সায়েন্স ল্যাবরেটরিও (বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ বা বিসিএসআইআর) দেয় ওষুধ উৎপাদন ও বিপণনের লাইসেন্স। আর এটিকে পুঁজি করে স্যালাইন ও কাশির সিরাপসহ বিভিন্ন ধরনের ভেজাল ওষুধ বাজারজাত করছে ৬০টির বেশি নামসর্বস্ব কোম্পানি। যদিও বিধান অনুযায়ী এ লাইসেন্স দেয়ার একমাত্র এখতিয়ার রয়েছে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের। ওষুধ প্রশাসনের অনুমোদন ছাড়া এবং সায়েন্স ল্যাবরেটরির লাইসেন্স নিয়ে ওষুধ উৎপাদন ও বিপণন অভিযোগে
৩০টির বেশি ওষুধ কোম্পানির মালিককে কারাদণ্ড ও জরিমানা করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে এসব কোম্পানির উৎপাদিত ওষুধ। সেই সঙ্গে জব্দ করা হয়েছে সায়েন্স ল্যাবরেটরির দেয়া লাইসেন্স সংক্রান্ত যাবতীয় কাগজপত্র। ভ্রাম্যমাণ আদালতে নিষ্পত্তি হওয়া ভেজাল ওষুধ উৎপাদন সংক্রান্ত মামলার নথিপত্র ঘেঁটে এবং ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে উল্লিখিত সব তথ্য। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ওষুধ প্রশান অধিদফতরের লাইসেন্সধারী নয়, এমন সব ওষুধ কোম্পানির কাছে ফর্মুলা বিক্রি করেছে বিসিএসআইআর বা সায়েন্স ল্যাবরেটরি কর্তৃপক্ষ। স্যালাইন ও বিভিন্ন ধরনের সিরাপের ফর্মুলা বিক্রি সংক্রান্ত লাইসেন্সের চুক্তিপত্রে (দেড়শ’ টাকার স্ট্যাম্পে) উল্লেখ করা হয়েছে, ফর্মুলা ‘ক্রেতা কোম্পানি’ ওষুধ উৎপাদন ও বাজারজাত করতে পারবে। এমনকি ওই সিরাপ ও স্যালাইন উৎপাদনের একটি লাইসেন্স নম্বরও দেয়া হয়েছে। এটিই ‘উৎপাদন ও বিপণন লাইসেন্স নম্বর’ হিসেবে ব্যবহার করছে ক্রেতা কোম্পানি। এসব কোম্পানি আর ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের কাছ থেকে কোনো অনুমোদন নেয়নি। এ অবস্থাতেই তারা বছরের পর বছর বিভিন্ন প্রকারের স্যালাইন, সিরাপ, ফুড সাপ্লিমেন্ট জাতীয় ওষুধ উৎপাদন ও বাজারজাত করছে। ওষুধ নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশ, ১৯৮২-এর ৫-এর এক ধারায় বলা হয়েছে, ওষুধ প্রশাসনের অনুমতি ছাড়া কোনো ধরনের ওষুধ উৎপাদন, বাজারজাত কিংবা আমদানি করা যাবে না। একমাত্র ওষুধ প্রশাসনই ওষুধ তৈরির অনুমোদন দানকারী প্রতিষ্ঠান। জানতে চাইলে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর হোসেন মল্লিক বুধবার টেলিফোনে যুগান্তরকে বলেন, সায়েন্স ল্যাবরেটরির অনুমোদন নিয়ে ওষুধ তৈরির অভিযোগে একাধিক ওষুধ কোম্পানির মালিকের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। ভ্রাম্যমাণ আদালত তাদের জরিমানা ও কারাদণ্ড দিয়েছেন। বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে সেসব ওষুধ। খাবার স্যালাইনসহ যে কোনো প্রকারের ওষুধ উৎপাদন করতে হলে অবশ্যই আমাদের