প্রায় ৪০০ বছরের প্রাচীন শহর ঢাকায় রয়েছে নানা পুঞ্জীভূত সমস্যা। রাজধানী ঢাকার গোড়াপত্তন বুড়িগঙ্গার তীরে হলেও সময়ের চাহিদায় বেড়েছে এর পরিধি। সেই সঙ্গে বেড়েছে নাগরিক ভোগান্তি। প্রায় দুই কোটি মানুষের এ শহরে দীর্ঘ সময় নির্বাচিত মেয়র না থাকায় এ সমস্যা এখন অসহনীয়। এ জন্য একদিকে যেমন আমলাতান্ত্রিক জটিলতাকে দায়ী করা হয়, অন্যদিকে রয়েছে দক্ষ-বিচক্ষণ মেয়রের অভাব। এরই মধ্যে সেবার মান বৃদ্ধি করতে ২০১১ সালের ২৯
নভেম্বর বিভক্ত করা হয়েছে সিটি করপোরেশন। এমন অবস্থায় নির্বাচন কমিশন ২৮ এপ্রিল দুই সিটির ভোটগ্রহণের দিন ঠিক করেছে। সব কিছু ঠিক থাকলে এ নির্বাচনের মাধ্যমে নানা সমস্যায় জর্জরিত এ মহানগরীর দায়িত্ব নেবেন দুই মেয়র। কালের কণ্ঠের অনুসন্ধানে দেখা যায়, নির্বাচিত হয়েই দুই মেয়রকে মুখোমুখি হতে হবে কমপক্ষে ৯টি চ্যালেঞ্জের। এগুলো হলো- নগর সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন, আর্থিক সংকট কাটানো, লুটপাট রোধ, কমন ইউটিলিটি টানেল নির্মাণ, দুঃসহ যানজট নিরসন, রাস্তায় পড়ে থাকা সাড়ে ৬০০ ময়লার কনটেইনারের গতি করা, ভৌত অবকাঠামো ঠিক করা, ৫৭টি খেলার মাঠ ও পার্কের উন্নয়ন ও ১৭টি দখলমুক্ত করা এবং নগরবাসীকে মশা আর মাদকের অভিশাপ থেকে মুক্তি। নগর সরকার সময়ের দাবি : সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে নগর পরিকল্পনাবিদ থেকে শুরু করে মাঠপর্যায়ের ভোটার পর্যন্ত জোরালো দাবি উঠেছে নগর সরকার ব্যবস্থার। সেবার মান বাড়ানো আর ভোটারের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে মেয়র পদপ্রার্থীরাও দিচ্ছেন নগর সরকারের প্রতিশ্রুতি। নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, একটি আদর্শ নগরী করতে হলে নগর সরকার ছাড়া সম্ভব নয়। বর্তমানে বিভিন্ন নাগরিক সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের আইনি ভিত্তির মাধ্যমে নগর সুশাসন নিশ্চিতকরণ বিষয়টি স্পষ্ট নয়। বর্তমানে প্রচলিত স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন, ২০০৯-এ নগর সুশাসন বিষয়টির গুরুত্ব পরিষ্কারভাবে পায়নি। নগর সরকার ব্যবস্থার ব্যাপারে ১৯৯৪ সালে মেয়র মোহাম্মদ হানিফ, ২০০২ সালে সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী উদ্যোগ নিলেও তা কার্যকর হয়নি। এ ব্যাপারে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়র পদপ্রার্থী আনিসুল হক বলেন, 'আমি নির্বাচিত হতে পারলে বিশ্বের উন্নত শহরের মতো আমরা নগর সরকার গঠনে সচেষ্ট হব। কারণ নগর সরকার ছাড়া পুরো সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।' বিশ্বের উন্নত শহরগুলোতে সিটি সেবা সার্ভিস একটি সংস্থার অধীনে থাকে। সেখানে পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস, টেলিফোন, পরিবেশ, নগর উন্নয়ন, সড়ক ও জনপথ, পুলিশ প্রশাসন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পরিবহনব্যবস্থা ও আবাসনসহ সব কিছুর নিয়ন্ত্রণ থাকে সিটি করপোরেশনের আওতায়। আর এসব কিছুই সম্ভব হয় নগর সরকার ব্যবস্থার ফলে। এ ক্ষেত্রে নগর সরকারের প্রধানকে উপপ্রধানমন্ত্রী বা পূর্ণ মন্ত্রীর পদমর্যাদা দিতে হয়। কেননা, প্রায় ৫৪টি সরকারি দপ্তরের ২০টির অধিক মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয়কের কাজ করবেন নগর সরকারের প্রধান। নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. গোলাম মরতুজা বলেন, ঢাকাবাসীর সেবা না পাওয়ার মূলে রয়েছে প্রশাসনিক ও ব্যবস্থাপনার জটিলতা, অনভিজ্ঞ, অযোগ্য, দুর্নীতি, রাজনৈতিক প্রভাব, সচেতনতার অভাব ও অপর্যাপ্ত অর্থ। নগর সুশাসন দ্বারা নগরে টেকসই অর্থনীতিসহ নাগরিক সুযোগ-সুবিধা ও সেবা প্রদান, নগর দারিদ্র্য মোচন সম্ভব। সব কিছুই সম্ভব, যদি নগর সরকার ব্যবস্থা তৈরি হয়। