Monday, April 20, 2015

ব্যক্তিগত গাড়ির চাপে অচল ঢাকা:কালের কন্ঠ

ঢাকা মহানগরীর রাস্তা বেশির ভাগ সময় অচল থাকে ছোট গাড়ির চাপে। বাস-মিনিবাসের চেয়ে ছোট গাড়ি বাড়ানো হচ্ছে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে। বিশেষ করে ব্যক্তিগত গাড়ির (প্রাইভেট কার) চাপে ভেঙে পড়েছে রাস্তার শৃঙ্খলা। যানজটে নিশ্চল হয়ে থাকছে ঢাকা। দ্রুত গণপরিবহন ব্যবস্থা শক্তিশালী করা না হলে এ অচলাবস্থা কাটবে না। মেট্রো রেল, বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি), ঢাকা উড়াল সড়ক প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে যানজট কিছুটা হলেও কমত। এসব প্র
কল্প বাস্তবায়ন না হওয়ার পাশাপাশি প্রাইভেট কার বেড়ে যাওয়ায় রাজধানীতে দিনে ৮৩ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। বছরে যানজটেই ক্ষতি হচ্ছে ২০ হাজার কোটি টাকা। ২০১৮ সালে পদ্মা সেতু চালু হলে রাজধানীর পরিবহনব্যবস্থা আরো বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে। এর আগে উত্তরা তৃতীয় ফেজ থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রো রেলের প্রথম অংশ (উত্তরা-সোনারগাঁ মোড়) চালু হবে না। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, গাড়ি কেনার ক্ষেত্রে আগের কঠোর ঋণনীতি শিথিল হওয়া, ডলারের বিপরীতে জাপানি মুদ্রা ইয়েনের দাম কমে আসায় গাড়ি বাণিজ্যে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচন সামনে রেখে মেয়র পদপ্রার্থীরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, বিজয়ী হলে তাঁরা প্রাইভেট কার নিয়ন্ত্রণে জোড়-বিজোড় পদ্ধতি চালু, প্রাইভেট কারে সিএনজি ব্যবহার বন্ধ, উচ্চহারে পার্কিং চার্জ আরোপ, সাইকেলের জন্য আলাদা লেন ও গণপরিবহন ব্যবস্থা শক্তিশালী করবেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকায় ছোট গাড়ি অবাধে বাড়লেও উন্নত দেশগুলোর বিভিন্ন নগরীতে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। সিঙ্গাপুরে ছোট গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করা হয়ে থাকে বেশি শুল্ক আরোপ করে গাড়ির দাম বাড়িয়ে। সেখানে গাড়ি কিনতে গেলে অনুমতি দেওয়া হয় লটারির মাধ্যমে। যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো নগরীতে অফিস সময়ে নির্দিষ্ট স্থানে গাড়ি রাখার জন্য প্রতি ঘণ্টায় দিতে হয় ১৫ থেকে ১৮ ডলার। গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য উচ্চহারে চার্জ নেওয়া হয়ে থাকে বিশ্বের আরো অনেক নগরীতেও। যুক্তরাজ্যের লন্ডনে রাস্তায় গাড়ি রাখাই নিষিদ্ধ। অথচ ঢাকায় চলাচলের রাস্তা দখল করে রাখা হচ্ছে প্রাইভেট কার। পর্যাপ্ত গণপরিবহন না থাকায় প্রাইভেট কারের ওপর নির্ভর হয়ে পড়েছে নগরবাসীর বড় একটি অংশ। কর্মস্থলে যাতায়াত, ছেলেমেয়ের স্কুলে যাতায়াত, বেড়ানো, কেনাকাটায় প্রাইভেট কারের ওপর নির্ভরতা বাড়ছেই। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে যাতায়াত সুবিধার জন্য নগরবাসীর বড় অংশই কিনছে ছোট গাড়ি। বিশেষজ্ঞদের প্রণীত ঢাকার কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনায় (এসটিপি) ছোট গাড়িকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। জোর দেওয়া হয়েছে দ্রুত গণপরিবহন ব্যবস্থা মেট্রো রেল কিংবা বিআরটির ওপর। জাতীয় স্থলনীতিমালা-২০০৪-এ ছোট গাড়ি নিয়ন্ত্রণের সুপারিশ করা হয়েছে। তবে বাস্তবে ঢাকায় ছোট গাড়ির নিবন্ধন ও রুট পারমিট দেওয়া হচ্ছে কোনো ধরনের বিবেচনা ছাড়াই। ঢাকায় প্রতিদিন নিবন্ধিত হচ্ছে গড়ে ৩৫টি প্রাইভেট কার, যা দেশে মোট নিবন্ধনের ৮৫ শতাংশ। