Monday, October 20, 2014

সঠিক নীতি ও সাশ্রয়ী উদ্যোগ কমাবে সড়ক দুর্ঘটনা:প্রথম অালো

বড় ধরনের বিনিয়োগ ছাড়া শুধু সঠিক নীতি ও সাশ্রয়ী কিছু উদ্যোগই সড়ক দুর্ঘটনা অনেকাংশে কমিয়ে আনতে পারে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে সড়কের বাঁক সোজাকরণ, চালকের প্রশিক্ষণ ও পথচারীদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি। এটা করার মূল দায়িত্ব নিতে হবে সরকারকে। এগিয়ে আসতে হবে জনগণকেও। সচেতন হতে হবে যানবাহনের চালক, মালিক ও পথচারীদেরও। গতকাল রোববার কারওয়ান বাজারের সিএ ভবনে প্রথম আলোর সভাকক্ষে ‘সড়ক দুর্ঘটনা রোধে করণীয়’ শ
ীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এসব কথা বলেন। গোলটেবিল বৈঠকে প্রধান অতিথি ছিলেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং সভাপতিত্ব করেন চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন। প্রথম আলোর উদ্যোগে আয়োজিত এই গোলটেবিল বৈঠকে সহযোগিতা করে সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা সংগঠন নিরাপদ সড়ক চাই। নীতি ও সাশ্রয়ী ব্যবস্থায় দুর্ঘটনা কমাবে: গোলটেবিল বৈঠকে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক সামছুল হক বলেন, সাশ্রয়ী কিছু উদ্যোগ দুর্ঘটনা অনেকাংশে কমিয়ে আনতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে মহাসড়কের বাঁক সোজা করা, চালকদের প্রশিক্ষণ ও জনসচেতনা। সরকার ইতিমধ্যে বাঁক সোজা করার প্রকল্প নিয়েছে। এই বাঁকগুলোতেই ৩৫ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটে। দেশের প্রতিটি মহাসড়কের তথ্য হালনাগাদ করে আরও কোন কোন স্থানে পৌনঃপুনিক দুর্ঘটনা ঘটে, তা চিহ্নিত করে একই ব্যবস্থা নিতে হবে। সামছুল হক আরও বলেন, সড়ক দুর্ঘটনা দৈব। তবে কিছু নির্দিষ্ট এলাকায় বারবার দুর্ঘটনা ঘটতে থাকলে সেটাকে দৈব বলা যায় না। মনে করতে হবে, এর পেছনে মানুষের তৈরি কোনো কারণ আছে। সেটা খুঁজে বের করে ব্যবস্থা নিতে হবে। উন্নত বিশ্বের অনেক দেশ সঠিক নীতি ও কর্মসূচির মাধ্যমে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি কমিয়ে আনতে পেরেছে। আমাদেরও তাই করতে হবে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী বলেন, শুধু চালকদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। কারণ, ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে বাঁক সোজা করায় দুর্ঘটনার সংখ্যা ও প্রাণহানি দুটিই কমেছে। নিরাপদ সড়ক চাই-এর চেয়ারম্যান, চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, আগে এ ধরনের আলোচনা বা গোলটেবিল বৈঠকে এক পক্ষ আরেক পক্ষকে দোষারোপ করত। একে অন্যের কথা মানতে চাইত না। এখন সবাই মিলে কাজ করার এবং এই সমস্যা সমাধানে আগ্রহী। এটাই আশার বিষয়। বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ যাওয়াকে নিয়তি মনে করি আমরা। এখানে আসলে আমরা অসহায়। অথচ নীতি পরিবর্তনের মাধ্যমে অনেক প্রাণই রক্ষা করা সম্ভব। জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিল নামে একটি শীর্ষ কমিটি আছে। কিন্তু এর বৈঠকও নিয়মিত হয় না। এই কাউন্সিলের কোনো গবেষণাও নেই। ফলে দুর্ঘটনার প্রকৃত চিত্র উঠে আসে না। