থাইল্যান্ডে ব্যাপক ধরপাকড় এবং মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার সমুদ্র উপকূলে অনাহারে মরতে বসা আশ্রয়প্রার্থী অভিবাসীদের নিয়ে নানা উদ্বেগ ও আন্তর্জাতিক নানা চাপ সত্ত্বেও এখনো সক্রিয় মানবপাচারকারীরা। থাই পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার এড়াতে তারা অভিবাসীদের নৌকাগুলোকে তীরে ভিড়তে না দিয়ে নতুন সংকট তৈরি করছে। আর মিয়ানমারের উপকূলে পাচারকারীরা এখনো পাঁচটি নৌকায় প্রায় এক হাজার অভিবাসীকে আটকে রেখে মুক্তিপণ আদায়ের চেষ্টা
করছে। অন্যদিকে ইঞ্জিন মেরামত করে ও দুই দিনের খাবার দিয়ে থাইল্যান্ড উপকূল থেকে ফেরত পাঠানো ৩০০ অভিবাসীবাহী নৌকাটি মালয়েশিয়া কর্তৃপক্ষও ফেরত পাঠানোর পর এর আর কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। মিয়ানমারে জিম্মি এক হাজার অভিবাসী : ব্যাংককে কর্মরত বিবিসির সাংবাদিক জোনাহ ফিশার জানান, মানবপাচারকারীদের পাঁচটি নৌকা এ মুহূর্তে মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলীয় উপকূলে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমার কাছে অপেক্ষা করছে। নৌকাগুলোতে অন্তত এক হাজার অভিবাসী রয়েছে। জোনাহ ফিশার বলেন, বিবিসির স্থানীয় প্রতিনিধি জানিয়েছেন থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার কঠোর অবস্থানের কারণে মিয়ানমারের ওই পাচারকারীরা নৌকাগুলো নিয়ে সমুদ্রে রওনা দিতে ইচ্ছুক নয়। একই সঙ্গে নৌকায় থাকা অভিবাসীদের বিনা মুক্তিপণে ছেড়ে দিতেও অস্বীকার করে আসছে তারা। মুক্তিপণ পেলেই কেবল এই এক হাজার অভিবাসীকে মিয়ানমার উপকূল থেকে মুক্তি দিতে পারে পাচারকারীরা। তবে এই পাঁচটি নৌকায় জিম্মি করে রাখা অভিবাসীরা শুধু মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নাকি বাংলাদেশের নাগরিকও রয়েছে সে সম্পর্কে কিছু জানা যায়নি। থাই-মালয় সাগরে সক্রিয় পাচারকারীরা : আন্তর্জাতিক উদ্বেগ সত্ত্বেও পাচারকারীরা সক্রিয় রয়েছে থাইল্যান্ড উপকূলেও। সেখানে সাগরে ভেসে বেড়ানো নৌকাগুলোতে এখনো দালালদের উপস্থিতির কারণে অভিবাসীদের অবস্থা আরো জটিল হয়ে উঠেছে। আশ্রয় দিতে মালয়েশিয়ার অস্বীকৃতি এবং বারবার ফেরত পাঠানোর পরও এসব দালাল যেকোনো মূল্যে অভিবাসীদের মালয়েশিয়ায় ঢোকাতে চাচ্ছে। মূলত থাইল্যান্ডে গ্রেপ্তার এড়াতে তারা অভিবাসীদের জীবন সংকটের মুখে ফেলছে। এসব তথ্য জানিয়ে ব্যাংককে জাতিসংঘ শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশন ইউএনএইচসিআরের মুখপাত্র ভিভিয়ান ত্যান গতকাল রবিবার জানিয়েছেন, সংস্থাটি জানতে পেরেছে একটি নৌকায় একজন বা দুজন 'শক্তিশালী' ব্যক্তি রয়েছে, যারা অভিবাসীদের দলটিকে বলতে বাধ্য করছে, তারা যেন পথে বাধাপ্রাপ্ত হলে একই কথা বলে, 'তারা মালয়েশিয়া যেতে চায়।' এমন আভাস পাওয়া গেছে থাই সেনাবাহিনীর বক্তব্যেও। থাইল্যান্ড গতকাল আবারও জানিয়েছে, তারা সাগরে চলমান সংকটে অভিবাসীদের কোনো নৌকাই সমুদ্রে ফেরত পাঠায়নি। উল্টো অভিবাসীদের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, তারা ইচ্ছা করলে তীরে উঠতে পারবে। কিন্তু নৌকারোহীরা এ প্রস্তাব গ্রহণ করেনি। এ ছাড়া গত শনিবার বিকেলে থাই নৌবাহিনী আরো একটি অভিবাসী নৌকার ইঞ্জিন মেরামত করে দেয়। তখন অভিবাসীদের ইচ্ছা অনুযায়ী নৌকাগুলোকে দক্ষিণ দিকে (মালয়েশিয়া) যাওয়ার পরামর্শ দেয়। থাইল্যান্ড সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট কমান্ডার উইরাপোং নাকপ্রাজিত সাংবাদিকদের বলেন, 'অভিবাসীরা বারবার বলছিল তারা থাইল্যান্ড নয়, অন্য দেশে যেতে চায়। আমরা তখন তাদের খাদ্য, পানি ও কিছু ওষুধ সঙ্গে দিয়ে দেই। এ ছাড়া অন্য যেকোনো নতুন নৌকা এলেই আমরা মানবিক সাহায্য প্রদান করব।' খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না সেই নৌকাটির : এএফপি জানায়, একটি নৌকার ৩০০ অভিবাসীর ভাগ্য অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। অতিরিক্ত বোঝাই এ ট্রলারটি গত রবিবার প্রথম মালয়েশিয়া উপকূলে আশ্রয় নিতে চেয়েছিল। নৌকাটির অবস্থা ছিল শোচনীয়। অনাহারের ফলে এর আরোহীদেরও পাতলা ও ক্ষীণ দেখা যায়। তাতে অনেক নারী ও শিশু ছিল। কিন্তু মালয়েশিয়া কর্তৃপক্ষ নৌকাটিকে সাগরে ফেরত পাঠায়। পরে থাইল্যান্ডের পর্যটন দ্বীপ কোহ লিপে গত বৃহস্পতিবার থাই নৌবাহিনী নৌকাটির শোচনীয় অবস্থা দেখে আরোহীদের দুদিন চলার মতো খাদ্য ও পানি সরবরাহ করে এবং ত্রুটিপূর্ণ ইঞ্জিন মেরামত করে দেয়। পরে আবার সেটি মালয়েশিয়ার পথে রওনা দেয়। কিন্তু গতকাল রবিবার পর্যন্ত নৌকাটির হদিস কোথাও পাওয়া যায়নি। জীবন সংকটে পড়া এর আরোহীদের খোঁজ নিতে গিয়ে থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া- কোনো দেশের কর্তৃপক্ষের কাছ থেকেই কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। নৌকাটি দেখতে পাননি উপকূলে দায়িত্ব পালনকারী সাংবাদিকরাও। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন থাই কর্মকর্তা জানান, তাঁরা যত দূর জানতে পেরেছেন, নৌকাটি মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার সমুদ্রসীমার মাঝামাঝি এলাকায় এদিক-সেদিক ঘোরাফেরা করছে। এ বিষয়ে মানবাধিকার সংস্থা 'অ্যামি স্মিথ অব ফর্টিফাই রাইটস' বলেছে, সাগরে ভাসমান মানুষগুলোকে নিয়ে দেশগুলো যে 'পিং-পং' (টেবিল টেনিস বল) খেলায় মেতে উঠেছে, এ ঘটনা তারই প্রমাণ। সমন্বিত উদ্যোগের আভাস, মিয়ানমারকে চাপ মালয়েশিয়ার : ওই অঞ্চলে মানবপাচার রোধে থাইল্যান্ডের ডাকা আঞ্চলিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে আগামী ২৯ মে। কিন্তু চলমান মানবিক সংকট বিবেচনায় তা অনেক দূর। বর্তমান পরিস্থিতিতে করণীয় ঠিক করতে মালয়েশিয়া দ্রুত থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া ও মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনা করতে চায়। গতকাল মালয়েশিয়া জানিয়েছে, দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনিফাহ আমান শিগগিরই এ বিষয়ে থাইল্যান্ড ও ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করবেন। সাগরে মানবিক সংকট ক্রমেই বাড়তে থাকায় আন্তর্জাতিক চাপের মুখে একটি সমন্বিত চেষ্টার অংশ হিসেবে মালয়েশিয়া আলোচনার উদ্যোগ নিচ্ছে। এ লক্ষ্যে আজ সোমবারই আনিফাহ ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেতনো মারসুদির সঙ্গে বৈঠক করতে পারেন বর্নিও দ্বীপের একটি শহরে। আর থাই পররাষ্ট্রমন্ত্রী তানাসাক পাতিমাপ্রাগর্নের সঙ্গে বৈঠকে বসতে পারেন আগামী বুধবার। এ ছাড়া ওই অঞ্চলে মানবপাচার বন্ধের ব্যবস্থা গ্রহণে আগামী ২৯ মে অনুষ্ঠেয় সম্মেলনে যোগ দিতে মিয়ানমারকে গতকাল চাপ দিয়েছে মালয়েশিয়া। না হলে আসিয়ানের চেয়ারম্যান হিসেবে মালয়েশিয়া সংস্থাটির জরুরি শীর্ষ সম্মেলন আহ্বান করতে পারে। অন্যদিকে অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী টনি অ্যাবোট মানবপাচার বন্ধ করতে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তবে নিজ দেশে অবৈধ অভিবাসীদের নৌকা ভিড়তে না দেওয়ার সিদ্ধান্তে অটল থাকা অ্যাবোট মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও ইন্দোনেশিয়ার সিদ্ধান্তেও সমর্থন জানান। সূত্র : বিবিসি, এএফপি, বার্নামা ও ব্যাংকক পোস্ট।
No comments:
Post a Comment