Thursday, April 23, 2015

পাকিস্তানকে বাংলাওয়াশ:কালের কন্ঠ

তারায় তারায় লেখা ছিল বাংলাদেশের আগাম বিজয়কাব্য। কিন্তু পাকিস্তানের ওপেনিং জুটিতে ৯১ রান উঠে যাওয়ার পর সেই জ্বলজ্বলে তারাগুলো যেন নিভু নিভু। হবে না তাহলে? ৫৬ হাজার বর্গমাইল মানচিত্রের ক্যানভাসে আঁকা ছিল বাংলাওয়াশের জলছবি। ১২ ওভার বাকি থাকতে আট উইকেট হাতে নিয়ে পাকিস্তান ২০০ পেরোনোয় সেই রঙিন জলছবি যেন বিবর্ণ। অর্জনের চৌকাঠে হুমড়ি খেয়ে পড়তে হবে তবে? ১৬ কোটি ক্রিকেটপ্রাণের স্বপ্ন-স্লোগানে মুখর ছিল এই প
াললিক ব-দ্বীপ। ব্যাটিং ইনিংসে তামিম ইকবাল ও মাহমুদ উল্লাহর ঝটপট বিদায়ে হঠাৎই সেই তেজস্বী স্লোগানের ঝাঁঝ যেন যায় কমে। এত কাছে তবু কত দূর- এই আক্ষেপের আগুনেই পুড়তে হবে তাহলে? না, ক্রিকেট-বিধাতা অত নিষ্ঠুর নন। পাকিস্তানের বিপক্ষে দ্বৈরথের মরুভূমিতে মরূদ্যান মনে হচ্ছিল যা, সেটি মরীচিকা করে দেননি তিনি। প্রথম দুই ওয়ানডের ধারাবাহিকতায় কালও তাই জেতে বাংলাদেশ। ৬৩ বল হাতে রেখে আট উইকেটের ব্যবধানে। বাতাসে বাংলাওয়াশের সৌরভ ছড়িয়ে শুরু হওয়া ওয়ানডে সিরিজের শেষ ম্যাচটিতে তাই হতাশ হতে হয়নি স্বাগতিকদের। সত্যি সত্যিই পাকিস্তানকে বাংলাওয়াশ করেছে যে বাংলাদেশ! আগের দিনই অধিনায়ক মাশরাফি মনে করিয়ে দেন, এখনকার ক্রিকেটে জয়-পরাজয়ের ব্যবধান হয় খুব কম। অথচ পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচ তিনটির ফলের দিকে দেখুন। স্বাগতিকদের জয়ের ব্যবধান যথাক্রমে ৭৯ রান, ৭ উইকেট এবং ৮ উইকেটের। তিন ম্যাচের মধ্যে সবচেয়ে কঠিনভাবে কোন ম্যাচ জেতে বাংলাদেশ- ওই প্রশ্নই তাই এখন অবান্তর। বরং কোন জয়টি সবচেয়ে সহজ, এ নিয়ে চলতে পারে বিতর্ক। কী দাপুটে আধিপত্য যে সিরিজজুড়ে বাংলাদেশের- এতেই তার প্রমাণ! অর্জনটি অভূতপূর্ব। অবিশ্বাস্য-অকল্পনীয়-অনন্য এমন কোনো বিশেষণই সে কারণে যথেষ্ট নয় মাশরাফির দলের জন্য। সেটি বর্ণনায় ভাষার ভাঁড়ারে শব্দের টান তাই পড়বেই পড়বে। অথচ এই পাকিস্তান কিনা ১৬ বছর ধরে অজেয় ছিল বাংলাদেশের কাছে। বিশ্ব ক্রিকেটের কত রাজা-গজা পরাভূত বাংলার জল-কাদামাখা ক্রিকেটসেনাদের সামনে! কিন্তু পাকিস্তানের মুখোমুখিতে তারা কিভাবে কিভাবে যেন হারার রাস্তা ঠিকই নিত খুঁজে। সেই দুঃস্বপ্নের দীর্ঘ দিবস দীর্ঘ রজনী এবার কবরচাপা দেয় মাশরাফি বিন মর্তুজার দল। একটি