Monday, April 20, 2015

স্বপ্নের সমান জয়:কালের কন্ঠ

সাফল্যনদী শুকিয়ে গিয়েছিল ব্যর্থতার ঊষর মরুতে। আবার তাতে ফিরল দুকূল উপচানো জোয়ার। অমাবস্যার অন্ধকারে ঢেকে ছিল বিষণ্ন হাজারো রজনী। আবার সেখানে আনন্দ-আলো ছড়িয়ে ফুটল জোছনার ফুল। ভাঙা বাঁশির বেসুরো সুরে মন খারাপ ছিল কত কাল! আবার তাতে বাজল মন-মাতাল করা ঐন্দ্রজালিক সুরের ঝংকার। বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের কাছে ওই শুকিয়ে যাওয়া নদী কিংবা বিষণ্ন সব রজনী অথবা ভাঙা বাঁশির সুর হয়েছিল পাকিস্তানের বিপক্ষে দ্বৈরথ
। সেই কবে, এ দেশের ক্রিকেটের প্রায় প্রস্তর যুগে তাদের বিপক্ষে এসেছিল সবেধন নীলমণি জয়টি! এরপর থেকেই তো ব্যর্থতার সাতকাহন। ক্রিকেট-নকশির ফোঁড়ে ফোঁড়ে দুঃখের বুনন। অস্ট্রেলিয়া-দক্ষিণ আফ্রিকা নতজানু হয়, ভারত-শ্রীলঙ্কাও অজেয় নয়- কিন্তু প্রতিপক্ষ যখন পাকিস্তান, বাংলাদেশ তখন যেন নিয়তির হাতের পুতুল। পরাজয়ের পরিণতি খণ্ডানোর ক্ষমতা নেই যাঁদের। কিন্তু আর কত কাল ওই খাণ্ডব-দাহন? এই সিরিজে তাই দোর্দণ্ড দাপটে সেই নিয়তিকেই নাচাচ্ছে বাংলাদেশ! প্রথম ওয়ানডেতে ৭৯ রানের জয়ে ১৬ বছরের গেরো ছুটিয়ে। আর কাল ৭১ বল হাতে রেখে ৭ উইকেটের বিধ্বংসী বিজয়ে ইতিহাসের নতুন বাতায়ন খুলে দিয়ে। এক খেলা হাতে রেখে পাকিস্তানের বিপক্ষে সিরিজ জয় কী চাট্টিখানি কথা! আনন্দ-জোয়ারে তাই উদ্বেলিত হবে না কেন বাংলাদেশ! জোছনা-ফুলের অলৌকিক আলোয় ভাসবে না কেন ৫৬ হাজার বর্গমাইল! জাদু-বাঁশির সুর মূর্ছনায় নাচবে না কেন ১৬ কোটি ক্রিকেটপ্রাণ! জয়-জয় আবহটা ছিল প্রথম ওয়ানডেতেই। অপেক্ষা অবসানের সেই প্রত্যাশা পূরণের পর নতুন প্রত্যাশার তারে বাঁধা হয় মাশরাফি বিন মর্তুজার দলকে। সিরিজ জয়ের দিন দুয়েক আগের দাপুটে জয়ের আত্মবিশ্বাস জ্বালানি হয়ে ছিল সঙ্গী। সঙ্গে বহিষ্কারাদেশ কাটিয়ে নিয়মিত অধিনায়ক ফেরার উজ্জীবনী। দুয়ে মিলে কাল দুর্বার বাংলাদেশ। তাদের রোখার সাধ্যি কী নড়বড়ে-ভাঙাচোরা-দুর্বল এই পাকিস্তানের! সামর্থ্য নেই যেমন তামিম ইকবালকে থামানোর। প্রথম ওয়ানডের সেঞ্চুরির পর কালও ১১৬ বলে অপরাজিত ১১৬ রানের ইনিংস খেলে ২০১০ সালের লর্ডস-ম্যানচেস্টারের স্মৃতিই যেন ফিরিয়ে আনেন এই ওপেনার। মুশফিকুর রহিমের বুদ্ধিদীপ্ত ব্যাটিংয়েরও প্রত্যুত্তর নেই পাকিস্তানের কাছে। ৭০ বলে ৬৫ রানের ইনিংস খেলে তামিমকে তাই যোগ্য সঙ্গ দিয়ে যান তিনি। এর আগে সাকিব-আরাফাতদের ঘূর্ণিজাদু কিংবা মাশরাফি-রুবেল-তাসকিনদের গতির ঝড় সামলানোতেও নিরুপায় প্রতিপক্ষ। ২৩৯ রান করেই বর্তে যায় তাই তারা। অক্ষমের তৃপ্তি আর কী! কিন্তু ১৬ বছরের অতৃপ্ত বাংলাদেশের কাছে তা উড়ে যেতে সময় লাগেনি মোটেও। প্রথম ম্যাচে তবু শুরুর দিকে ম্যাচে ছিল পাকিস্তান। ২০ ওভারে ৬৭ রানের মধ্যে বাংলাদেশের দুই উইকেট ফেলে দিয়ে। কাল তাও না। ব্যাটিং বেছে নিয়ে ৭ ওভারে বিনা উইকেটে ৩৬ পর্যন্ত যায় বটে। এরপর দেখতে না দেখতেই পরের ৪১ রানের মধ্যে হারিয়ে ফেলে পাঁচ উইকেট। রুবেল হোসেন তাঁর প্রথম বলে আউট করেন সরফরাজ আহমেদকে। নিজের দ্বিতীয় ওভারে মোহাম্মদ হাফিজকে আরাফাত সানি। প্রথম ওভারে উইকেট-উল্লাস সাকিবেরও। বিপজ্জনক হয়ে ওঠা আজহার আলী (৩৬) রিভার্স সুইপ করতে গিয়ে পরিণত মুশফিকুর রহিমের ক্যাচে। কিছুক্ষণ পর নাসির হোসেনের নিরীহ অফস্পিনে বোল্ড ফাওয়াদ আলম। আর সাকিব যখন আগের ম্যাচে ফিফটি করা মোহাম্মদ রিজওয়ানকে দেন ফিরিয়ে, পাকিস্তান তখন ২১.৩ ওভারে ৭৭ রানে পাঁচ উইকেট হারিয়ে রীতিমতো কাঁপছে। পরের দুই জুটিতে ওই কাঁপুনি থামে কিছুটা। বাংলাদেশ ক্যাম্পেও দুশ্চিন্তা ফেরে কিছুটা। কিন্তু তা আর কতটাই-বা? সাদ নাসিম ও হারিস সোহেলের (৪৪) ১৭.৩ ওভারে ৭৭ রানের জুটি এবং ওয়াহাব রিয়াজের (৫১) সঙ্গে নাসিমের (৭৭) ১১ ওভারে ৮৫ রানের অবিচ্ছিন্ন জুটিতে ছয় উইকেটে ২৩৯ পর্যন্তই তো যায় পাকিস্তান! চাইলে ইতিহাসের ধুলো ঝেরে ওই স্কোরেও দুঃস্বপ্নের কিছু উপকরণ খুঁজে নেওয়া যেত। দেড় যুগের প্রলম্বিত দুঃসময়ে পাকিস্তানকে ১৭৭ রানে অলআউট করেও নিজেরা ১১৯ রানে অলআউট হওয়ার রেকর্ড রয়েছে যে বাংলাদেশের! কিন্তু এখনকার ক্রিকেটসেনারা তো সময়ের সূর্যসন্তান। পাকিস্তানকে অমন বাগে পেয়ে সুযোগ হাতছাড়া তাই করেনি তারা। সৌম্য সরকার টানা তিন-চারের পর কট বিহাইন্ড হয়ে যেতে পারেন। তাতে কী? তামিম ও মাহমুদউল্লাহ ১১.২ ওভারে ৭৮ রানের জুটিতে ঠিক কক্ষপথে রাখেন রানরথ। প্রথম ১০ ওভারে এক উইকেটে ৮৩ রান তুলতে পারে স্বাগতিকরা। পাকিস্তানের ৫০ ওভারের ইনিংসের ১৯ বাউন্ডারির জবাবে প্রথম ১০ ওভারেই ১৮ বার বল ফেলতে পারে সীমানার ওপারে। ১৭ রান করে মাহমুদ আউট? মুশফিক আছেন না! তামিমের সঙ্গে মাত্র ২২.১ ওভারে ১১৮ রানের জুটি গড়ে দলকে নিয়ে যেতে পারেন জয়ের সুবর্ণবন্দরের তীরে। শেষ সময়ে মুশফিকের আউটেও তাই ম্যাচের ফল নিয়ে জাগে না কোনো সংশয়। ফল নিয়ে অনিশ্চয়তা এলেও শেষ অনেক আগে। তামিমের মাত্র ৩১ বলে ফিফটির সময়ই। এরপর ম্যাচে আর একটিই প্রতীক্ষা টিকে ছিল কৌতূহল নিয়ে। টানা দুই খেলায় সেঞ্চুরি করতে পারবেন এই ওপেনার? পারলেন তিনি। ফিফটির আগে-পরে একেবারে ভিন্ন ঘরানার ব্যাটিংয়ের ঝলকে। ১২ বাউন্ডারিতে ৩১ বলে ফিফটির পরিসংখ্যানই বলছে, শুরুতে কী বিস্ফোরক মেজাজে ছিলেন তামিম! রাহাত আলীকে চার বলের মধ্যে মারেন তিন চার; সাঈদ আজমলের করা প্রথম ওভারের শেষ তিন বলে এবং ওয়াহাব রিয়াজের করা পরের ওভারের শেষ তিন বলেও। অথচ ফিফটির পর দলের প্রয়োজন ও ম্যাচের মেজাজ বুঝে সংযত তামিমের ব্যাট। সাহসী সৌন্দর্যের জায়গা নেয় আয়েশী স্নিগ্ধতা। ৭৭ বলে পরের ফিফটি করে ১০৮ বলে সেঞ্চুরিতে পৌঁছাটা কী সে কথাই বলছে না! এবার? ১৬ বছরের প্রতীক্ষা পূরণ হলো। পাকিস্তানের বিপক্ষে সিরিজ জয়ের আপাত-অসাধ্য স্বপ্নও। বাংলাদেশের সামনে এবার তাই অমরত্বের হাতছানি। শেষ ম্যাচ জিতে ‘বাংলাওয়াশ’-এর আনন্দে মাতলে তবেই না অর্জনের পূর্ণতা পাবে এই সাফল্য জোয়ার। এই আনন্দ জোছনার ফুল। এই জাদুর বাঁশির সুর।

No comments:

Post a Comment