Tuesday, April 21, 2015

ঘটনাস্থলে নির্বিকার ছিলেন পুলিশের এক পরিদর্শক:কালের কন্ঠ

পহেলা বৈশাখের সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় নারী লাঞ্ছনার সময় ঘটনাস্থলের কাছেই দায়িত্ব পালন করছিলেন শাহবাগ থানার এক পরিদর্শক। ঘটনার সময় তিনি ছিলেন নির্বিকার। ঘটনার পরও তিনিসহ সেখানে দায়িত্বরত পুলিশ কর্মকর্তারা কোনো লাঞ্ছিত নারীর খোঁজ করেননি। লাঞ্ছিত নারীদের রক্ষার চেষ্টাকারী ছাত্র ইউনিয়নের কয়েক নেতা ও প্রত্যক্ষদর্শীরা সেই ন্যক্কারজনক ঘটনার বর্ণনা দিলেও তাৎক্ষণিক কোনো ব্যবস্থাই নেননি ওই পুলিশ
কর্মকর্তারা। ঘটনাটিকে 'হালকাভাবে' নিয়ে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন তাঁরা। গণমাধ্যমে ঘটনা প্রচার হওয়ার পর তোলপাড় শুরু হলে পরদিন 'শ্লীলতাহানি'র মামলা করে পুলিশ। তবে পুলিশের উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠনের আগে নিপীড়নকারী ও ভুক্তভোগী শনাক্তকরণের কোনো চেষ্টাই করেনি শাহবাগ থানার পুলিশ। প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। জানা যায়, ঘটনার সময় শাহবাগ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) এ কে সাইদুল হক ভুঁইয়া ঘটনাস্থলের কাছেই দায়িত্ব পালন করছিলেন; কিন্তু তিনি ছিলেন নির্বিকার। পরে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা হয়েও তিনি ভুক্তভোগীদের সন্ধানের উদ্যোগ নেননি। সাইদুল হক ভুঁইয়াসহ সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা গতকাল সোমবারও বলেন, তাঁরা এখনো কোনো ভুক্তভোগীকে পাচ্ছেন না। এদিকে ঘটনা তদন্তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটি গঠন করে। গতকাল পর্যন্ত ওই কমিটিও কোনো তথ্য পায়নি বলে জানান দায়িত্বশীলরা। অন্যদিকে ঘটনার প্রতিবাদে ও জড়িতদের শাস্তির দাবিতে গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলা থেকে কার্জন হল পর্যন্ত মানবপ্রাচীর তৈরি করা হয় ছাত্র ইউনিয়নের উদ্যোগে। সাধারণ শিক্ষার্থীরাও এতে অংশ নেন। হাতে হাত রেখে দাঁড়িয়ে তাঁরা অবিলম্বে জড়িতদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনার দাবি জানান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতিও ঘটনায় জড়িতদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়ে মানববন্ধন করেছে। এ ছাড়া রাজু ভাস্কর্যের পেছন দিকে ঘটনাস্থলে সাদা কাপড়ে প্রতিবাদী চিত্রাঙ্কন করেছেন চারুকলা অনুষদের শিক্ষার্থীরা। পুলিশের মামলায় কয়েকজন সাক্ষী ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছ থেকে ঘটনা জানার কথা বলা হলেও 'শ্লীলতাহানি'র দণ্ডনীয় অপরাধ হয়েছে বলে স্বীকার করা হয়। এতে দাবি করা হয়, পুলিশ ভুক্তভোগীকে খুঁজে পায়নি। তবে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, পুলিশের দুই কনস্টেবল আক্রমণের শিকার এক নারীকে উদ্ধারে সহায়তা করেন। ঘটনাস্থলে ও আশপাশে শাহবাগ থানার কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তাসহ সদস্যরা ছিলেন। তাঁরা পরিস্থিতি শান্ত করার চেষ্টা করলেও ভুক্তভোগী নারীদের ব্যাপারে কোনো খোঁজ নেননি। পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে, রাজু ভাস্কর্যের পূর্ব পাশে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ফটকে বটতলার কাছে টি-শার্ট পরে দায়িত্বরত ছিলেন শাহবাগ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) এ কে সাইদুল হক ভুঁইয়া। রাজু ভাস্কর্যের পূর্ব কোণে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পাশে দায়িত্বরত ছিলেন এসআই আশরাফুল আলম। তিনি পরে ঘটনাস্থলে গেলে ছাত্র ইউনিয়নের নেতারা দুই বখাটেকে ধরে তাঁর কাছে দেন। