![](https://lh3.googleusercontent.com/-L5n5fqnvgYU/VVaXQkvmylI/AAAAAAAAN9Q/-HHs15t7epU/01_222450.jpg)
রামত করে দিয়ে ফের গভীর সমুদ্রে ঠেলে দিচ্ছে। অথচ আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী যেকোনো বাণিজ্যিক জাহাজ ও সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সরকার এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে বাধ্য। এরই মধ্যে গতকাল শুক্রবার ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ডের উপকূল থেকে এক হাজার ৩৯ জনকে উদ্ধার করা হয়েছে। তবে তাদের কাউকেই সরকারিভাবে উদ্ধার করা হয়নি। ইন্দোনেশিয়ার আচেহ প্রদেশের সমুদ্র উপকূলে একটি নৌকা ডুবে যাওয়ার সময় স্থানীয় জেলেরা ৭৯৭ জনকে এবং আচেহ ও সুমাত্রার আরো দুটি স্থান থেকে বিপর্যস্ত অবস্থায় জেলেরা আরো ১৪৩ জনকে উদ্ধার করে। আর থাইল্যান্ডের ফেং এনগা প্রদেশের সুরিন দ্বীপে আশ্রয় নিয়েছে ১০৬ অভিবাসী, তাদের কিভাবে উদ্ধার করা হয়েছে- জানে না থাই পুলিশ। মানবিক বিপর্যয়ে নির্বিকার তিন দেশ : জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা- আইএমও এবং রোহিঙ্গাদের মানবাধিকারবিষয়ক সংস্থা আরাকান প্রজেক্টের মতে, গত ১ মে থাইল্যান্ডের জঙ্গলে পাচারবিরোধী অভিযান শুরুর পর অন্তত আট হাজার অভিবাসী সাগরে আটকে পড়ে। তাদের মধ্যে গতকাল পর্যন্ত প্রায় তিন হাজার অভিবাসী তিনটি দেশের তীরে উঠতে পেরেছে। বাকিদের ভাগ্য সম্পর্কে কিছু জানা যায়নি। সর্বশেষ ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ডে এক হাজারের বেশি বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা আশ্রয় পেলেও গতকালও ইন্দোনেশিয়ায় দুটি এবং থাইল্যান্ডে একটি অভিবাসীবাহী নৌকা ফিরিয়ে দেওয়া হয়। এর আগের দিন বৃহস্পতিবার মালয়েশিয়া দুটি এবং থাইল্যান্ড একটি নৌকা ফিরিয়ে দেয়। গত কিছুদিনে অন্তত ১০টি নৌকা ফিরিয়ে দেয় এ তিনটি দেশ। ফিরিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ডের বক্তব্য অভিন্ন, অভিবাসীরা তাদের দেশে আশ্রয় নিতে চায়নি, তারা মালয়েশিয়া যেতে চায়। মালয়েশিয়া অভিবাসীদের খাদ্য ও পানি সরবরাহ করে তাদের আশ্রয় দিতে অস্বীকৃতি জানায়। তিনটি দেশের উপকূলে আশ্রয় না পেয়ে সাগরে ফিরে যাওয়া নৌকাগুলোর প্রায় প্রতিটিতেই ৫০০ থেকে ৮০০ অভিবাসী রয়েছে। তাদের বেশির ভাগই মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিম হলেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় বাংলাদেশি রয়েছে। এর মধ্যে একটি নৌকায় ১০ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। মৃত্যুর পর তাদের মৃতদেহ সাগরের পানিতে ফেলে দেওয়া হয়। নৌকাটির আরোহীরা গত বৃহস্পতিবার বিবিসিকে এ তথ্য জানিয়েছে। ক্ষুধা, তৃষ্ণায় ভোগা এবং অসুস্থ হয়ে পড়া এসব অভিবাসী কোনো উপকূলে গিয়েই আশ্রয় পাচ্ছে না। মানবাধিকার সংস্থাগুলো এ তিন দেশের ঠেলাঠেলি খেলা বন্ধ করার আহ্বান জানালেও কোনো ভ্রুক্ষেপ করছে না সরকারগুলো। সর্বশেষ উদ্ধার ১০৩৯ : গতকাল ইন্দোনেশিয়ার আচেহ প্রদেশের লাংসা সমুদ্র উপকূল থেকে ৭৯৭ অভিবাসীকে উদ্ধার করা হয়। এদের মধ্যে ৬১ জন নারী ও ৬১টি শিশু রয়েছে। এদের মধ্যে ৪৩২ জন বাংলাদেশি রয়েছে। পুলিশ জানিয়েছে, যে নৌকাটি থেকে ৭৯৭ জনকে উদ্ধার করা হয় তাদের মালয়েশিয়ার উপকূল থেকে বিতাড়িত করা হয়েছিল। সেখান থেকে আচেহ প্রদেশে পূর্ব উপকূলে এসে নৌকাটি ডুবতে বসেছিল। অর্ধেক ডুবে যাওয়ার সময় তা স্থানীয় জেলেদের চোখে পড়ে। তারা এগিয়ে গিয়ে তাদের তীরে নিয়ে