দেশের উৎপাদনমুখী শিল্প খাতের ভালো উদ্যোক্তারা বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে অচিরেই কম সুদে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ নিতে পারবেন। এ টাকা দেশের ভেতরে উৎপাদনমুখী নতুন শিল্প স্থাপন, আগে স্থাপিত শিল্পকারখানার আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণ কাজে ব্যবহার করতে পারবেন উদ্যোক্তারা। তবে এ টাকা কোনোক্রমেই সেবা খাতের নতুন শিল্প স্থাপনে, আগে স্থাপিত শিল্প আধুনিকায়নে বা সম্প্রসারণে ব্যবহার করা যাবে না। দেশের শিল্প খাতে কম সুদে দীর্ঘম
েয়াদি ঋণের জোগান বাড়াতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ উদ্যোগ নিয়েছে। এ লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিশ্বব্যাংকের সমন্বয়ে ৩০ কোটি ডলারের (স্থানীয় মুদ্রায় প্রায় ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা) একটি তহবিল গঠন করার প্রক্রিয়া প্রায় চূড়ান্ত হয়েছে। এ তহবিলে অর্থের জোগান দিতে গত ৫ মে ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত বিশ্বব্যাংকের বোর্ড সভায় বাংলাদেশের আর্থিক খাত সংস্কারে ‘আর্থিক খাতে সহায়তা’ (এফএসএস) শীর্ষক একটি প্রকল্প অনুমোদন করা হয়েছে। এর মাধ্যমে আর্থিক খাত সংস্কারের জন্য বাংলাদেশ বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে পাবে ৩০ কোটি ডলার। এর মধ্যে ২৫ কোটি ৪০ লাখ ডলার ব্যয় করা হবে শিল্প খাতে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ তহবিল গঠনে। যা মোট ঋণের প্রায় ৮৫ শতাংশ। বাকি ৪ কোটি ৬০ লাখ ডলার বাংলাদেশ ব্যাংক দেবে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে। এ বিষয়ে অচিরেই বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক এম আবদুল হক যুগান্তরকে বলেন, আমরা আশা করছি, আর কিছু আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে তাড়াতাড়িই এ তহবিল থেকে ঋণ বিতরণ শুরু করতে পারব। এ কাজ শুরু হলে বিশেষ করে দেশের শিল্প খাত উপকৃত হবে। উদ্যোক্তারা কম সুদে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ পাবেন। বৈদেশিক মুদ্রায় এ ঋণ দেয়া হবে বলে আমাদের রিজার্ভের ওপর শিল্পের যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানিজনিত চাপ কমে যাবে। আর এর মধ্য দিয়ে উদ্যোক্তারাও উপকৃত হবেন। দেশে কর্মসংস্থান বাড়বে। এর প্রভাবে বাজারে ঋণের সুদের হার কমার একটি ক্ষেত্র তৈরি হবে। সূত্র জানায়, ইতিমধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ তহবিলের বিষয়ে একটি খসড়া নীতিমালা তৈরি করেছে। এ তহবিল থেকে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দেয়া হবে। ঋণের মেয়াদ হবে ৩ থেকে ১০ বছর। ঋণের সুদের হার নির্ধারিত হবে লাইবর (লন্ডনে আন্তঃব্যাংক ঋণের সুদের হার) রেটের সঙ্গে ৩ থেকে ৪ শতাংশ যোগ করে। বর্তমানে লাইবর রেট হচ্ছে দশমিক ৩১ থেকে দশমিক ৩২ শতাংশ। এ হার ওঠানামা করে। এর সঙ্গে ৩ থেকে ৪ শতাংশ যোগ করা হবে। যে ব্যাংক থেকে এ ঋণ নেয়া হবে সে ব্যাংককে সার্ভিস চার্জ বাবদ দিতে হবে ১ শতাংশ। এসব মিলে এ ঋণে সুদের হার দাঁড়ায় সাড়ে ৪ থেকে সাড়ে ৫ শতাংশ। চূড়ান্ত পর্যায়ে ব্যাংকগুলোর সার্ভিস চার্জ গ্রাহক ভেদে আরও কিছুটা বাড়তে পারে। সব মিলিয়ে সুদের হার দাঁড়াবে সর্বোচ্চ ৫ থেকে ৬ শতাংশ। আগামী সেপ্টেম্বর বা অক্টোবরের মধ্যেই ঋণ বিতরণ শুরু হবে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আশাবাদী। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ তহবিলের সুদের হার কম রাখতে চায়। কিন্তু বিশ্বব্যাংক বলেছে, বেশি কম রাখলে বাজারে বিশৃংখলা সৃষ্টি হবে। এ কারণে বাজারের সঙ্গে সমন্বয় রেখে কমাতে হবে। তাই ইচ্ছা থাকার পরও সুদের হার বেশি কমানো যাচ্ছে না। সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট (টাকার বদলে পণ্য আমদানি) বা বায়ার্স ক্রেডিটের (গ্রাহক বিদেশ থেকে যে ঋণের ব্যবস্থা করেন) সুদের হারের কাছাকাছি রাখা হচ্ছে। এসব ঋণের সুদের হার ৬ থেকে ৮ শতাংশ। এটি হবে একটি ঘূর্ণায়মান তহবিল। সুদসহ ঋণ শোধের পর এটি তহবিলে যোগ হবে। এভাবে তহবিলের আকার বাড়ানো হবে। তা থেকে আবার ঋণ দেয়া হবে। উদ্যোক্তাদের চাহিদা বাড়লে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তহবিলের আকার আরও বাড়াতে আগ্রহী। সূত্র জানায়, বাজারে ঋণের সুদের হার কমানোর নানামুখী উদ্যোগ নেয়ার পরও তা খুব বেশি একটা সফল হচ্ছে না। এ ছাড়া শিল্প খাতে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দেয়ার ব্যবস্থাও সীমিত। ব্যাংকগুলো মূলত চলতি মূলধনের জোগান দিতে পারে। তাদের দীর্ঘমেয়াদি ঋণ খুব বেশি দেয়ার সক্ষমতা নেই। সিন্ডিকেশনের (কয়েকটি ব্যাংক মিলে) দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দেয়ার একটি উদ্যোগ ২০০৬ সালে নেয়া হয়েছিল, কিন্তু সেটি সফল হয়নি। শিল্প খাতে ঋণ দিতে একটি মাত্র বিশেষায়িত ব্যাংক রয়েছে। সেটি হচ্ছে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক। এটির আর্থিক অবস্থাও ভালো নয়। ফলে দীর্ঘমেয়াদি ঋণের ব্যাপারে এক ধরনের সংকট রয়েছে। এ সংকট দূর করে শিল্প খাতে কম সুদের ঋণের জোগান বাড়ানোর জন্যই এ তহবিল গঠনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ও বিশ্বব্যাংক উইংয়ের প্রধান কাজী শফিকুল আযম বলেন, এ তহবিলের ঋণের সুদের হার ব্যাংক থেকে কম হওয়ায় উদ্যোক্তাদের আগ্রহ বাড়বে। ফলে এটি শিল্প খাতে কম সুদে দীর্ঘমেয়াদি ঋণের বাজার তৈরিতে একটি বড় উৎস হিসেবে কাজ করবে। যা দেশের শিল্প বিকাশে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। বিশ্বব্যাংক সূত্র জানায়, এর মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে দীর্ঘমেয়াদি ঋণের একটি বাজার গড়ে উঠবে। মূলত এ লক্ষ্য থেকেই এ ধরনের একটি প্রকল্পে অর্থায়নে সম্মত