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পরিদর্শক সাইদুল হকের কাছে উদ্ধারকারীরা সহায়তা চাইলেও তিনি ছিলেন নির্বিকার। ভিডিও ফুটেজেও সাইদুলের অবহেলার চিত্র : পুলিশ সূত্র মতে, ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণে সাইদুলের উপস্থিতি এবং কর্তব্যে অবহেলার চিত্র ধরা পড়েছে। দুই দিন ধরে প্রত্যক্ষদর্শীরা পুলিশের তদন্ত কমিটির কাছে যেসব বর্ণনা দিয়েছে, এতেও পুুলিশের নিষ্ক্রিয়তার প্রমাণ রয়েছে। ঘটনার পর দায়িত্বশীল পুলিশ কর্মকর্তারা ভালোভাবে খোঁজই নেননি। দেখেননি কী ঘটনা ঘটেছে। খোঁজ নেননি ভুক্তভোগীদেরও। ঘটনা জানাজানি হওয়ার তিন দিন পর আশরাফুল আলমকে প্রত্যাহার করা হলেও সাইদুল ইসলাম আছেন বহাল তবিয়তে। শুধু তা-ই নয়, চাঞ্চল্যকর ওই ঘটনার মামলাটির তদন্তভারও দেওয়া হয়েছে সাইদুলকে। পুলিশ সূত্রে জানা যায়, গত ১৫ এপ্রিল রাতে শাহবাগ থানার অপারেশন অফিসার আবুল কালাম আজাদ বাদী হয়ে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন-২০০০ (সংশোধিত ২০০৩) আইনের ১০/৩০ ধারায় একটি মামলা করেন। 'শ্লীলতাহানি ও সহায়তার অপরাধে' এই মামলার এজাহারটি দাখিল করা হয়। সেখানে বাদী বলেন, 'সন্ধ্যায় ১৮টা ৩০ মিনিট (৬টা ৩০ মিনিট) থেকে ১৯টার (৭টা) মধ্যে যেকোনো সময় বিভিন্ন বয়সের কয়েক হাজার নারী-পুরুষের উপচেপড়া ভিড়ের মধ্যে বাংলা নববর্ষে আনন্দ হৈ-হল্লা ও আনন্দ বিনোদনের ফাঁকে অজ্ঞাতনামা উচ্ছৃঙ্খল কতিপয় যুবক মেয়েদের শ্লীলতাহানি করে মর্মে বিভিন্ন মাধ্যম ও জনৈক লিটন নন্দী, অমিত দে, তুহিন কান্তি দাস এবং প্রক্টর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্যারের মাধ্যমে সংবাদপ্রাপ্ত হই।' বাদী অভিযোগে বলেন, 'তাৎক্ষণিক টিএসসি এলাকায় কর্তব্যরত সকল অফিসার ও ফোর্সের সহায়তায় ঘটনার সত্যতা যাচাইকল্পে ভিকটিমকে সন্ধানের চেষ্টা করি। শ্লীলতাহানির শিকার ভিকটিমের নাম-ঠিকানা সংগ্রহের চেষ্টা করিয়া কাহারও সন্ধান না পাইয়া বা এই সংক্রান্ত ঘটনার শিকার কেহ অত্র থানায় অভিযোগ দায়ের না করায় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সহিত আলোচনা করিয়া উল্লেখিত ঘটনার বিষয় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন-২০০০ (সংশোধিত ২০০৩) আইনের ১০/৩০ ধারায় দণ্ডযোগ্য অপরাধ প্রতীয়মান হওয়ায় আমি নিজে বাদী হইয়া অত্র এজাহার দায়ের করিলাম।' পুলিশের একাধিক সূত্রে জানা যায়, পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান বিকেলে সাড়ে ৫টার মধ্যেই শেষ করার আহ্বান জানিয়েছিলেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীসহ দায়িত্বশীলরা। এ কারণে নিরাপত্তা সতর্কতা ওই সময় পর্যন্তই বেশি কার্যকর রাখে পুলিশ। এরপর শাহবাগ, রমনাসহ জনাকীর্ণ এলাকায় পুলিশ থাকলেও ছিল ঢিলেঢালা ভাব। সন্ধ্যা ৬টার দিকে সিসিটিভি ক্যামেরার মনিটরিং ব্যবস্থাও শিথিল ছিল। আর এ কারণেই আধাঘণ্টার মধ্যে ঘটে যাওয়া বেশ কয়েকটি ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এদিকে দায়িত্বরত কয়েক পুলিশ সদস্য জানান, এবারের নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনায়ও ঘাটতি ছিল। প্রতিবছর পহেলা বৈশাখের 'সন্ধিক্ষণে' মাঠ পর্যায়ে কর্মরত পুলিশ সদস্যদের নিয়ে সিকিউরিটি ম্যানেজমেন্টের বৈঠক হয়। সেখানে প্রজেক্টরের মাধ্যমে বিষয়গুলো বুঝিয়ে দেওয়া হয় সবাইকে। এবার এমনটি হয়নি বলে জানান কয়েকজন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি লিটন নন্দী কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এখন তদন্ত হচ্ছে। তবে ঘটনার পর কেউ ওই নারীর ব্যাপারে জানতে চায়নি। আমি আক্রমণের শিকার হয়েছিলাম। এমন পরিস্থিতি ছিল যে আমরা মেয়েটার নাম-ঠিকানা জানতে পারিনি। ওখানে তো অনেক ঘটনা ঘটেছিল, পুলিশ একটি মেয়েরও বক্তব্য পেল না? তারা তখন ভিকটিম খোঁজেনি।' বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক তুহিন কান্তি দাস বলেন, 'আমরা এসআই আশরাফকে দেখেছি। সিভিলে গেঞ্জি পরা একজন অফিসারও দাঁড়িয়ে ছিলেন। আশরাফ এগিয়ে গেলে দুজনকে তাঁর কাছে দেওয়া হয়। তাঁরা সবাই ওখানকার ভয়াবহ অবস্থা দেখেছেন। এত বড় একটা গ্যাদারিং না দেখার কারণ নেই। তবে তাঁদের কেউ ভিকটিম খোঁজেননি। তোলপাড় হওয়ার আগে তাঁরা আমাদের কাছেও এ ব্যাপারে জানতে চাননি।' তুহিন আরো বলেন, 'পুলিশের তদন্ত কমিটি এখন আমাদের সঙ্গে কথা বলছে। তবে আমরা তো ভিকটিমের ঠিকানা তাঁদের বলতে পারছি না। এটা বের করা তাঁদের কাজ। তবে কী হয়েছে ওখানে এবং কিভাবে হয়েছে এর পুরো বর্ণনাই