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাসের খান কালের কণ্টকে বলেন, ঢাকা প্রাইভেট কারের কারণে অচল হয়ে গেছে। এটির চলাচল নিয়ন্ত্রণ করতে সিটি করপোরেশনের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের উচিত হবে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা। নগর বিশেষজ্ঞদের মতে, একটি আদর্শ নগরীতে মোট আয়তনের ১৫ শতাংশ সড়ক থাকার কথা; কিন্তু ঢাকায় রয়েছে মাত্র ৭ শতাংশ। আয়তন ও রাস্তার তুলনায় প্রাইভেট কারের চাপ বাড়ছেই। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের তথ্যানুযায়ী, দুই সিটি করপোরেশনের আয়তন এক হাজার ৫২৯ বর্গকিলোমিটার। গাড়ি চলাচলের সড়ক আছে দুই হাজার ৫৫০ বর্গকিলোমিটার। বুয়েটের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, দখল, খোঁড়াখুঁড়িসহ বিভিন্ন অব্যবস্থাপনার কারণে ঢাকার ৪০ শতাংশ রাস্তাই ব্যবহার করা যায় না। এর ওপর প্রাইভেট কার দখল করে রাখছে চলাচলের রাস্তা। ঢাকা সমন্বিত পরিবহন গবেষণার তথ্যানুসারে, গতি, আকার ও ব্যবহারের দিক থেকে একটি বড় বাস একটি প্রাইভেট কারের আড়াই গুণ বেশি স্থান দখল করে। একটি বড় বাসে ৫১ জন যাত্রী বহন করা সম্ভব। প্রাইভেট কারে চালক ছাড়া তিনজন যাত্রী বহন করা যায়। দৈনিক নিবন্ধন ৩৫টি : বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) সূত্রে জানা গেছে, রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যেও দেশে প্রতিদিন গড়ে ৪১টি প্রাইভেট কার নিবন্ধন হয়েছে। ঢাকায় নিবন্ধিত হচ্ছে ৮৫ শতাংশ অর্থাৎ দিনে গড়ে ৩৫টি। রাজধানীর দুই শতাধিক শো রুমে গাড়ি বিক্রি ক্রমেই বাড়ছে। এ ছাড়া চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরে খালাসের অপেক্ষায় আছে সাড়ে পাঁচ হাজার রিকন্ডিশনড গাড়ি, যার ৭৫ শতাংশই প্রাইভেট কার। বিআরটিএর তথ্যমতে, চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে দেশে নিবন্ধন হয়েছে তিন হাজার ৬৯৮টি প্রাইভেট কার। এর মধ্যে ঢাকায় নিবন্ধিত হয়েছে তিন হাজার ৫০টি। গত বছরের জানুয়ারিতে দেশে এক হাজার ১০টি প্রাইভেট কার বিক্রি হয়েছিল। এ বছরের জানুয়ারিতে বিক্রি হয়েছে এক হাজার ২৫৬টি। গত বছর ফেব্রুয়ারিতে বিক্রি হয়েছিল ৯৮৬টি, এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে হয়েছে এক হাজার ২৭১টি। রিকন্ডিশনড গাড়ি আমদানিকারক ও ডিলারদের সংগঠন বারভিডার সাবেক সভাপতি হাবিব উল্লাহ ডন কালের কণ্ঠকে বলেন, অবরোধ-হরতালের কারণে রাজধানীর দুই শতাধিক শো রুমে গাড়ি বিক্রি ৫০ শতাংশ কমে গিয়েছিল। এই গাড়ি বিক্রি এখন আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যাচ্ছে। বাজার চাঙা হচ্ছে ধীরে ধীরে। গত দুই বছরের তুলনায় গাড়ির দাম কমেছে। বাজেটের আগে গাড়ি বিক্রি বেড়ে যায়। ঋণ সুবিধা বেড়েছে : গাড়ির ক্রেতারা জানিয়েছেন, আগে গাড়ি কেনার ক্ষেত্রে ৭০ শতাংশ অর্থ ক্রেতাকে পরিশোধ করতে হতো, ব্যাংক ঋণ দিত ৩০ শতাংশ। গাড়ি কেনায় সর্বোচ্চ ২০ লাখ টাকা ঋণ নিতে পারতেন একজন ক্রেতা। গত বছরের মাঝামাঝি এই নিয়ম শিথিল করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এখন গাড়ি কেনার ক্ষেত্রে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া ৪০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ নিতে পারছেন ক্রেতা। অন্যদিকে ডলারের বিপরীতে জাপানি মুদ্রা ইয়েনের দামও কমে গেছে। ইয়েনের মূল্য কমায় এবং টাকার মান বেড়ে যাওয়ায় গাড়ি আমদানি