Tuesday, May 12, 2015

পরিবহন ও বিদ্যুৎ খাত সর্বোচ্চ গুরুত্ব পাচ্ছে:কালের কন্ঠ

বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের আন্দোলন এখন নেই। সরকারের নীতিনির্ধারকরা আশা করছেন, আগামী অর্থবছরে দেশে নতুন করে রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হবে না। ফলে সহিংসতা প্রতিরোধের দিকেও বিশেষ নজর দেওয়ার প্রয়োজন হবে না। এ সময়টি দেশের বড় অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য 'মোক্ষম সময়' বলে মনে করছেন নীতিনির্ধারকরা। রাজনৈতিক পরিবেশ স্থিতিশীল থাকলে সড়ক, রেল, বিদ্যুৎসহ অন্যান্য খাতে গত ছয় বছরে যেসব বড় প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছিল,
সেগুলোকে আগামী অর্থবছরের মধ্যেই সাধারণ মানুষের কাছে দৃশ্যমান করা যাবে বলে জানিয়েছেন তাঁরা। আর সে বিবেচনা থেকেই আগামী অর্থবছরের বাজেটে পরিবহন ও বিদ্যুৎ খাতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে। পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। সূত্র মতে, জনসাধারণের মন তুষ্ট করতে আগামী অর্থবছরের বাজেটে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে পরিবহন খাতে। এখানে রয়েছে পদ্মা সেতু, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ, জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ ও মেট্রো রেলের মতো জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প। সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় বিদ্যুৎ সুবিধা পৌঁছে দিতে আসন্ন বাজেটে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বরাদ্দ রাখা হচ্ছে বিদ্যুৎ খাতে। এই খাতে রয়েছে ভারত থেকে আরো ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি, মাতারবাড়ীতে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং ঘোড়াশাল ও ভোড়ামারা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের মতো প্রকল্প। একই সঙ্গে তৃণমূল পর্যায়ে জনতুষ্টি অর্জন করতে সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, জেলা ও উপজেলা উন্নয়নে 'বিশেষ সহায়তা' বরাদ্দ থাকছে নতুন অর্থবছরের বাজেটে। এসব উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সামনে টাকার কোনো অভাব নেই, কিন্তু বড় বাধা হিসেবে সামনে হাজির হওয়ার ভয় থাকে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা। অবশ্য পূর্বানুমানকালে অর্থমন্ত্রী ধরে নিচ্ছেন, আগামী অর্থবছর দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ স্থিতিশীল থাকবে। পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা যায়, আগামী অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) ৯২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা চূড়ান্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ৫৮ হাজার কোটি টাকা পাওয়া যাবে। বাকি ৩৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলোর কাছ থেকে পাওয়া যাবে বলে আশা করছে সরকার। এই ৯২ হাজার ৫০০ কোটি টাকার মধ্যে পরিবহন খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২০ হাজার ২৩৫ কোটি টাকা, যা মোট বরাদ্দের ২২ শতাংশ। এর মধ্যে পদ্মা সেতুর জন্য রাখা হয়েছে সাত হাজার ৫০০ কোটি টাকা। পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুুস্তফা কামাল জানিয়েছেন, আগামী অর্থবছরেই পদ্মা সেতুর কাজে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি আসবে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণের কাজ আগামী বছরই শেষ করতে চায় সরকার। সে জন্য আসন্ন বাজেটে এই প্রকল্পের জন্য রাখা হয়েছে ৭০০ কোটি টাকা। এ ছাড়া দ্বিতীয় কাঁচপুর, মেঘনা, গোমতী সেতুর জন্য ৮১৬ কোটি, মেট্রো রেল প্রকল্পে ৪০০ কোটি, জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্পে ২৫১ কোটি, বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পে ১১৫ কোটি, জয়দেবপুর-টাঙ্গাইল মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণের জন্য ৩৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছে কমিশন। আগামী ১৪ মে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) সভায় নতুন অর্থবছরের এডিপি অনুমোদন পাওয়ার কথা রয়েছে। সভায় সভাপতিত্ব করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অবশ্য গত কয়েক বছরের এনইসি সভায় প্রধানমন্ত্রী তাঁর ক্ষমতাবলে নতুন এডিপিতে বাড়তি অর্থ বরাদ্দ দেওয়ার ঘোষণা দেন। সে হিসাবে আসন্ন বাজেটে এডিপির আকার ৯৫ হাজার কোটি টাকা হতে পারে বলে জানা গেছে। জানা যায়, অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে ভারত থেকে এখন বাংলাদেশ ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করছে। গত মাসে আরো ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। ভারতের