Monday, May 11, 2015

ভেজাল ও নকল ওষুধের ছড়াছড়ি:কালের কন্ঠ

বনানী কড়াইল বস্তির রুখসানা বেগম শ্বাসকষ্ট নিয়ে যান স্থানীয় একজন ডাক্তারের কাছে। ডাক্তার তাঁকে একটি ইনহেলার ব্যবহারের পরামর্শ দেন। পাশেই একটি ফার্মেসিতে গেলে তাঁকে ধরিয়ে দেওয়া হয় 'ড্রিম ইনহেলার' নামের একটি ইনহেলার। বাসায় গিয়ে বারকয়েক ওই ইনহেলার ব্যবহারের পরও রুখসানার অবস্থার কোনো উন্নতি হয় না, উল্টো পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়। স্বজনরা দ্রুত তাঁকে নিয়ে যায় মহাখালী জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে
। কর্তব্যরত ডাক্তার জরুরি চিকিৎসা দিয়ে তাঁর শ্বাসকষ্ট কমিয়ে দেন। এ সময় চিকিৎসক আগের কেনা ইনহেলার দেখে জানান, এটি কোনো ইনহেলারই নয়, বরং ওই পদার্থটির সঙ্গে যে কেমিক্যাল রয়েছে তা ব্যবহারের ফলে রোগীর শ্বাসকষ্ট আরো বেড়ে গেছে। জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউটের রেসপিরেটরি মেডিসিনের বিশেষজ্ঞ ডা. কাজী সাইফুদ্দিন আহম্মেদ বেননূর কালের কণ্ঠকে বলেন, 'ইনহেলার খুবই স্পর্শকাতর একটি ওষুধ। ভেজাল বা নকল কোনো ইনহেলার ব্যবহারে রোগীর মারাত্মক ক্ষতি হয়ে যেতে পারে।' এভাবে ভেজাল ও নকল ওষুধ প্রতিদিন অসংখ্য মানুষের ক্ষতি বয়ে আনছে। আবার শুধু ওষুধই যে ভুয়া তা নয়, আছে ভুয়া ওষুধ কম্পানিও, যাদের মাধ্যমে এসব ভেজাল ও নকল ওষুধ দেশের প্রধান পাইকারি ওষুধ মার্কেট মিটফোর্ড হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে সারা দেশে। কেরানীগঞ্জের শহীদনগরের বেলায়েত হোসেনের চর্মরোগের চিকিৎসায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের একজন চিকিৎসক বেটনোভেট অয়েন্টমেন্ট ব্যবহারের পরামর্শ দেন। বেলায়েত তাঁর এলাকার একটি ফার্মেসি থেকে ওই ওষুধ কিনে ব্যবহার করতে থাকেন। এতে তাঁর রোগের উপসর্গ আরো বেড়ে যায়। পরে ওই ওষুধের মোড়ক দেখে চিকিৎসক জানান, ওষুধটি নকল কম্পানির। পরে অন্য চিকিৎসা দিয়ে তাঁকে সুস্থ করতে হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. সাইফুল ইসলাম ভূঁইয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বেটনোভেট একটি স্টেরয়েড আইটেম। এটি সঠিক মান ও মাত্রার না হলে ত্বকের মারাত্মক ক্ষতি বয়ে আনে।' ওষুধ বিশেষজ্ঞরা বলেন, বাংলাদেশের মতো এত বেশি ওষুধ তৈরি ও বাজারজাতের প্রবণতা বিশ্বের অন্য কোথাও নেই। ওষুধকে জীবন রক্ষাকারী পণ্য না ভেবে এক শ্রেণির ব্যবসায়ী অন্য কিছুর মতোই লাভজনক পণ্য হিসেবে বাণিজ্য করার লক্ষ্যে ওষুধের ব্যবসায় নামেন। সরকারের তরফ থেকেও এর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। ফলে চিকিৎসার সঙ্গে যুক্ত রোগী-চিকিৎসক ও বিক্রেতারা প্রতি মুহূর্তে বিভ্রান্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে জনসাধারণের মাঝে সচেতনতা বাড়াতে প্রচারণা দরকার বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক আ ব ম ফারুক কালের কণ্ঠকে বলেন, 'ভুয়া ও ভেজাল ওষুধ তৈরি ও বাজারজাতের প্রবণতা এ দেশে নতুন নয়। উপযুক্ত নিয়ন্ত্রণ ও কার্যকর পদক্ষেপের অভাবে এ অবস্থা চলছে। দেশের