ব্যয় কমেছে। বাংলাদেশের গাড়ির বড় অংশই জাপান থেকে আনা হয়ে থাকে। জাপানের রিকন্ডিশনড গাড়িই ৭০ শতাংশ। ঢাকায় প্রাইভেট কার দুই লাখের বেশি : বিআরটিএর গত মার্চ মাসের প্রতিবেদন অনুসারে, ঢাকায় ২০ ধরনের নিবন্ধিত গাড়ি আছে আট লাখ ৭০ হাজার ৮৭১টি। এর মধ্যে দুই লাখ সাত হাজার ৯৬৭টি প্রাইভেট কার। ২০০৯ সাল পর্যন্ত নগরীতে নিবন্ধিত প্রাইভেট কার ছিল এক লাখ ৪৩ হাজার ৩৮৯টি। ২০১০ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত নিবন্ধন হয় ৬৪ হাজার ৫৭৮টি প্রাইভেট কার। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে নিবন্ধিত হয়েছে তিন হাজার ১৫০টি প্রাইভেট কার। একই সময়ে রাজধানীতে বাস নিবন্ধন হয়েছে ৫৮৯টি এবং মিনিবাস ১৬টি। ঢাকায় বাস ও মিনিবাস নিবন্ধিত আছে ৩০ হাজার, যার মধ্যে চলাচল করছে মাত্র পাঁচ হাজার। মেয়র পদপ্রার্থীদের প্রতিশ্রুতি : ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদপ্রার্থীরা অবশ্য বলছেন, তাঁরা নির্বাচিত হলে প্রাইভেট কার নিয়ন্ত্রণে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করবেন। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে (ডিএনসিসি) মেয়র পদে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী আনিসুল হক তাঁর নির্বাচনী ইশতেহারে যানজট নিরসনে গণপরিবহন ব্যবস্থাকে অগ্রাধিকার দেওয়া ও নারীদের জন্য বিশেষ বাস চালুর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এতে বলা হয়েছে, প্রতিটি জোনে সুনির্দিষ্ট পার্কিং কাম কমার্শিয়াল কমপ্লেক্স নির্মাণ করা হবে। এ ছাড়া নগরীতে সাইকেল ব্যবহার উৎসাহিত করতে যেখানে সম্ভব সাইকেল লেন করা হবে। একই করপোরেশনে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী তাবিথ আউয়াল বলেন, ‘গণপরিবহন ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা আনতে সমন্বয়ের ওপর জোর দেব।’ সিপিবি-বাসদ সমর্থিত প্রার্থী আবদুল্লাহ আল ক্বাফী রতন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি নিজে বাসে চড়ি। বাসের ভেতরে বসার মতো অবস্থা থাকে না। এই গণপরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নের পাশাপাশি প্রাইভেট কার চলাচল নিয়ন্ত্রণের জন্য আমি জনমত গঠন করব। নির্বাচিত হলে প্রাইভেট কার নিয়ন্ত্রণে সিএনজি ব্যবহার বন্ধ, একদিন জোড় আরেক দিন বিজোড় নিবন্ধন নম্বরের প্রাইভেট কার চলাচলের বিষয়ে জনমত গড়ব। জনসমাগমস্থলে পার্কিং ধীরে ধীরে বন্ধ করা হবে।’ গণসংহতি আন্দোলনের প্রার্থী জোনায়েদ সাকি বলেন, একটি সভ্য শহরে গণপরিবহনের ব্যবস্থা না করে এভাবে প্রাইভেট কার বাড়তে পারে না। সিটি করপোরেশনের মধ্যে চলাচলকারী প্রাইভেট কারের ওপর কর আরোপের নীতিমালা করতে হবে। তা হলে যানজটের ভয়াবহতা থেকে এ নগরীকে কিছুটা হলেও মুক্ত করা যাবে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে (ডিএসসিসি) আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়র পদপ্রার্থী সাঈদ খোকন বলেন, ‘প্রাইভেট কার নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি গণপরিবহন ব্যবস্থাকে উন্নয়ন ও বর্ধিত করব।’ একই করপোরেশনে সিপিবি-বাসদ সমর্থিত প্রার্থী বজলুর রশীদ ফিরোজ বলেন, ‘নির্বাচিত হলে আমরা সরকারের কাছে অনুরোধ করতে পারব, জনমত তৈরি করতে পারব একটি শক্তিশালী গণপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য। প্রাইভেট কারে সিএনজি ব্যবহার বন্ধ রাখার সুপারিশ করব। সেই সঙ্গে বিদ্যমান রাস্তার সমান্তরাল, নিচে ও ওপরে রাস্তা তৈরি করতে হবে।’

No comments:

Post a Comment