আমরা তদন্ত কমিটিকে দিয়েছি।' নিপীড়নের শিকার এক নারী রোকেয়া হলে গিয়ে শাড়ি পরেন বলে জানা গেছে। ওই সময় তাঁর সঙ্গে কথা হয় ছাত্রলীগের ওই হল শাখার সাধারণ সম্পাদক ইশাত কাশফিয়া ইরার। তিনি গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমিও নারীর পরিচয় নিইনি। আমার কাছে পুলিশ এ ব্যাপারে কিছু জানতে চায়নি। আমি সব প্রভোস্ট ম্যাডামকে বলেছি। পুলিশ হয়তো এখন ওনার সঙ্গে যোগাযোগ করছে।' দায়িত্বে অবহেলা এবং ভুক্তভোগীকে না খোঁজার অভিযোগ প্রসঙ্গে পরিদর্শক সাইদুল হক ভুঁইয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, 'শুধু আমি না, আরো ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আশপাশে ছিলেন। আমরা তো ঘটনার কিছু টের পাইনি। কোনো ভিকটিমকেও পাইনি। তখনো খুঁজেছি, এখনো খুঁজছি। বিজ্ঞপ্তি দিয়েও তো পাওয়া যাচ্ছে না।' উত্তাল ক্যাম্পাস : ছাত্র ইউনিয়নের পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী গতকাল সকাল থেকেই অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে জড়ো হতে থাকেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এর সঙ্গে যুক্ত হয় উদীচী, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদসহ সাধারণ মানুষও। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগে ক্লাস বন্ধ করে মানববন্ধন কর্মসূচিতে অংশ নেন শিক্ষার্থীরা। কলা, সামাজিক ও ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের শিক্ষার্থীরা অপরাজেয় বাংলা, কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি ও টিএসসির আশপাশে এবং বিজ্ঞান অনুষদের শিক্ষার্থীরা কেন্দ্রীয় খেলার মাঠ, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার হয়ে টিএসসিতে মানবপ্রাচীরে মিলিত হন। কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে ছাত্র ইউনিয়নের সাহসী নেতা লিটন নন্দী বলেন, 'ঘটনায় জড়িতদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে হবে। দায়িত্বে অবহেলার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরকে অপসারণ করতে হবে। প্রক্টরের অপসারণ ও জড়িতরা গ্রেপ্তার না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।' সকাল সাড়ে ১১টায় অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে মানববন্ধন করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি। মানববন্ধনে শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, 'বাঙালির একটি সর্বজনীন অনুষ্ঠানকে পরিকল্পিতভাবে বাধাগ্রস্ত করে নারীর ওপর নির্যাতন চালানো হয়েছে। যারা এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত তাদের অবিলম্বে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে হবে।' এ ছাড়া দুপুর দেড়টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিকবিজ্ঞান অনুষদ ভবনের সামনে 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাধারণ শিক্ষার্থী' ব্যানারে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়েছে। তথ্য পাচ্ছে না বিশ্ববিদ্যালয়ের তদন্ত কমিটি : জানা গেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটিও কারো কাছ থেকে কোনো তথ্য পাচ্ছে না। কমিটির প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক নাসরিন আহমাদ গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, 'কমিটি কাজ শুরু করেছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য, ছবি ও সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। কিন্তু কোনো শিক্ষার্থী বা কারো কাছ থেকে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না।' এদিকে দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে পদত্যাগ দাবি প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর এম আমজাদ আলী কালের কণ্ঠকে বলেন, 'শিক্ষার্থীরা দাবি করতেই পারে। তদন্ত চলছে। তদন্তে দায়িত্বে অবহেলা প্রমাণিত হলে প্রশাসন সিদ্ধান্ত নেবে।' তিনি দাবি করেন, ঘটনার পর তিনি শাহবাগ থানার ওসিকে ঘটনাটি জানিয়েছেন।

No comments:

Post a Comment