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, দুর্ঘটনা রোধ ও দুর্ঘটনা ঘটে গেলে কী করতে হবে, তা আমাদের সবই জানা। এখন যার যার অবস্থান থেকে সর্বাত্মকভাবে দায়িত্ব পালন করলেই হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সেই দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করবে। তিনি জানান, যানবাহনের চলাচল পর্যবেক্ষণের জন্য ঢাকার ১৪টি প্রবেশমুখে সিসিটিভি ক্যামেরা বসানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পর্যায়ক্রমে বড় শহরগুলোতেও সিসিটিভি বসানো হবে। এখনই উদ্যোগ নিতে হবে: ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সড়ক নিরাপত্তা কর্মসূচির পরিচালক নাজমুল হোসাইন বলেন, জাতিসংঘের সদস্যদেশগুলোর মধ্যে ৫০ শতাংশ দেশ পর্যায়ক্রমে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা ও মৃত্যুর হার কমিয়ে এনেছে। আর বাকি ৫০ শতাংশ দেশে দুটিই বাড়ছে। বাংলাদেশের অবস্থান দুর্ঘটনার সংখ্যা ও মৃত্যুর হার বৃদ্ধি পাওয়া দেশগুলোর তালিকায় নিচের দিকে পাঁচের মধ্যে। বর্তমানে সড়ক নিরাপত্তা কার্যক্রমের বরাদ্দ আসে সড়ক মেরামত ও নির্মাণ খাত থেকে। ফলে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। সময় এসেছে বাজেটে সড়ক নিরাপত্তার জন্য আলাদা বরাদ্দ রাখার। হাইওয়ে পুলিশের সুপার (গাজীপুর) শফিকুল ইসলাম বলেন, তাঁদের দুই হাজার ১৯০ জন সদস্য এক হাজার ৯০০ কিলোমিটার মহাসড়ক পাহারা দেয়। দুর্ঘটনা রোধে আরও ভূমিকা রাখতে হলে লোকবল ও আনুষঙ্গিক সুবিধা বৃদ্ধি এবং প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা দরকার। ঢাকা মেডিকেল কলেজের সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এ বি এম জামাল দুর্ঘটনার এক ঘণ্টার মধ্যে চিকিৎসা নিশ্চিত করার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, সড়ক দুর্ঘটনার ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ দুর্ঘটনাস্থলেই মারা যায়। বাকিদের তাৎক্ষণিক চিকিৎসা দেওয়া গেলে মৃত্যুর হার কমিয়ে আনা সম্ভব। তিনি বলেন, জ্বর হলে আমরা বলতে পারি ওষুধ দেওয়ার পর পরবর্তী সময়ে কী ঘটবে। কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসা এতই জটিল যে এরপর কী হবে তা বলা মুশকিল। এই বিষয়ে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, হাইওয়ে পুলিশকে উন্নত দেশের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার কর্মসূচি নেওয়া হবে। মহাসড়কে দুর্ঘটনাকবলিত যান সরাতে এবং আহত ব্যক্তিদের দ্রুত চিকিৎসার জন্য অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করার প্রক্রিয়া চলছে। সমন্বিত পরিকল্পনা-উদ্যোগ হলে: চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, সড়ক দুর্ঘটনা রোধ ও দুর্ঘটনা-পরবর্তী কার্যক্রমে কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। সবগুলো মন্ত্রণালয়ের কাজে সমন্বয়ের জন্য একটি কর্তৃপক্ষ করা যেতে পারে। এটা সম্ভব হলে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক অর্থ দিতে রাজি আছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শক মনিরুজ্জামান বলেন, জাতিসংঘ ২০১১ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত সড়ক নিরাপত্তা দশক ঘোষণা করেছে। প্রতিটি সদস্যদেশকে সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা করার কথা বলা হয়েছে। বাংলাদেশে এমন কোনো পরিকল্পনা তৈরি করে কার্যক্রম হাতে নিলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কারিগরি সহায়তা দেবে। বেশি দরকার সচেতনতা: ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মিলি বিশ্বাস বলেন, ঢাকায় প্রতিদিন ১৯৫ থেকে ২০০ যানবাহন নামছে। ফলে ব্যবস্থাপনাতেও সমস্যা হচ্ছে। মানুষকে সচেতন করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, পথচারীদের অসচেতনতার কারণে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা হয়। আর যানবাহনের ঝুঁকিপূর্ণ প্রতিযোগিতার কারণে ঘটে মুখোমুখি সংঘর্ষ। মানুষের সচেতনতার জন্য পাঠ্যপুস্তকে সড়ক নিরাপত্তার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে এবং গণমাধ্যমে একটা নির্দিষ্ট সময়ে লাগাতার সচেতনতামূলক কর্মসূচি প্রচার করতে হবে। আর চালকদের জন্য প্রতিটি জেলার পরিবহন কমিটির মাধ্যমে প্রশিক্ষণ ও সচেতনতামূলক কার্যক্রম নিতে হবে। বারবার সুপারিশের পরও এটা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। হাইওয়ে পুলিশের শফিকুল ইসলাম বলেন, গত ঈদুল আজহার আগে-পরে তিন দিন গাজীপুরের চন্দ্রা থেকে বঙ্গবন্ধু সেতু পর্যন্ত প্রতিদিন গড়ে আটটি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। এগুলোর ৪০ শতাংশের পেছনেই দায়ী চালকেরা। শ্রমিকনেতা ওসমান আলী বলেন, রাষ্ট্রের দায়িত্ব চালকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া ও সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা। সরকার লাইসেন্স বাবদ চালকদের কাছ থেকে অগ্রিম টাকা নিচ্ছে। কিন্তু প্রশিক্ষণের জন্য পাঁচ টাকাও খরচ করে না। জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে প্রতিটি জেলায় চালকদের প্রশিক্ষণ ও সচেতনতামূলক কর্মসূচি পালনের দাবি জানান তিনি। অধ্যাপক সামছুল হক বলেন, সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে পাঠ্যপুস্তকে সড়ক দুর্ঘটনার কারণ ও এর ক্ষয়ক্ষতি অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে তাঁরা একটি প্রস্তাব দিয়েছেন। কিন্তু এটি এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) পরিচালক মশিউর রহমান বলেন, আলোচনায় এসেছে ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন চলাচল এবং চালকের অদক্ষতা সড়ক দুর্ঘটনার জন্য অনেকাংশে দায়ী। বিআরটিএ ত্রুটিপূর্ণ যানবাহনের চলাচল বন্ধে নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে। আর চালকদের প্রশিক্ষণ এবং সাধারণ মানুষের সচেতনতার কর্মসূচি অব্যাহত আছে। তা আরও জোরদার করা হবে। পথচারী এবং সাধারণ মানুষকে সচেতন করার কাজে সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, সরকার জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণে যা যা করণীয় সবই করবে। অন্যদেরও এগিয়ে আসতে হবে। চালকদের প্রতিবছর একবার করে শারীরিক পরীক্ষার আওতায় আনার বিষয়ে জোর দেন প্রতিমন্ত্রী। গোলটেবিল বৈঠকটি সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম। শুরুতে তিনি গোলটেবিল বৈঠকের উদ্দেশ্য নিয়ে বলেন, প্রথম আলো দেশের সাফল্যের গল্প বলে। আর সমস্যার কথাও তুলে ধরে এবং সমাধানের পথ বাতলে দেওয়ার চেষ্টা করে। এরই ধারাবাহিকতায় এই গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন। এরপর ইলিয়াস কাঞ্চন সড়ক দুর্ঘটনার কারণ ও এর পরিণতি নিয়ে তৈরি ভিডিওচিত্র ও গান দেখান।

No comments:

Post a Comment