সব ধরনের নিম্নমানের ও ভেজাল ওষুধ ছড়ায় ঢাকার মিটফোর্ড মার্কেট হয়ে। একইভাবে এখানেই বিভিন্ন ধরনের ওষুধের ভেজাল কাঁচামাল বেচাকেনা হয়। কিভাবে এসব চলে, তা আমাদের বোধগম্য নয়। সরকারের উচিত এসব ক্ষেত্রে নজরদারি আরো বাড়ানো।' এদিকে গতকাল রবিবার দেশে ভেজাল ও নকল ওষুধ উৎপাদন এবং বাজারজাতকরণ রোধে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী মো. নাসিমের নেতৃত্বে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী, স্বাস্থ্যসচিব, ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, ওষুধ শিল্প সমিতির নেতারাসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন। এ সময় স্বাস্থ্যমন্ত্রী যেকোনো মূল্যে নকল ও ভেজাল ওষুধ প্রতিরোধে সরকার ও ওষুধ কম্পানিগুলোকে একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানান। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ওষুধ হচ্ছে মানুষকে বাঁচানোর একটি মাধ্যম। আর সেই ওষুধ ভেজাল ও নকল করে মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। বৈঠকে বেশ কিছু পদক্ষেপের বিষয়ে আলোচনা হয়। এদিকে গত বৃহস্পতিবার বিকেলে রাজধানীর বনানী এলাকায় অভিযান চালিয়ে একটি ভুয়া ওষুধ কম্পানি থেকে বিপুল পরিমাণ নকল ওষুধ উদ্ধার করেছে র‌্যাব। একই দিন কেরানীগঞ্জ থেকে আরো কিছু ভেজাল ও নকল ওষুধ আটক করা হয়। র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজেস্ট্রেট মোহাম্মদ আনিসুর রহমান কালের কণ্ঠকে জানান, এক শ্রেণির অসাধু লোক মানুষের জীবন রক্ষাকারী ওষুধের নামে প্রতারণায় নেমেছে। তাদের ব্যাপারে সতর্ক থাকা প্রয়োজন। ওষুধ কেনা ও সেবনের সময় সবাইকে সতর্ক থাকা উচিত। কোথাও কোনো ভুয়া ওষুধ কম্পানি ও ভেজাল-নকল ওষুধ তৈরি ও বেচাকেনার তথ্য জানা গেলে র‌্যাবকে অবহিত করার অনুরোধ জানান তিনি। র‌্যাবের মিডিয়া উইংয়ের সহকারী পরিচালক মাকসুদুল আলম জানান, বনানীর ওষুধ কম্পানিটি সরকারের ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের কোনো অনুমোদন বা লাইসেন্স ছাড়াই ২০১২ সাল থেকে বিভিন্ন নামে ভুয়া ওষুধ তৈরি করে বাজারে ছাড়ছিল। এসব ওষুধের মধ্যে রয়েছে ড্রিম ইনহেলার, নাইজেলা ক্যাপ, কার্ডিওকেয়ার, গ্লুকো কন্ট্রোল, ডি পাওয়ার, ডি-ভিট প্লাস, ড্রিম ক্যালরি, ড্রিম এলোভেরা ক্যাপ, স্পিরুলিনা, গ্যানোডার্মা মাইসোলিয়াম, জেনিটাল ক্রিম, গ্যানোডর্মো ননি ক্যাপসহ আরো কিছু ভুয়া ওষুধ, ফুড সাপ্লিমেন্টারি ও প্রশাসনসামগ্রী তৈরি ও বাজারজাত করে। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ আনিসুর রহমান বলেন, অভিযানের সময় তাৎক্ষণিকভাবে ১৯৪০ সালের ওষুধ আইনের আওতায় অপরাধ চিহ্নিত হওয়ায় ভুয়া ওই প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পরিচয়ধারী মঈন উদ্দিনকে দুই লাখ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে তিন মাসের কারাদণ্ডাদেশ প্রদান করার পাশাপাশি ওই কম্পানির কারখানা ও অফিস সিলগালা করে দেওয়া হয়। এ ছাড়া সম্প্রতি টাঙ্গাইলের একটি বাসায় র‌্যাবের আরেক টিম অভিযান চালিয়ে ভুয়া ওষুধ কারখানা আবিষ্কার