ওয়ানডে জয়েই হয়তো দেড় দশকের জয়খরার ক্ষতে পড়ত প্রলেপ। আর সিরিজ জয় তো বলিহারি! সেখানে তিন ম্যাচে তিন জয়ে একেবারে বাংলাওয়াশ? এ যে স্বপ্নপাখির ডানায় ভেসে কল্পলোকের সাম্রাজ্যে উড়ে যাওয়ার মতো ব্যাপার! আর সেই অর্জনের সুউচ্চ শিখরে বাংলাদেশ তাদের জয়নিশান ওড়ায় কোনো একক মহাবীরের মহান কীর্তিতে না। বরং ‘এগারোয় মিলে করি কাজ’-এর মতো মাঠের ১১ ক্রিকেট-বীরের হাতে হাত রাখা পারফরমেন্সে। তিন ম্যাচের আলাদা তিন ম্যান অব দ্য ম্যাচ কি সেই বার্তাই দিচ্ছে না? প্রথম ম্যাচে তামিম ইকবাল সেঞ্চুরি করেও পারেন না ম্যাচসেরা হতে। আরেক সেঞ্চুরিয়ান মুশফিকুর রহিমের হাতে ওঠে সেই পুরস্কার। দ্বিতীয় খেলায় অবশ্য তামিমের ওই আক্ষেপ যায় মুছে। তিন অঙ্ক ছোঁয়া আরেকটি জাদুকরী ইনিংসে। কাল শেষ ওয়ানডেতে এই ওপেনারের সামনে সুযোগ ছিল টানা তিন ওয়ানডেতে সেঞ্চুরির অপূর্ব অর্জনের কালিতে নিজের নাম লেখানোর। সম্ভাবনা জাগান তিনি ভালোভাবেই। করেন ফিফটিও। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ৬৪ রান করে আউট হওয়ায় তামিমের টানা তিন সেঞ্চুরি হয়নি। তাতে কী? সৌম্য সরকারের প্রথম ওয়ানডে সেঞ্চুরি দলকে জয়ের বাতিঘরে যে পৌঁছে দেয় ঠিকই! নতুন বাংলাদেশের বিজ্ঞাপন হয়ে সৌম্যর অভিষেক বাংলাদেশ দলে। তাঁর ব্যাটিং ডাকাবুকো। স্ট্রোকের ফুলঝুরি ছোটাতে তিনি ডরভয়হীন। প্রতিপক্ষের মনোবল গুঁড়িয়ে দেওয়ার মতো উদ্ধত তাঁর ব্যাট। নিজ ড্রেসিংরুমে আত্মবিশ্বাস ছড়িয়ে দেওয়ার মতো শানিতও। এত দিন এগুলো ছিল কেবল প্রতিশ্রুতির কলি হয়ে। ম্যাচের পর ম্যাচ ভালো শুরুর পরও যে ইনিংস টেনে নিতে পারছিলেন না সৌম্য! পারলেন কাল। প্রতিশ্রুতির কলি পূর্ণ শতদলে ফুটিয়ে। ওয়ানডে ক্যারিয়ারে নিজের প্রথম সেঞ্চুরি করে। বাংলাদেশ ক্রিকেট ইতিহাসের এক মাহেন্দ্রক্ষণ উপহার দিয়ে। অথচ কালকের ম্যাচের চিত্রনাট্য কত ভিন্নরকমই না হতে পারত! অন্তত সেই আশঙ্কা তো শুরুতে প্রবলভাবে জেঁকে ধরে বাংলাদেশকে। টস জিতে ব্যাটিংয়ে নেমে পাকিস্তানের ওপেনাররা ১৮ ওভারে ৯১ রান তুলে ফেলার সময় যেমন। একাদশে তিন পরিবর্তনে তারাও কি তবে বদলে গেল? এরপর ঝটপট দুই শিকারের আনন্দে বাংলাদেশ মেতে উঠলেও সেটি মিইয়ে যেতে সময় লাগেনি। অধিনায়ক আজহার আলী ও হারিস সোহেলের ব্যাটের সেতু পাকিস্তানকে এমন মঞ্চে নিয়ে যায়, যেখান থেকে তিন