রাজনৈতিক অস্থিরতা আপাতত কমলেও তা ফিরে আসার আশঙ্কা রয়েই গেছে। হরতাল-অবরোধ নামের কর্মসূচি মুহূর্তেই ওলটপালট করে দিতে পারে ব্যবসায়-বিনিয়োগের সাজানো সম্ভাবনা ও পরিকল্পনা। এ অবস্থায় আগামী ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরে রাজস্ব বোর্ড নিয়ন্ত্রিত মূল ধারার রাজস্ব আয়ে বড় ধরনের উল্লম্ফন আশা করতে পারছেন না অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। পরিস্থিতি বিবেচনায় সরকারের বিভিন্ন সেবা ফি বাড়িয়ে সেখান থেকে বাড়তি রাজস্ব আয়ের পরিকল্
পনা করছেন তাঁরা। একই সঙ্গে বিনা মূল্যে দেওয়া সরকারের বিভিন্ন সেবার বিপরীতে নতুন করে ফি আরোপের চিন্তাও রয়েছে অর্থ বিভাগের। সরকারের রাজস্ব আয়ের বড় অংশই আসে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) নিয়ন্ত্রিত করব্যবস্থা থেকে। সরকারের দেওয়া বিভিন্ন সেবা যেমন- টোল, লেভি, নানা ধরনের চার্জ, রেজিস্ট্রেশন ফি ও নানা ধরনের বিল থেকেও রাজস্ব আসে, যেগুলো করবহির্ভূত রাজস্ব নামে পরিচিত। চলতি অর্থবছরে রাজস্ব বোর্ড নিয়ন্ত্রিত রাজস্ব আদায়ে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হচ্ছে না। নতুন অর্থবছরেও চলতি অর্থবছরের তুলনায় রাজস্ব বোর্ড নিয়ন্ত্রিত করব্যবস্থা থেকে উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনের সম্ভাবনা ক্ষীণ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তাই করবহির্ভূত রাজস্ব (এনটিআর) আয় বাড়ানোর দিকে জোর দিয়েছে অর্থ বিভাগ। যদিও চলতি অর্থবছর লক্ষ্যমাত্রার ধারে-কাছে পৌঁছতে পারছে না করবহির্ভূত রাজস্ব আয়ের পরিমাণ। করবহির্ভূত রাজস্ব আয় বাড়াতে সরকারের দেওয়া বিভিন্ন সেবা ফি বাড়িয়ে নির্ধারণের জন্য গত ২৯ মার্চ অর্থ বিভাগের সিনিয়র সচিব মাহবুব আহমেদ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকে চিঠি পাঠিয়েছেন। তাতে দুই থেকে তিন বছরের অধিক পুরনো রেটগুলো যথাসম্ভব দ্রুত হালনাগাদকরণের প্রস্তাব দিয়েছেন তিনি। একই সঙ্গে বিভিন্ন সেবার বিপরীতে নতুন করে ফি ধার্য করার পরামর্শ দিয়ে মাহবুব আহমেদ বলেছেন, 'সরকার প্রতিবছর বিভিন্ন প্রকল্প ও কর্মসূচির আওতায় নতুন নতুন সেবা সৃষ্টি করছে। এসব সেবার বিপরীতে ফি ধার্য করা যায় কি না, তা পর্যালোচনা করতে হবে। একই সঙ্গে বর্তমানে এনটিআরের আওতা ক্রমান্বয়ে সম্প্রসারিত করতে হবে।' ইতিমধ্যে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ তাদের আওতাধীন এনটিআর রেটগুলো হালনাগাদের প্রস্তাব অর্থ বিভাগে পাঠিয়েছে উল্লেখ করে অর্থ বিভাগের সিনিয়র সচিব জানান, এ কার্যক্রমের ফলে সরকারের রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধি পাবে। এনটিআর আহরণ বাড়াতে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও দপ্তরের সঙ্গে গত বছরের নভেম্বর মাসে কর্মশালার আয়োজন করে অর্থ বিভাগ। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, সরকারের বিভিন্ন সেবার ফি পুনর্নির্ধারণের যৌক্তিকতা আছে। কারণ, এসব ফি কয়েক বছর আগে নির্ধারণের পর মূল্যস্ফীতিও বেড়েছে। অনেক জায়গায়ই সেবা ফি কিছু কিছু করে বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। তবে এসব সিদ্ধান্ত সরকারকে অজনপ্রিয় করে তোলে। তাই বেশ কয়েকবার গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েও সরকার পিছিয়ে গেছে। মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, সরকারের রাজস্ব আয়ের ৮০ শতাংশই আসে রাজস্ব বোর্ড নিয়ন্ত্রিত করব্যবস্থা থেকে। তাই ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থিতিশীল পরিবেশ নিশ্চিত করে এ খাত থেকে রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ বাড়াতে হবে। ফি ও সেবা চার্জ বা বিভিন্ন ধরনের বিল বাড়িয়ে করবহির্ভূত রাজস্ব আয়ের পরিমাণ কিছুটা বাড়ানো সম্ভব হলেও রাজস্ব বোর্ড নিয়ন্ত্রিত করব্যবস্থা থেকে আদায় না বাড়লে তা সরকারকে স্বস্তি দেবে না। কোন কোন সেবার বিপরীতে এনটিআর রেট বাড়তে পারে বা নতুন করে ফি আরোপ করা হতে পারে- সে সম্পর্কে জানা সম্ভব হয়নি। তবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেছেন, এখনো সরকারের বিভিন্ন হাসপাতালে টিকিট মূল্য পাঁচ থেকে ২০ টাকার মধ্যে। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের বিনা মূল্যে তথ্য সরবরাহ করছে সরকার। সরকার মালিকানাধীন বিনোদন কেন্দ্রগুলোর এন্ট্রি ফির পরিমাণও নগণ্য। এ ছাড়া প্রতিবছর বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে সরকার নতুন নতুন সেবা যোগ করছে, যা বিনা মূল্যে ভোগ করছে মানুষ। এসব সেবার বিপরীতে চার্জ বা ফি আরোপ ও পুনর্নির্ধারণের সুযোগ রয়েছে। সরকারের বিভিন্ন সেবার ওপর ফি আরোপ করা হলে বা সেবা ফি বাড়ানো হলে সীমিত আয়ের মানুষের ওপর বাড়তি চাপ পড়বে কি না, এমন প্রশ্নের উত্তরে ওই কর্মকর্তা বলেন, বাস্তবে এসব ফি বা চার্জ সাধারণ মানুষের ওপর তেমন কোনো প্রভাব ফেলে না। তিনি বলেন, এখন যে হাসপাতালের টিকিটের মূল্য ২০ টাকা রয়েছে, তা বাড়িয়ে ২৫ বা ৩০ টাকা করা হলেও তাতে রোগীর চিকিৎসায় কোনো সমস্যা হবে না। কারণ, সাধারণত একজন মানুষ বছরে দুই-তিনবার হাসপাতালের চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করে। তাতে পুরো বছরে ২০ থেকে ৩০ টাকা বাড়তি ব্যয় হবে। এই পরিমাণ অর্থ কারো পুরো বছরের আয়-ব্যয়ের ওপর কোনো প্রভাব ফেলে না। চলতি অর্থবছরের বাজেটে রাজস্ব বোর্ড নিয়ন্ত্রিত করব্যবস্থা থেকে এক লাখ ৪৯ হাজার ৭২০ কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে সরকারের। অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) রাজস্ব বোর্ড নিয়ন্ত্রিত করব্যবস্থা থেকে এই সময়ে আদায় হয়েছে ৬৯ হাজার ৪৬৬ কোটি টাকা। রাজস্ব বোর্ড নিয়ন্ত্রিত ও বহির্ভূত করব্যবস্থা থেকে রাজস্ব আদায় শ্লথ হওয়ার তথ্য তুলে ধরে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ-সিপিডি জানিয়েছে, চলতি অর্থবছর লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ ২৫ হাজার কোটি টাকা কম হতে পারে। গত অর্থবছরের প্রকৃত রাজস্ব আয়ের তুলনায় চলতি অর্থবছর ৩৪.৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরে রাজস্ব বোর্ডের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও বাস্তবে গত সাত মাসে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৩.১ শতাংশ। এমনকি রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে গত জানুয়ারি মাসে ১১.৮ শতাংশ ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। অন্যদিকে চলতি অর্থবছর করবহির্ভূত রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রার পরিমাণ ২৭ হাজার ৬৬২ কোটি টাকা। সেখানে জুলাই-জানুয়ারি সময়ে আদায় হয়েছে ১০ হাজার ৯০১ কোটি টাকা, যা মোট লক্ষ্যমাত্রার ৩৯.৪ শতাংশ। এই অর্জন গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৩৪.৮ শতাংশ কম। গত অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে করবহির্ভূত রাজস্ব আয়ের পরিমাণ ছিল ১৬ হাজার ৭১৭ কোটি টাকা।
No comments:
Post a Comment