প্রতিষ্ঠান থেকে অনুমোদন নিতে হবে। তিনি আরও বলেন, সায়েন্স ল্যাবরেটরি ওষুধ তৈরির কোনো অনুমোদন দিতে পারে না। ফর্মুলা বিক্রির অনুমোদনপত্রে, খাবার স্যালাইনসহ সিরাপ উৎপাদন ও বাজারজাত করতে পারবে বলে প্রতিষ্ঠানটি সত্যায়িত করে। এটি তারা পারে কিনা আমার জানা নেই। এ প্রসঙ্গে বিসিএসআইআরের চেয়ারম্যান ডক্টর একেএম আসাদুজ্জামান সোমবার টেলিফোনে যুগান্তরকে বলেন, ‘এ বিষয়টি আমার জানা নেই। চেয়ারম্যান হিসেবে নতুন যোগদান করেছি। তাই এ ব্যাপারে বিস্তারিত কিছু বলতে পারছি না। খোঁজ নিয়ে দেখব।’ তবে সায়েন্স ল্যাবরেটরির সিনিয়র ইন্ডাস্ট্রিয়াল লিয়াজোঁ অফিসার হোসেন মোহাম্মদ মাসুদ যুগান্তরকে বলেন, ‘স্যালাইন, ফুড সাপ্লিমেন্ট, ফ্রুট সিরাপসহ বিভিন্ন প্রকারের পণ্যের ফর্মুলা বিক্রি করে আমাদের প্রতিষ্ঠান। ক্রেতা কোম্পানির সঙ্গে আমাদের চুক্তিও হয়। তাতে পণ্যের উৎপাদন ও বাজারজাত করার কথা লেখা থাকে। তবে আমাদের অনুমোদন নিয়ে স্যালাইনসহ ওষুধ উৎপাদন করার অভিযোগ আমরা পেয়েছি। তাই বাংলায় নতুন করে ফর্মুলা বিক্রির ফরম করা হয়েছে। তবে যেগুলো অনুমোদন নিয়ে উৎপাদন করছে সেগুলো দেখভাল করার কোনো লোকবল আমাদের নেই।’ প্রতিষ্ঠানটির আরেক কর্মকর্তা ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইকোনমিস্ট মো. হারুন অর রশীদ যুগান্তরকে বলেন, ‘পণ্যের উৎপাদন ও বাজারজাত করার অনুমতি দেয়ার ক্ষমতা সায়েন্স ল্যাবরেটরির আছে কিনা আমার জানা নেই। তবে অভিযোগ এসেছে। তাই ফর্মুলা বিক্রি আপাতত বন্ধ আছে। ’ ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর ও ভ্রাম্যমাণ আদালতের মামলার নথিপত্র ঘেঁটে জানা গেছে, ২০১০ সালের ২৫ জুন গ্রিনলাইফ হারবাল ইন্ডাস্ট্রিজ নামক কোম্পানির মালিক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান সায়েন্স ল্যাবরেটরি কর্তৃপক্ষ থেকে কাশির সিরাপ তৈরির ফর্মুলা কেনেন। সিরাপটির নাম নিউ হারবাল কাশির (কফ) সিরাপ। মিজানুর ও সায়েন্স ল্যাবরেটরির তৎকালীন সচিব ডক্টর গৌরঙ্গ চন্দ্র মহান্তের মধ্যে এ সংক্রান্ত একটি চুক্তি সম্পাদিত হয়। ফর্মুলা বিক্রির চুক্তিপত্রে বলা হয়েছে, গ্রিনলাইফ হারবাল কোম্পানি কাশির সিরাপ উৎপাদন ও বাজারজাত করার অনুমতি দেয়া হল। লাইসেন্স নম্বর হারবাল কফ সিরাপ-লাইসেন্স নম্বর-এসএসিএইচআই-জেএ-বিআই-৬২-৭০৬/০৮/২০৫৯। ওই ওষুধ কোম্পানির কর্তৃপক্ষ ওষুধ প্রশাসনের কোনো অনুমোদন না নিয়ে কাশির সিরাপটি উৎপাদন ও বাজারজাত করে আসছিল। চলতি বছরের ২৪ মার্চ র্যাব পরিচালিত ভ্রাম্যমাণ আদালত প্রতিষ্ঠানটির মালিককে কারাদণ্ড ও প্রতিষ্ঠানটির কারখানা সিলগালা করে দেয়। জব্দ করা হয় সায়েন্স ল্যাবরেটরির দেয়া লাইসেন্সের কাগজপত্র। প্রতিষ্ঠানটির কারখানা পশ্চিম রামপুরায় (বাড়ি নং ৫৮/১) অবস্থিত। আরও