হয়েছে বিশ্বব্যাংক। কেননা বাংলাদেশে দীর্ঘমেয়াদি ঋণের উৎস একবারেই কম। এ অবস্থায় এ ঋণ শিল্পায়নে বড় ভূমিকা রাখবে। বিশ্বব্যাংকের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার (আইডিএ) ঋণের আওতায় শূন্য দশমিক ৭৫ শতাংশ সুদ হারে এ ঋণ পাবে বাংলাদেশ। ঋণটি পরিশোধে সময় ৩৮ বছর। এর মধ্যে গ্রেস পিরিয়ড ৬ বছর। এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, বাংলাদেশে দীর্ঘমেয়াদি ভিত্তিতে ঋণ পাওয়া সহজ নয়। কেননা বন্ড মার্কেট নেই, আর শেয়ারবাজার থেকে টাকা তোলাও কঠিন। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো স্বল্পমেয়াদে ঋণ দিতে চায়। দীর্ঘমেয়াদি ঋণে তারা খুব বেশি আগ্রহী নয়। যদিও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ ছাড়া শিল্পায়ন কঠিন। এ অবস্থায় বিশ্বব্যাংকের এ অর্থে সহজ শর্তে দীর্ঘমেয়াদি ঋণের নতুন একটি ইউন্ডো বা জানালা খোলা হল। যাকে বাংলাদেশ ব্যবহার করে পরে আরও উচ্চমাত্রায় নিয়ে যেতে পারবে। তিনি আরও বলেন, ৩০ কোটি ডলার খুব বেশি না হলেও ব্যাংকিং খাতে উচ্চ সুদের হার কমিয়ে আনতে সহায়ক হবে এ তহবিল। কারণ এতে প্রতিযোগিতা বেড়ে যাবে। বাড়বে অর্থ সরবরাহ। ফলে এর ইতিবাচক প্রভাব ঋণের বাজারে পড়বেই। সূত্র জানায়, এ তহবিল থেকে বিশেষ করে রফতানিমুখী ও দেশের চাহিদা মেটাতে আমদানির বিকল্প শিল্প গড়ে তুলতে ঋণ দেয়ার বিষয়টি অগ্রাধিকার পাবে। এ ঋণ সংশ্লিষ্ট শিল্পের জন্য যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানি করতে উৎসাহিত করবে। যেহেতু ঋণটি দেয়া হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রায়। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ রফতানিকারক সমিতির সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী বলেন, বাংলদেশে দীর্ঘমেয়াদি ভিত্তিতে ঋণ পাওয়া কঠিন। এ জন্য অনেক উদ্যোক্তা ব্যবসা শুরু করে দু-এক বছরের মধ্যে ভালো করতে না পারলেই হারিয়ে যান। কেননা তিন বছর পর থেকেই ঋণের কিস্তি ও সুদ পরিশোধ করতে হয়। এ অবস্থায় বিশ্বব্যাংকের এ ঋণ রফতানি খাতের জন্য আশীর্বাদ হয়ে আসবে। রফতানিমুখী শিল্প খাত বড় একটি সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এ সমস্যা সমাধানে এ তহবিল কিছুটা হলেও ভূমিকা রাখবে। তিনি বলেন, বাজারে ঋণের সুদের হার কমাতেও এ তহবিল সহায়ক হবে। কেননা স্বল্প সুদে ঋণ পেলে কেউ বেশি সুদে ঋণ নিতে চাইবে না। ফলে উচ্চ সুদে যারা ঋণ দিচ্ছে তখন তারা সুদের হার কমাতে বাধ্য হবে। সূত্র জানায়, শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানি করতে বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্রায় কম সুদে ঋণের কোনো ব্যবস্থা নেই। এ ক্ষেত্রে উদ্যোক্তাদের ১৪ থেকে ১৮ শতাংশ সুদে ঋণ দিতে হচ্ছে। এ টাকায় বৈদেশিক মুদ্রা কিনতে গিয়ে আবার দিতে হচ্ছে কমিশন। যা তাদের খরচ বাড়িয়ে দিচ্ছে।
No comments:
Post a Comment