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন, বর্তমানে ঢাকায় ৫৪টি সরকারি প্রতিষ্ঠান নগর সেবা প্রদানের কাজে নিয়োজিত। সংস্থাগুলো ২০টি মন্ত্রণালয় দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কাজ করছে। সেন্টার ফর আরবান স্টাডিজ, প্রশিকা, টিআইবিসহ বেশ কিছু সংস্থার জরিপে দেখা গেছে, সিটি করপোরেশন, ডেসা, ঢাকা ওয়াসা ও ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশসহ নগর সেবায় নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানগুলোর সেবার মান নিয়ে খুবই অসন্তোষ ও হতাশা রয়েছে। সমন্বয়, মূল্যায়ন ও মনিটরিং কাজে কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠান নিয়োজিত নেই। ফলে এসব প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে জনমনে অনেক প্রশ্ন আছে। সব ধরনের নগর সেবাদানকারী সংস্থার সমন্বয় নগর সরকারের প্রধান অর্থাৎ মেয়রের হাতে থাকতে হবে। কমন ইউটিলিটি টানেল : ঢাকার প্রায় এক হাজার ৮০০ বর্গমাইলেই সারা বছর কোনো কোনো সরকারি সংস্থা খোঁড়াখুঁড়ি করে থাকে। এ নিয়ে দেশের সব ধরনের গণমাধ্যমেও নগরবাসীর ব্যাপক ভোগান্তির চিত্র তুলে ধরা হয়। তাই নগরবাসীর দুর্ভোগ কমাতে উদ্যোগী হয়েছে সরকার। খোঁড়াখুঁড়ির ফলে সৃষ্ট দুর্ভোগ থেকে নগরবাসীর স্থায়ী মুক্তির জন্য কমন ইউটিলিটি টানেল (সেবা সংস্থাগুলোর লাইন সমন্বিতভাবে স্থাপন) নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু এ বিষয়টি সিটি মেয়রের অধীনে থাকার কথা থাকলেও এ লক্ষ্যে পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য গত ১৪ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে আন্তমন্ত্রণালয় সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচালক মো. আশরাফ উদ্দিনের সই করা এক চিঠিতে কমন ইউটিলিটি টানেল নির্মাণের একটি সংক্ষিপ্ত চিত্র তুলে ধরা হয়েছে, যার ফলে এখানেও কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতাকেই বাড়ানো হচ্ছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। এ উদ্যোগের ফলে বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস, টেলিফোন লাইন, স্যুয়ারেজ ও কেব্ল্ চ্যানেলের লাইন মহানগরীর রাস্তার নিচে পরিকল্পনাহীনভাবে স্থাপন করা হবে না। গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎসহ নগরবাসীর ইউটিলিটি সার্ভিসগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, সরকারের আর্থিক অপচয় হ্রাস, সড়ক অবকাঠামোর স্থায়িত্ব বৃদ্ধি ও জনদুর্ভোগ কমানোর লক্ষ্যে আধুনিক ও উপযোগী কমন ইউটিলিটি টানেল নির্মাণ এখন সময়ের দাবি। কিন্তু তা হতে হবে মেয়রের অধীনে। তবে এ টানেলের জন্য এলাইনমেন্ট ও সাইজ নির্ধারণ, ডিজাইন ও স্পেসিফিকেশন প্রণয়নে পরামর্শক নিয়োগের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকার। ভয়াবহ আর্থিক সংকট : ডিসিসি ভাগ হওয়ার পর থেকে সিটি করপোরেশনে দেখা দিয়েছে ভয়াবহ আর্থিক সংকট। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়মিত বেতন দিতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের। বিশেষ করে ঈদ ও পূজার সময় বেতন আর বোনাস নিয়ে দেখা দেয় সমস্যা। এ অবস্থায় যিনি মেয়র নির্বাচিত হবেন, সামনে আর্থিক এ সংকট কাটানো হবে তাঁর আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ। এ ব্যাপারে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়র পদপ্রার্থী সাঈদ খোকন বলেন, 'আর্থিক সংকটের বিষয়টি আমার জানা রয়েছে। আমি নির্বাচিত হতে পারলে সব বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে রাজস্ব আয় বৃদ্ধি করে এ সংকট থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করব।' জানা যায়, ঢাকা সিটি করপোরেশন দুই ভাগ হওয়ার পর থেকেই চরম অর্থ সংকটে ভুগছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। দিন যত যাচ্ছে এ সংকট ততই বাড়ছে। মাসের পর মাস ধরে বিভিন্ন উন্নয়ন কাজ করা ঠিকাদাররা পাচ্ছেন না তাঁদের পাওনা টাকা। আবার মাস ঘুরে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন দেওয়ার সময়ও তৈরি হয় এ সংকট। এ নিয়ে সাধারণ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে রয়েছে চরম হতাশা। এ পর্যন্ত কর্তৃপক্ষের কাছে ডিএসসিসির সব ঠিকাদারের প্রায় ১৭০ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে বলে জানা যায়। পাওনা টাকা আদায়ের জন্য গত বছরের ২৪ জুলাই নগর ভবনের সামনে বিক্ষুব্ধ ঠিকাদাররা ব্যাপক বিক্ষোভ সমাবেশ করেন। ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আনসার আলী খান সংকটের কথা স্বীকার করে বলেন, আমরা ইতিমধ্যে অনেক টাকা দেনা শোধ করেছি। আশা করছি এ সংকট কাটিয়ে ওঠা যাবে।' লুটপাত ও দুর্নীতির মহোৎসব : সরকারদলীয় লোকজন আর কিছু কর্মকর্তার লাগামহীন দুর্নীতির কবলে পড়েছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। টেন্ডার সন্ত্রাস, নিয়োগ বাণিজ্য, অবৈধ বিলবোর্ড বাণিজ্যের মাধ্যমে লুটপাট করছে সংশ্লিষ্টরা। কিন্তু সব কিছু ছাড়িয়ে গেছে সিটি করপোরেশনের মার্কেট দখল। আবার কর্মকর্তা-কর্মচারী আর দখলবাজদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে রাস্তা পর্যন্ত বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। এ অবস্থায় একজন নির্বাচিত মেয়র যে দলেরই হোক তাঁর পক্ষে দলীয় নেতা-কর্মী আর দলবাজ কর্মকর্তাদের চাপে দখলবাজি ও লুটপাট বন্ধ করা কঠিন হয়ে পড়বে। মেয়রপ্রার্থী সাঈদ খোকন কালের কণ্ঠকে বলেন, "দখলবাজি আর লুটপাটের কথা একেবারে অস্বীকার করার সুযোগ নেই। আমি নির্বাচিত হতে পারলে দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে এ ব্যাপারে 'জিরো টলারেন্স' দেখাব।" রাজধানীর নীলক্ষেতে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের জমি দখল করে রাতারাতি তিনতলা ভবন তৈরি করেছে একটি চক্র। এ চক্রের সঙ্গে ডিএসসিসির কতিপয় কর্মকর্তাও জড়িত বলে জানা যায়। জালিয়াতির মাধ্যমে শত কোটি টাকার এ সম্পদের নথিও গায়েব করা হয়েছে। এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করতেও অপারগতা প্রকাশ করেন ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আনসার আলী খান। এ মার্কেটটি ২০১২ সালে সাবেক সম্পত্তি কর্মকর্তা দিদারুল আলম একটি সমিতির নামে অস্থায়ী বরাদ্দ দেন। দিদারুল আলম সম্পত্তি কর্মকর্তা থাকা অবস্থায় ৯টি দোকান নিজের চাহিদামাফিক নেন। এরপর মার্কেটের অস্থায়ী বরাদ্দ ফাইলে নিজের ইচ্ছামতো স্থায়ী স্থাপনা নির্মাণের শর্ত জুড়ে দেন। আবার দোকানের