুড়ির আঘাত নিয়ে চিকিৎসাধীন। তাঁদের কাছ থেকে হত্যাকারীর নাম-ঠিকানা পাওয়া গেছে। তাঁকে আইনের আওতায় আনার জন্য অভিযান চলছে। পুলিশ কর্মকর্তারা মনে করছেন, হয়তো হামলার সময় কেকের ওপর জ্বলতে থাকা মোমবাতির ওপর পড়ে যান নিহত কৃষ্ণা। এরপর তিনি আগুন থেকে বাঁচতে পুরো ঘরে ছোটাছুটি করতে থাকেন। একসময় সোফায় বসার চেষ্টা করলে তাতেও আগুন ধরে পুরো ঘরে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। কৃষ্ণা কাবেরী হত্যার খবরে গতকাল বিকেলে তাঁর বাসায় যান মিশন ইন্টারন্যাশনাল কলেজের অধ্যক্ষ হুমায়ুন কবিরের নেতৃত্বে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। অধ্যক্ষ বলেন, কৃষ্ণা কাবেরীর মৃত্যুতে তাঁরা শোকার্ত। কৃষ্ণা গলার চিকিৎসার জন্য ছুটিতে ছিলেন।
No comments:
Post a Comment