আসে। পরে পুলিশ তাদের জিম্মায় নেয়। জেলেদের উদ্ধৃত করে পুলিশ আরো জানায়, নৌকাটি ডুবে যাওয়ার সময় অনেকে লাফিয়ে পড়ে আহত হয়। অনেকের হাত-পা ভেঙে যায়। ক্ষুধা ও তৃষ্ণায় তাদের অবস্থা ছিল করুণ। নৌকাটি অতিরিক্ত বোঝাই ছিল। আহতদের অনেককে হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে বলে পুলিশ জানায়। লাংসার পুলিশ প্রধান সুনার্জর্ বলেন, 'প্রাথমিকভাবে আমরা তাদের কাছ থেকে জানতে পেরেছি তারা মালয়েশিয়া যাচ্ছিল। কিন্তু সে দেশের নৌবাহিনী তাদের ইন্দোনেশিয়ার জলসীমায় ঠেলে দেয়।' একই দিন একই উপকূলের কাছাকাছি অন্য আরেকটি নৌকায় ছিল ৪৭ অভিবাসী। ক্ষুধার্ত এসব মানুষ পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে উদ্ধারের মিনতি জানায়। তাদেরও স্থানীয় জেলেরা উদ্ধার করে। এ ছাড়া গতকাল প্রথম প্রহরে (বৃহস্পতিবার রাত) ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপের উত্তর উপকূলে ৯৬ অভিবাসীকে উদ্ধার করে জেলেরা। তবে গতকাল ইন্দোনেশিয়া কর্তৃপক্ষ অভিবাসীদের দুটি নৌকা ফেরত পাঠায়। অন্যদিকে থাইল্যান্ডে ফেং এনগা প্রদেশের সুরিন দ্বীপপুঞ্জের একটি ছোট দ্বীপ থেকে ১০৬ জন বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করে পুলিশ। তবে তারা কিভাবে উদ্ধার হয়েছে, সে সম্পর্কে পুলিশ কিছু বলতে পারেনি। এ বিষয়ে ফেং এনগা প্রদেশের গভর্নর প্রায়ুন রাত্তানাসিনি বলেন, তারা কিভাবে দ্বীপে উঠল এ বিষয়ে কিছু জানা যায়নি। তারা প্রকৃতপক্ষে মানবপাচারের শিকার কি না এবং তাদের জাতীয়তা পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। এর আগে গতকাল সকালে থাইল্যান্ডের উপকূল থেকে ৩০০ অভিবাসীবাহী একটি নৌকা ফিরিয়ে দেওয়া হয়। থাই কর্তৃপক্ষ জানায়, তারা নৌকাটির ইঞ্জিন মেরামত করে দিয়েছে। সঙ্গে কিছু খাদ্যও দেওয়া হয়েছে। আশ্রয় না দেওয়ার সিদ্ধান্তে অটল, অদ্ভুত যুক্তি : মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী নাজিব আব্দুল রাজাক গতকাল তাঁর নিজের ব্লগে এক বিবৃতিতে বলেছেন, 'মালয়েশিয়া মানবপাচার সহ্য করবে না।' তিনি বলেন, 'আমি অভিবাসীদের অবস্থা জেনে খুবই উদ্বিগ্ন।' কিন্তু সাগরে ভাসা অভিবাসীদের আশ্রয় দেওয়ার ব্যাপারে তিনি বিবৃতিতে কিছু বলেননি। তবে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়বিষয়ক মন্ত্রী মালয়েশিয়ার পক্ষে আর রোহিঙ্গা অভিবাসীর ভার বহন করা সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন। জাতিসংঘের উচিত, এসব অভিবাসীকে কম্বোডিয়া বা ফিলিপাইনে পাঠানো, না হয় তাদের নিজ দেশে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো। কারণ কম্বোডিয়া মিয়ানমারের কাছের এবং বন্ধু দেশ। এ ছাড়া দুটি দেশই ১৯৫১ সালের জাতিসংঘ শরণার্থী কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী দেশ। এ ছাড়া মালয়েশিয়ার উপস্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তুয়াংকো জাফর বলেন, মালয়েশিয়া সরকার উদ্ধারকৃত বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গাদের দেখভাল করবে। তিনি বলেন, তবে মালয়েশিয়া আর কোনো অভিবাসীবাহী নৌকা ভিড়তে দেবে না। নৌকাগুলো ঠিকঠাক থাকলে তা ফেরত পাঠানো হবে। তাদের নিজ দেশে আশ্রয় না দেওয়ার ব্যাপারে তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের মাধ্যমে সংক্রামক রোগ ছড়াচ্ছে মালয়েশিয়ায়। গত ৪০ বছর মালয়েশিয়ায় যক্ষ্মা রোগ ছিল। কিন্তু রোহিঙ্গা আসার পর থেকে এ রোগ ছাড়াও হেপাটাইটিস 'বি' ও 'সি'র সংক্রমণ দেখা