সংখ্যাও তাদের ইচ্ছামতো দিয়ে দেন। এ নিয়ে বিপাকে পড়ার পরপরই আলোচিত এই ফাইলটি গায়েব হয়ে যায়। নথি না পাওয়ার ব্যাপারে ডিএসসিসি কর্তৃপক্ষ গঠিত তদন্ত কর্মকর্তা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. কবির মাহমুদ বলেন, তিন মাস এ নথি খোঁজাখুঁজি করেও তা পাওয়া যায়নি। ফলে নথি না পেয়ে কর্তৃপক্ষ বরাবরে প্রতিবেদন দাখিল করেছি।' গুলিস্তানের সুন্দরবন স্কয়ার মার্কেটের লিফট ও সিঁড়ির স্থান দখল করে মার্কেট বানিয়েছে একটি চক্র। শুধু তাই নয়, এ মার্কেটের চতুর্থ তলা থেকে ষষ্ঠ তলা পর্যন্ত অবৈধভাবে সরকারদলীয় লোকজন ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা মিলে নতুন করে ভুয়া বরাদ্দ তৈরি করেছেন। এখান থেকে সংশ্লিষ্টরা কোটি কোটি টাকা লুটপাট করেছেন। এ বিষয়টি নিয়ে বর্তমানে দুর্নীতি দমন কমিশনে মামলা রয়েছে। বলধা গার্ডেনসংলগ্ন রাস্তায় দোকান নির্মাণের জন্য বরাদ্দ দিয়েছে ডিএসসিসি। সিএস, এসএ ও সিটি জরিপে এ স্থান সিটি করপোরেশনের রাস্তা হিসেবে চিহ্নিত রয়েছে। অথচ সিটি করপোরেশন এ রাস্তাকে পরিত্যক্ত সম্পত্তি হিসেবে উল্লেখ্য করে বরাদ্দ দিয়েছে। ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে ডিএসসিসির সম্পত্তি কর্মকর্তা মো. মনিরুজ্জামান মিয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বলধা গার্ডেনের এই জায়গাটি সিএস, এসএ, আরএস ও সর্বশেষ সিটি জরিপে রাস্তা দেখানো আছে। এখানে কিভাবে মার্কেট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে তা আমার বোধগম্য নয়। মামলা-সংক্রান্ত জটিলতা কেটে গেলেই দোকান উচ্ছেদ করে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা হবে।' লুটপাটের এ রকম অসংখ্য নজির রয়েছে। অসহনীয় যানজট : ঘর থেকে বের হলেই যানজটে নাকাল রাজধানীবাসী। কখনো কখনো ১০ মিনিটের রাস্তা এক ঘণ্টায় পার হওয়াও দুষ্কর হয়ে পড়ে। কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রয়োজনের তুলনায় কম রাস্তা, সরু ও ভাঙা রাস্তার জন্য এ যানজটের সৃষ্টি হয়। এ ছাড়া রাজধানীর বেশির ভাগ সংযোগ সড়কও বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের দখলের থাকায় ব্যবহার করা যায় না। ফলে নতুন রাস্তা তৈরি, ভাঙা রাস্তা মেরামত ও সরু রাস্তা বড় করার মতো কাজও করতে হবে নতুন মেয়রদের। এ ছাড়া সিটি করপোরেশনের ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ার বিভাগ ও ঢাকা মহানগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের সমন্বয়ও এখন সময়ের দাবি। যিনি মেয়র নির্বাচিত হবেন তিনি এসব সমস্যার সমাধান করে যানজটমুক্ত নগরী উপহার দেবেন- এমনটাই আশা নগরবাসীর। রাস্তায় ৬৫০ ময়লার কনটেইনার : রাজধানীর প্রধান সড়ক থেকে শুরু করে অলিগলিতে ময়লার ভাগাড় নাগরিক জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তরের রাস্তায় প্রায় ৬৫০ খোলা কনটেইনারের ময়লা সারাক্ষণ নাড়াচাড়ার ফলে পথচারীদের নাক চেপে চলাফেরা করতে হয়। আর একটু বৃষ্টি হলে রাস্তায় জমে থাকা পানিতে ভাসতে থাকে ময়লা। অথচ নিয়ম অনুসারে, প্রতিদিনের আবর্জনা রাত ১২টার পর থেকে ভোরের মধ্যে অপসারণ শেষ হওয়ার কথা। কর্তৃপক্ষের দাবি, পরিত্যক্ত জায়গা না পাওয়ায় রাস্তা থেকে ময়লার এ বিশাল আকৃতির কনটেইনার সরানোর কোনো সুযোগ নেই। এ অবস্থায় সিটি করপোরেশন নির্বাচন শুরু হওয়ার পর পর নির্বাচিত মেয়রের কাছে ময়লার এ কনটেইনার রাস্তা থেকে সরানোর ব্যাপারে