জানা গেছে, ২০০৮ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত ইউনি ট্রেড ফুড অ্যান্ড কেমিক্যাল লি. ইউনি বার্ড ফুড অ্যান্ড কেমিকাল লি. হিউমান হেলথ কেয়ার কোম্পানিসহ প্রায় ৫০টি কোম্পানির কাছে স্যালাইন ও বিভিন্ন ধরনের সিরাপ তৈরির ফর্মুলা বিক্রির অনুমোদন দেয় সায়েন্স ল্যাবরেটরি। এই অনুমোদনপত্রে উৎপাদন ও বাজারজাত করার বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে। ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের তথ্যমতে, সায়েন্স ল্যাবরেটরির অনুমোদন নিয়ে মেসার্স সেফ ফুড নামক কোম্পানি কয়েক লাখ স্যালাইন তৈরি ও বাজারজাত করে আসছিল। ওই স্যালাইনের নাম হল, টেস্টফুড স্যালাইন। গত ৩০ মে ভ্রাম্যমাণ আদালত কোম্পানির কারখানা বাজেয়াপ্ত করে। একইভাবে ব্রাদার ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ, ইস্টার্ন হারবাল, পাবনার নিয়ম ফুডস, সান ফুড, এস কে ভেট লিমিটেড, মেসার্স মাল্টিপাল হেলথ ফার্মা (১৪২/বি, গ্রিনরোড, ঢাকা), ইনজয় কোম্পানি (তৈরি করা ওষুধ জেনো ভিমনজল), মেসার্স ইন্ট্রা ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডসহ ৬০টি কোম্পানি সায়েন্স ল্যাবরেটরি থেকে অনুমোদন নিয়ে ওষুধ উৎপাদন ও বাজারজাত করেছে। র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আনোয়ার পাশা যুগান্তরকে বলেন, ‘কয়েক বছর ধরেই ভেজাল ওষুধ উৎপাদন ও বিপণনের বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছি। নামসর্বস্ব অনেক কোম্পানিই সায়েন্স ল্যাবরেটরির ফর্মুলা বিক্রির অনুমোদন নিয়েই ভেজাল ওষুধ তৈরি করছে। ইতিমধ্যেই বেশকিছু কোম্পানির কারখানা সিলগালা করে দেয়া হয়েছে। আমাদের এই অভিযান অব্যাহত থাকবে।’ সায়েন্স ল্যাবরেটরির অনুমোদন নিয়ে ওষুধ তৈরির অভিযোগে একাধিক কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলা করেছেন ওষুধ প্রশাসনের তত্ত্বাবধায়ক সৈকত কুমার কর। তিনি যুগান্তরকে বলেন, ‘ওষুধ তৈরির অনুমোদন দিতে পারে না সায়েন্স ল্যাবরেটরি। তাদের অনুমোদন নিয়ে বহু কোম্পানি স্যালাইনসহ বিভিন্ন প্রকারের ওষুধ তৈরি করছে। আমরা এসব কোম্পানির বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছি। অনেক মামলা করেছি। আরও করব।’ প্রতিষ্ঠানটির মুখপাত্র ও ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের উপপরিচালক মো. রুহুল আমিন যুগান্তরকে বলেন, ‘বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক সভায় সায়েন্স ল্যাবরেটরির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে বলেছিলাম, সায়েন্স ল্যাবরেটরি ওষুধ তৈরির অনুমোদন দেয়ায় অনেকে ভেজাল ওষুধ তৈরি করছে। বিষয়টির সুরাহা হওয়া দরকার।’
No comments:
Post a Comment