করে। ওই বাসায় একটি টয়লেটে মিকশ্চার মেশিন বসিয়ে বিভিন্ন প্রকার ট্যাবলেট, ক্যাপসুল তৈরি করা হতো। ওই কারখানা থেকে আমলকী প্লাস, লাল ক্যাপসুল, জিংসান ক্যাপসুল, এন্টোস প্লাস, স্যালাইন, ইউনিক লাহাম উদ্ধারসহ বিভিন্ন যন্ত্রপাতি আটক করা হয়। একই সঙ্গে কারখানার মালিক ফিরোজ খানকে গ্রেপ্তার করে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে সাত দিনের জেল ও দুই লাখ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরো ছয় মাসের কারাদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়। অন্যদিকে শনিবার কেরানীগঞ্জের নেকরোজবাগ এলাকায় র‌্যাবের অভিযানে একটি প্রসিদ্ধ কম্পানির বহুল প্রচলিত ভেটনোভেট এন ও ভেটনোভেট সি অয়েন্টমেন্টের নকল আটক করা হয়। ভুয়া এসব অয়েন্টমেন্ট বিক্রির উদ্দেশে উৎপাদন করার অপরাধে মো. তরিকুল ইসলামকে (২৮) এক বছরের কারাদণ্ড এবং এক লাখ টাকা জরিমানা করেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। এ সময় ভাড়া করা দুই কক্ষের কারখানায় তিনটি প্রিন্টার ডাইস, দুটি কেমিক্যাল মিকশ্চার মেশিন, বিপুল পরিমাণ খালি প্যাকেট, একটি প্লাস্টিকের বস্তাভর্তি প্রায় ২০ কেজি মোম সদৃশ পদার্থ, দুটি লোহার তৈরি পাঞ্চ মেশিন, ১৫ কেজি কেমিক্যাল ও বিভিন্ন অয়েন্টমেন্ট এবং ক্রিম তৈরির যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল, বিভিন্ন সরঞ্জাম ও প্রস্তুতকৃত ক্রিম ও অয়েন্টমেন্ট জব্দ করা হয়। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, ভেজাল ও নকল ওষুধের দৌরাত্ম্যে দেশে অনেক রোগই নিয়ন্ত্রণে রাখা যাচ্ছে না। বরং এক রোগ থেকে নানা রোগের জন্ম হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সরকারের দিক থেকে আরো কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি। এ ছাড়া কোনটা আসল আর কোনটা নকল ওষুধ, তা নিয়ে মানুষ থাকে অন্ধকারে। তাই মানুষকে ওষুধ সম্পর্কে আরো সচেতন করা দরকার। বিশেষ করে ভালো মান ও গুণের ওষুধ সম্পর্কে সাধারণের মধ্যে প্রচার-প্রচারণাকেও এখন যুক্তিযুক্ত মনে করছেন অনেকে। বাংলাদেশ কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতির নেতা মনির হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী ওষুধ নিয়ে ভয়ংকর ব্যবসায় জড়িত, যাদের মাধ্যমে মিটফোর্ডের প্রকৃত ব্যবসা ও ব্যবসায়ীদের দুর্নাম হচ্ছে। অপরাধীচক্রের কারণে নিরীহ ব্যবসায়ীরাও হয়রানি ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।' তিনি বলেন, 'কম্পানিগুলো ওষুধ বানায়, এখানে পাইকারি বিক্রি হয়। এখানে কোনো ওষুধ নিম্নমানের, ভেজাল বা খারাপ হলে দোষ তো কম্পানির।' জানতে চাইলে সরকারের ওষুধ অধিদপ্তরের পরিচালক আবুল খায়ের চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, 'ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ ঠেকাতে আইন অনুসারে আমরা অনেক চেষ্টা করছি। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে আইনি ও প্রশাসনিক জটিলতায় কাজে অগ্রগতি কম হচ্ছে। আবার জনবল সংকটও একটা বড় সমস্যা।'

No comments:

Post a Comment