জোরালো দাবি রাখে নগরবাসী। ময়লার এ কনটেইনার রাস্তা থেকে সরানোর কোনো উপায় আপাতত নেই বলে জানান ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন বিপন কুমার সাহা। ভৌত কাঠামো আরেক চ্যালেঞ্জ : বিভক্ত সিটি করপোরেশনে দক্ষিণের চেয়ে প্রথমবারের মতো নির্বাচিত হয়ে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়রকে। কারণ ভাগ হওয়ার পর তিন বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও উত্তরে নগরভবন নির্মাণের জন্য জায়গাই খুঁজে পাওয়া যায়নি। আবার অবস্থানগত কারণে দক্ষিণের তুলনায় উত্তরে তেমন কোনো সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান নেই। ফলে প্রায় এক লাখ ৫৬ হাজার হোল্ডিং নিয়ে পৃথক হওয়া ডিএনসিসির বাসিন্দারা রীতিমতো অসহনীয় দুর্ভোগে রয়েছে। সিটি করপোরেশনের নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, দাতব্য চিকিৎসালয় দক্ষিণে ১৮, উত্তরে ২; শরীরচর্চা কেন্দ্র দক্ষিণে ১৪, উত্তরে ২; পাঠাগার দক্ষিণে ৭, উত্তরে ২; কমিউনিটি সেন্টার দক্ষিণে ৩১, উত্তরে ৭; কোয়ার্টার দক্ষিণে ৭, উত্তরে ১; মাতৃসদন দক্ষিণে ৩, উত্তরে নেই; নগর হাসপাতাল দক্ষিণে ২, উত্তরে নেই; মহিলা কলেজ দক্ষিণে ১, উত্তরে শূন্য; জাদুঘর ও নাট্যমঞ্চ দক্ষিণে ২, উত্তর খালি। ১৭টি মাঠ ও পার্ক বেদখল : দক্ষিণ ঢাকার তুলনায় শহরের অন্য অংশে উন্মুক্ত স্থান বা পার্ক-উদ্যান একেবারেই কম। ১৯৯০ সালে সিটি করপোরেশন আত্মপ্রকাশ হওয়ার পর এ পর্যন্ত নতুন করে কোনো পার্ক-উদ্যানের পরিকল্পনা হাতে নেয়নি। বড় আকারের উদ্যান ছাড়াও রাজধানীতে সিটি করপোরেশনের হিসাব মতে, পার্ক রয়েছে ৪৭টি আর খেলার মাঠ রয়েছে ১০টি। কিন্তু এগুলো কাগজের সঙ্গে বাস্তবের মিল পাওয়া যায় না। এ হিসাব অনুযায়ী, পৌনে চার লাখ মানুষের জন্য মাত্র একটি পার্ক। আবার এসব মাঠ ও পার্কের মধ্যে ১৭টিই বেদখলে রয়েছে। তাই আসন্ন নির্বাচনে নগরবাসী অন্য সব দাবির পাশাপাশি বিনোদনকেন্দ্র সৃষ্টি ও দখল হয়ে যাওয়া পার্কগুলো উদ্ধারে মেয়রের দিকে তাকিয়ে আছে। নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি ইকবাল হাবিব কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা যদি বিশ্বের উন্নত শহরগুলোর দিকে তাকাই তাহলে দেখব, বিনোদনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে 'ওয়াটার বডি' নির্মাণ। যেখানে আমাদের শহরের চারপাশে নদী ও খাল রয়েছে, সেখানে খুব সহজেই এ কাজটি করা যায়। কিন্তু ব্রিটিশ আমল থেকে যে পরিমাণ বিনোদনকেন্দ্র ছিল, এখনো তা-ই রয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কমে গেছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী শহরের নির্দিষ্ট বাসিন্দাদের জন্য জোনভিত্তিক বিনোদনকেন্দ্র থাকা দরকার।' মশা আর মাদকের অভিশাপ : রাজধানীর সব এলাকায়ই মশার উপদ্রবে নাগরিক জীবন অতিষ্ঠ। বাসাবাড়ি থেকে শুরু করে দিনেরবেলা পর্যন্ত মশার হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায় না। বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করেও সিটি করপোরেশন মশার হাত থেকে নগরবাসীকে রক্ষা করতে পারছে না। এদিকে রাজধানীর অলিগলিতে এখন হাত বাড়ালেই মেলে সব ধরনের মাদক। সহজলভ্য মরণ নেশা নিয়ে গভীর উদ্বিগ্ন নাগরিক জীবন। তাই আসন্ন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদপ্রার্থীদের কাছে মাদকমুক্ত সমাজ গঠনের জোরালো দাবি ভোটারদের।
No comments:
Post a Comment