শ, এমনকি সাড়ে তিন শও অসম্ভব ছিল না। ৩৮ ওভারে মাত্র দুই উইকেট হারিয়ে ২০২ রানে পৌঁছে যাওয়ায় ওই শঙ্কা ছিল স্বাগতিকদের সামনে। কিন্তু এই বাংলাদেশ যে আর আগের বাংলাদেশ নেই! হারার আগে যারা হেরে যায় না। বিরুদ্ধ স্রোতে সাঁতার কাটতে গিয়ে যায় না ডুবে। সময়ের প্রয়োজনে সাড়া দিয়ে সেঞ্চুরি করা প্রতিপক্ষ অধিনায়ক আজহারকে (১০১) ফিরিয়ে দেন তাই সাকিব আল হাসান। পরের ওভারে হাফ সেঞ্চুরিয়ান হারিস (৫২) মাশরাফির শিকার। ব্যস, তাতেই কম্মোসারা! তাসের ঘরের মতো হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ে পাকিস্তানের ইনিংস। ৪৭ রানের মধ্যে শেষ আট উইকেটে হারিয়ে মাত্র ২৫০ রানে অলআউট তারা। সাড়ে তিন শর চোখরাঙানি উপেক্ষা করে আড়াই শতে প্রতিপক্ষকে আটকে ফেলা- বদলে যাওয়া বাংলাদেশের সনদের জন্য আর কী চাই! নিশ্চিন্ত হওয়ার উপায় ছিল না তবু। রক্তাক্ত পাকিস্তানের মরিয়া হয়ে মরণকামড় দেওয়ার আশঙ্কাটি ছিলই যে! বৈশাখের সন্ধ্যাকাশে সেটি ঈশান কোণে ছুড়ে ফেলতে সময় নেননি বাংলাদেশের দুই ওপেনার। তামিম ও সৌম্যর ২৫.৩ ওভারে ১৪৫ রানের জুটিতেই এক অর্থে শেষ ম্যাচ। সর্বার্থে সেটি শেষ হওয়া ছিল কেবলই আনুষ্ঠানিকতার অপেক্ষা। এরপর আর উত্তুঙ্গ আত্মবিশ্বাসের বাংলাদেশকে ঠেকানোর সাধ্যি ছিল না যে ওই ক্ষয়িষ্ণু সামর্থ্যরে পাকিস্তানের! ৬৪ রান করে তামিম আউট হওয়ায় আক্ষেপ রয়ে গেল কিছুটা। টানা তিন সেঞ্চুরি হলো না বলে। কিন্তু সেটি ভুলিয়ে দিতে বেশি সময় নেননি সৌম্য। ৬৩ বলে ফিফটি করার পর আরো আক্রমণাত্মক তিনি। যে কারণে সেঞ্চুরিটা হয়ে যায় মোটে ৯৪ বলে। ১১টি চার তো আলো ছড়াচ্ছিলই, এর পাশাপাশি ইনিংসের চতুর্থ ছক্কায় পৌঁছান তিনি সেঞ্চুরিতে। ফর্ম হারানো বিশ্বকাপ-বীর মাহমুদ ৪ রান করে আউট হলেও বাংলাদেশের জয় ততক্ষণে কেবল সময়ের ব্যাপার। সে সময়টা যখন লুটোয় অবশেষে, এক প্রান্তে ১১০ বলে ১২৭ রানে অপরাজেয় সৌম্য। অন্য প্রান্তে ৪৩ বলে ৪৯ রান করে মুশফিকুর রহিম। গাঙ্গেয় ব-দ্বীপে রাতের আকাশেও উঠল তাই জয়সূর্য। ফ্লাডলাইটের রুপালি আলো ছাপিয়ে অলক্ষ্যে যার উজ্জ্বলতা ছড়িয়ে পড়ল বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের পাতায়। পাকিস্তানকে বাংলাওয়াশ করার এই অর্জন যে জ্বলজ্বলে হয়ে থাকবে চিরকাল! কীর্তিতে। গৌরবে। বীরত্বে।

No comments:

Post a Comment