বহরমপুর থেকে ৫০০ মেগাওয়াট এবং ত্রিপুরা থেকে ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করতে গত মাসে একনেক সভায় আলাদা দুটি প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়। বহরমপুর থেকে বিদ্যুৎ আমদানির লক্ষ্যে আসছে বাজেটে প্রায় ২০০ কোটি টাকা রাখা হয়েছে। এ ছাড়া ত্রিপুরা থেকে বিদ্যুৎ আমাদানিতে লাইন নির্মাণের জন্য রাখা হয়েছে ৮০ কোটি টাকার মতো। অন্যদিকে মাতারবাড়ীতে এক হাজার ৩০০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ পুরোদমে শুরু হওয়ায় ওই প্রকল্পের জন্য আসছে বাজেটে প্রায় ২৫০ কোটি টাকা রাখা হয়েছে। উৎপাদন ও সঞ্চালনের জন্য গত ছয় বছরে যেসব বড় প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল, সেগুলো শেষ করতে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এরই আলোকে ঘোড়াশাল ৩৬৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ৫৭০ কোটি, ভেড়ামারা ৩৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রে ৫৮০ কোটি, খুলনা ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রে ৫০০ কোটি, পটুয়াখালীর পায়রায় এক হাজার ৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে ভূমি অধিগ্রহণের জন্য ৫২৪ কোটি, সিদ্ধিরগঞ্জ ৩৩৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রে ৫২০ কোটি এবং আশুগঞ্জ ৪৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ৬৬০ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছে পরিকল্পনা কমিশন। সব মিলিয়ে বিদ্যুৎ খাতে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৫ হাজার ৪৮৫ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে, যা এডিপিতে মোট বরাদ্দের ১৭ শতাংশ। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত গত শনিবার বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পিআরআইয়ের এক সেমিনারে যোগ দিয়ে পরিবহন ও বিদ্যুৎ খাতে সর্বোচ্চ অর্থ বরাদ্দ রাখা হবে বলে জানিয়েছিলেন। জানা যায়, পরিকল্পনা কমিশন অগ্রাধিকারের যে তালিকা করেছে, তাতে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে ভৌত পরিকল্পনা ও পানি সরবরাহ খাত। রাজউক, এলজিইডিসহ বিভিন্ন সিটি করপোরেশনের অবকাঠামো উন্নয়ন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তুষ্ট করার খাত হলো ভৌত উন্নয়ন। এই খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১০ হাজার ৪৬১ কোটি টাকা, যা মোট বরাদ্দের ১১ শতাংশ। এই খাতেই রয়েছে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটির উন্নয়ন, চট্টগ্রাম সিটির উন্নয়ন, মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স নির্মাণ, র‌্যাবের জন্য অকাঠামো উন্নয়ন, পুলিশের জন্য থানা নির্মাণ, মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভার নির্মাণের মতো প্রকল্প। সাধারণ মানুষের মন তুষ্ট করতে গিয়ে বাজেট বরাদ্দের ক্ষেত্রে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাত পিছিয়ে পড়ছে। বিভিন্ন গবেষণা সংস্থা ও এনজিওর দাবি সত্ত্বেও এসব খাতে বরাদ্দ আশানুরূপ বাড়ায়নি সরকার। বাড়ানোর সুযোগও নেই সম্পদের সীমাবদ্ধতার কারণে। আসছে বাজেটে শিক্ষা খাতে চতুর্থ সর্বোচ্চ অর্থ বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এই খাতে ১০ হাজার ৩৯ কোটি টাকা রাখা হয়েছে, যা মোট বরাদ্দের ১০ শতাংশ। পল্লী উন্নয়ন ও পল্লী প্রতিষ্ঠান রয়েছে পাঁচে। এই খাতে রাখা হয়েছে আট হাজার ৪৩৫ কোটি টাকা। এর মাধ্যমে পল্লী অঞ্চলে বিভিন্ন অবকাঠামো উন্নয়ন করবে সরকার। ষষ্ঠ অবস্থানে রয়েছে স্বাস্থ্য খাত। এই খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ছয় হাজার ৮১ কোটি টাকা। আর কৃষি খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে চার হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা, যা মোট বরাদ্দের মাত্র ৫ শতাংশ। আসছে বাজেটে সিটি করপোরেশনের উন্নয়নে বিশেষ সহায়তা বাবদ রাখা হয়েছে ২১০ কোটি টাকা। এ ছাড়া পৌরসভার উন্নয়নে বিশেষ সহয়তা বাবদ ৩৭০ কোটি, জেলা পরিষদের জন্য ৩৮০ কোটি, উপজেলা পরিষদের জন্য ৪৩০ কোটি টাকা রাখা হয়েছে। শিক্ষাবিদ, কৃষিবিদ ও স্বাস্থ্য খাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিশেষজ্ঞরা বরাবরই এসব খাতে বরাদ্দ বাড়াতে সরকারের প্রতি অনুরোধ জানিয়ে আসছেন। কিন্তু এসব খাতে বরাদ্দ বাড়ানো হচ্ছে না। বরং সরকারের মনোযোগ বেশি অবকাঠামো নির্মাণের দিকে। মানবসম্পদ উন্নয়নে বিশেষ নজর দিতে অর্থনীতিবিদরা প্রাক-বাজেট আলোচনায় পরামর্শ দিয়েছেন অর্থমন্ত্রীকে। কিন্তু আসছে বাজেটে মানবসম্পদ উন্নয়নেও আশানুরূপ বরাদ্দ থাকছে না। চলতি অর্থবছরের এডিপির আকার ছিল ৮০ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরে তা ২৩ শতাংশ বাড়ছে।

No comments:

Post a Comment