Thursday, April 30, 2015

সিটিসেলের ১২শ কোটি টাকার ঋণ জালিয়াতি:যুগান্তর

সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এম মোর্শেদ খানের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান প্যাসিফিক বাংলাদেশ টেলিকম লিমিটেডের মোবাইল অপারেটর কোম্পানি সিটিসেলের প্রায় ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার ঋণ জালিয়াতির তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকার ব্যাংক গ্যারান্টি এবং বাকি ২০০ কোটি টাকা সরাসরি বা পরোক্ষ ঋণ। ব্যাংকের ওপর অনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে বিধিবহির্ভূতভাবে চারটি ব্যাংক থেকে নেয়া হয়েছে এই গ্যারান্টি। এর বিপরীতে বিভিন্
ন ব্যাংক থেকে নেয়া হয়েছে ঋণ। কিন্তু শর্ত অনুযায়ী সিটিসেল ঋণ পরিশোধ না করায় গ্যারান্টি দাতা ব্যাংক ও ঋণ দাতা ব্যাংকগুলো আটকে গেছে। ইতিমধ্যে তাদের সিংহভাগ ঋণ খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। গ্যারান্টি দাতা ব্যাংকও টাকা পরিশোধ না করায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকে নালিশ করেছে কয়েকটি ব্যাংক। এর পরিপ্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে গ্যারান্টি দাতা কয়েকটি ব্যাংকের ওপর। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপে দুটি ব্যাংক সিটিসেলের নামে ফোর্সলোন (বাধ্যতামূলক ঋণ) সৃষ্টি করে দেনা শোধ করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন ও সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোতে অনুসন্ধান করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। সূত্র জানায়, সিটিসেলকে প্রায় এক হাজার কোটি টাকার ব্যাংক গ্যারান্টি দিয়েছে বেসরকারি খাতের এবি, সিটি, ন্যাশনাল ও ইস্টার্ন ব্যাংক। এর বিপরীতে সিটিসেল বিভিন্ন ব্যাংক থেকে সমপরিমাণ ঋণ নিয়েছে। ব্যাংক গ্যারান্টির শর্ত অনুযায়ী সিটিসেল ওই ঋণ শোধে ব্যর্থ হলে গ্যারান্টি দাতা ব্যাংক তা পরিশোধ করতে বাধ্য। ব্যবসায়িক মন্দার কারণে ২০১৩ সালের নেয়া এসব ঋণ সিটিসেল নিয়মিত শোধ করতে পারেনি। ফলে ঋণগুলো খেলাপিতে পরিণত হচ্ছে। এদিকে সিটিসেলের শেয়ারের একটি বড় অংশ তারা রাশিয়ান কোম্পানি মালটিনেটের কাছে বিক্রি করবে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জানিয়েছে। শেয়ার বিক্রির টাকায় তারা ব্যাংকের ঋণ শোধ করে দেয়ার অঙ্গীকারও করেছে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সিটিসেলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মেহবুব চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, শেয়ার বিক্রির জন্য সবার আগে বিটিআরসির অনুমোদন দরকার। তবে বিষয়টি আমি এখনও জানি না। আমাদের শুধু এ ব্যাপারে কাগজপত্র তৈরি করতে বলা হয়েছে। আমরা সেটি করছি। ঋণের ব্যাপারে তিনি বলেন, আমরা ঋণ নিয়েছি, এর টাকা পরিশোধ করে দেব। ঋণ খেলাপি হওয়ার বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা বেশ কিছু ঋণ পুনঃতফসিল করে নিয়েছি। কিছু পুনঃতফসিল হয়নি, তারও কারণ আছে। দু-একটি ব্যাংকের সঙ্গে পুনঃতফসিল নিয়ে আমাদের দ্বিমত রয়েছে। তারা একভাবে বলছে, আমরা অন্যভাবে বলছি। আশা করি, ওই ব্যাংকগুলোর সঙ্গে আমাদের সমঝোতা হবে। তবে ঋণ পরিশোধ করা হবে। সূত্র জানায়, সিটিসেলকে ব্যাংক গ্যারান্টি দেয়ার সময় কোম্পানির প্রকৃত তথ্য গোপন করা হয়েছে। সিটিসেল বর্তমানে একটি লোকসানি কোম্পানি। প্রতিষ্ঠানের কাছে সরকারের পাওনা রয়েছে প্রায় ৭০০ কোটি টাকা। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ রেগুলেটরি কমিশন (বিটিআরসি) ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এসব টাকা পাবে। বারবার তাগাদা দেয়া সত্ত্বেও তারা এ টাকা পরিশোধ করছে না। এ ছাড়া কোম্পানির গ্রাহক সংখ্যা আশংকাজনকভাবে কমে যাওয়ায় তাদের আয়ও কমে গেছে। ফলে প্রতিষ্ঠানটি বড় ধরনের আর্থিক সংকট মোকাবেলা করছে। ঋণ ও ব্যাংক গ্যারান্টি নেয়ার সময় এসব তথ্য ব্যাংকগুলোকে জানানো হয়নি। যদিও ঋণের বিপরীতে সিটিসেলের সম্পদ, মহাখালীর প্যাসিফিক ভবনের কিছু ফ্লোর বন্ধক ও মোর্শেদ খানের ব্যক্তিগত গ্যারান্টি দেয়া হয়েছে। ঋণ নেয়ার সময় কোম্পানি যে পরিমাণে আয়ের কথা উল্লেখ করেছে প্রকৃত আয় তার চেয়ে অনেক কম। ফলে কোম্পানিটি এখন নিয়মিত ঋণ শোধ করতে পারছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক তদন্তে সিটিসেলের সার্বিক পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। তারা মনে করে, বর্তমানে কোম্পানিটির ঋণ শোধের সক্ষমতা নেই। যে কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে তাদের ঋণ পরিস্থিতি এবং শেয়ার বিক্রির বিষয়টি কঠোরভাবে তদারকি করা হচ্ছে। ইতিমধ্যেই তাদের দেয়া ব্যাংক গ্যারান্টির মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। ফলে ওইসব ঋণ পরিশোধ না হওয়ায় এগুলো খেলাপি হয়ে যাচ্ছে। এ কারণে খেলাপি হওয়া ঠেকাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাংক গ্যারান্টির মেয়াদ আগামী ১৫ জুন পর্যন্ত বাড়িয়েছে। এ বিষয়ে সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ব্যাংক গ্যারান্টি দাতা চার ব্যাংকের কাছে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে, সিটিসেলের মালিকানা রাশিয়ান কোম্পানির কাছে বিক্রি করা সম্ভব না হলে এটির সব ধরনের ঋণের (প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ) বিপরীতে পর্যাপ্ত জামানত নিতে হবে। কেননা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সিটিসেলের ব্যাংক ঋণের বিপরীতে যথেষ্ট জামানত নেই। কোম্পানিটির সমুদয় দেশী-বিদেশী শেয়ার রাশিয়ান কোম্পানি মালটিনেটের কাছে বিক্রির প্রক্রিয়া কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জানাতে হবে। ঋণের বিপরীতে সিটিসেলের সব পরিচালকের ব্যক্তিগত গ্যারান্টি নিতে হবে। বর্তমানে এই ধরনের গ্যারান্টি নেই। ফোর্সলোন সৃষ্টি হওয়ার পর আরোপিত সুদ আদায় না হওয়া পর্যন্ত তা আয় খাতে নিতে পারবে না। সূত্র জানায়, সিটি ব্যাংকের গ্যারান্টিতে ব্র্যাক ব্যাংক সিটিসেলকে ১৪৫ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে। শর্ত অনুযায়ী সিটিসেল ওই ঋণ শোধ করতে ব্যর্থ হলে তারা সিটি ব্যাংকের কাছে ঋণ শোধের দাবি করে। এতে সিটি ব্যাংক গড়িমসি করলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে নালিশ করে ব্র্যাক ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঘটনার তদন্ত করে সিটি ব্যাংককে ঋণ শোধের নির্দেশ দেয়। এরপর তারা সিটিসেলের বিরুদ্ধে ফোর্সলোন সৃষ্টি করে ওই ঋণ শোধ করে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, সিটিসেলের ঋণের মধ্যে এবি ব্যাংক থেকেই সবচেয়ে বেশি ঋণ নেয়া হয়েছে। ব্যাংক গ্যারান্টি ও নগদ ঋণ মিলে এর পরিমাণ প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। এ ঋণ আদায় না হওয়ায় ব্যাংকটি সংকটে পড়েছে। এছাড়া ন্যাশনাল ব্যাংকের ১৬০ কোটি, ঢাকা ব্যাংকের ১০৪ কোটি, সিটি ব্যাংকের ১৪৫ কোটি ও ইস্টার্ন ব্যাংকের ১১০ কোটি টাকা। এছাড়া মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, আইএফআইসি ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক ও ইন্টারন্যাশানাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স কোম্পানির কাছেও তাদের ঋণ রয়েছে।  

No comments:

Post a Comment