যাচ্ছে। অন্যদিকে থাই কর্তৃপক্ষ জানিয়ে আসছে, তাদের উপকূলে যেসব অভিবাসীর নৌকা ভিড়ছে, তারা আসলে মালয়েশিয়া যেতে চায়। তাদের খাবার দিয়ে ফেরত পাঠানো হচ্ছে। থাই নৌবাহিনীর মুখপাত্র বলেন, গতকাল একটি নৌকা নষ্ট হয়ে গেলে প্রকৌশলীরা সেটির ইঞ্জিন মেরামত করে ফেরত পাঠান। ইন্দোনেশিয়ার সমুদ্রবিষয়ক মন্ত্রী ড. ইন্দ্রজিওনি সোয়েসিলো বলেন, ইন্দোনেশিয়া অভিবাসীদের খাদ্য ও আশ্রয় দিয়ে যাবে। তবে অবৈধ অভিবাসীদের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এ ক্ষেত্রে 'অবৈধ অভিবাসী'র অজুহাত তুলে আশ্রয় না দেওয়ার সিদ্ধান্তে অটল রয়েছে ইন্দোনেশিয়া। মিয়ানমারও নিজের অবস্থায় অটল : অন্যদিকে, থাইল্যান্ডের ডাকা আগামী ২৯ মে মানবপাচারবিষয়ক আঞ্চলিক সম্মেলনে যোগ না দেওয়ার কথা জানিয়েছে মিয়ানমার। বাংলাদেশসহ ১৫টি দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও কর্মকর্তারা এতে যোগ দেবেন বলে ধারণা করা হলেও মিয়ানমার জানিয়েছে তারা এ সম্মেলনে যোগ দেওয়ার কোনো যুক্তি নেই। কারণ এই অঞ্চলে মানবপাচারের সমস্যাটি থাইল্যান্ডের এবং রোহিঙ্গারা তাদের দেশের নাগরিক নয়। এ ছাড়া সম্মেলনে রোহিঙ্গা ইস্যু উত্থাপন করায় মিয়ানমার চটেছে। কারণ দেশটি মনে করে, রোহিঙ্গা বলতে কিছু নেই, তারা বাঙালি। আন্তর্জাতিক আইন মানতে বাধ্য : অন্যদিকে সমুদ্রবিষয়ক মানবাধিকার সংস্থা 'হিউম্যান রাইটস অ্যাট সি' প্রতিষ্ঠাতা ও সমুদ্র আইন বিশেষজ্ঞ ডেভিড হ্যামন্ড বলেছেন, আন্তর্জাতিক সমুদ্র আইন অনুযায়ী থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া কর্তৃপক্ষ সমুদ্রে ভাসমান লোকদের উদ্ধারে বাধ্য। এ বিষয়ে ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব শিপিং (আসিএস) জানিয়েছে, যেকোনো বাণিজ্যিক জাহাজ ও সংশ্লিষ্ট সমুদ্র এলাকার সরকার ইন্টারন্যাশনাল ম্যারিটাইম ল অ্যান্ড কনভেনশন অনুযায়ী সাগরে বিপর্যস্ত মানুষকে সাহায্য করতে বাধ্য। সামুদ্রিক ঐতিহ্যের অংশ হিসেবেও বিপদগ্রস্ত অভিবাসীদের তীরে নিয়ে আসার জন্য দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানান আইসিএসের মুখপাত্র সিমন বেনেট। এ ছাড়া জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) সদস্য হিসেবে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া সাগরে নৌকায় ভাসা মানুষগুলোকে উদ্ধার করতে বাধ্য। সাগরে আটকেপড়াদের উদ্ধারে বান কি মুনের আহ্বান : জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন গতকাল এক বিবৃতিতে থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, সাগরে গত কয়েক দিন ধরে আটকেপড়া রোহিঙ্গাদের উদ্ধারে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোকে একত্রে কাজ করা উচিত। তিনি আটকেপড়া অভিবাসীদের ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। জাতিসংঘ মহাসচিব আশ্রয়প্রার্থীদের সময়মতো তীরে ওঠার ব্যবস্থা এবং এ জন্য বন্দর উন্মুক্ত করে দেওয়ার আহ্বান জানান। এর আগে জাতিসংঘ শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশন, আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা, হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ অনেক সংস্থা ভাসমান অভিবাসীদের উদ্ধারে ব্যবস্থা গ্রহণ করার আহ্বান জানালেও তাতে কর্ণপাত করছে না থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া। সূত্র : এএফপি, ব্যাংকক পোস্ট, জাকার্তা পোস্ট, আল জাজিরা, দি সানডেইলি, ফুকেটওয়ান, মালয়মেইল ও কম্বোডিয়া ডেইলি।
No comments:
Post a Comment