Friday, November 14, 2014

জাহিদ হোসেনের মৃত্যুদণ্ড:প্রথম অালো

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ফরিদপুরের নগরকান্দা রাজাকার বাহিনীর প্রধান পলাতক এম এ জাহিদ হোসেনকে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। বর্তমানে নগরকান্দা পৌরসভার মেয়র ও বিএনপির নেতা জাহিদ হোসেনের বিরুদ্ধে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় তাঁকে এ দণ্ডাদেশ দেওয়া হয়। বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমে
র নেতৃত্বাধীন ট্রাইব্যুনাল-১ গতকাল বৃহস্পতিবার ৭২ বছর বয়সী জাহিদ হোসেনের বিরুদ্ধে মামলার এ রায় ঘোষণা করেন। রায়ে বলা হয়, জাহিদ হোসেনের বিরুদ্ধে ১১টি অভিযোগের মধ্যে ১০টি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। এর মধ্যে ছয়টি অভিযোগের জন্য তাঁকে মৃত্যুদণ্ড এবং বাকি চারটি অভিযোগের জন্য ৪০ বছর সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। প্রমাণিত না হওয়ায় একটি অভিযোগ থেকে তাঁকে খালাস দেওয়া হয়। এ নিয়ে আসামির অনুপস্থিতিতে মানবতাবিরোধী অপরাধের তিনটি মামলার বিচার ও রায় হলো। গত বছরের ২১ জানুয়ারি জামায়াতে ইসলামীর সাবেক রুকন (সদস্য) পলাতক আবুল কালাম আযাদকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল-২। একই ট্রাইব্যুনাল গত বছরের ৩ নভেম্বর একাত্তরে বুদ্ধিজীবী নিধনের দায়ে পলাতক দুই আলবদর নেতা চৌধুরী মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খানকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন। আযাদ কোথায় আছেন তা এখনো নিশ্চিত করতে পারেনি সরকার। মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামানের অবস্থান জানলেও তাঁদের দেশে ফিরিয়ে এনে সাজা কার্যকর করার কোনো উদ্যোগ নেই। রায়ে বলা হয়, জাহিদ হোসেন ১৯৭১ সালে জামায়াতের রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন। একাত্তরের এপ্রিলে তিনি রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিয়ে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ নেন। মে মাসে তাঁর বড় ভাই জাফরকে নিয়ে তিনি নগরকান্দায় স্থানীয় রাজাকার বাহিনী গড়ে তোলেন। জাফর মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে মারা গেলে জাহিদ ওই রাজাকার বাহিনীর কমান্ডার হন এবং নগরকান্দার বিভিন্ন স্থানে মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যা সংঘটন করেন। স্থানীয়ভাবে তিনি ‘খোকন মাতুব্বর’ বা ‘খোকন রাজাকার’ নামেও পরিচিত। মানবতাবিরোধী অপরাধের দ্বাদশ মামলার রায় ঘোষণার সময় গতকাল প্রথমবারের মতো ট্রাইব্যুনালের নিরাপত্তাব্যবস্থা শিথিল দেখা গেছে। আগের অন্যান্য রায়ের দিনের মতো গতকাল ট্রাইব্যুনাল এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যাপক উপস্থিতি ছিল না। এজলাসেও ভিড় ছিল কম। রায় ঘোষণার সময় ট্রাইব্যুনাল বলেন, অন্য দিনের তুলনায় শ্রোতার সংখ্যা কম। বেলা ১১টার দিকে এজলাসে নিজ আসনে বসেন ট্রাইব্যুনাল-১-এর চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম এবং অপর দুই সদস্য বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন ও বিচারপতি আনোয়ারুল হক। দুপুর ১২টার মধ্যে তাঁরা তিনজনে সংক্ষিপ্ত রায় পড়ে শোনান। এ সময় রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি গোলাম আরিফ টিপুসহ অন্যান্য কৌঁসুলি, আসামিপক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আবদুস শুকুর খান, মানবতাবিরোধী অপরাধ তদন্ত সংস্থার সমন্বয়ক আবদুল হান্নান খান, সহসমন্বয়ক এম সানাউল হক প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। ছয় অভিযোগে ফাঁসি: জাহিদ হোসেনের বিরুদ্ধে ৫, ৬, ৭, ৮, ৯ ও ১০ নম্বর অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় এগুলোতে তাঁকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। গণহত্যা ও হত্যার দায়ে তাঁকে এ সাজা দেওয়া হয়। পঞ্চম অভিযোগ অনুসারে, একাত্তরের ৩০ মে সকাল আটটা থেকে বেলা একটার মধ্যে জাহিদ হোসেন সহযোগী রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে নিয়ে নগরকান্দার শহীদনগর কোদালিয়া গ্রামে হামলা চালিয়ে ১৬ জনকে গুলি করে হত্যা করে ও ৫০-৬০টি ঘর লুট করে আগুন দেয়। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ছিল নারী ও শিশু। ষষ্ঠ অভিযোগ, একই দিন বেলা দেড়টার দিকে জাহিদের নেতৃত্বাধীন রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনারা ঈশ্বরদী গ্রামের অসংখ্য ঘরে আগুন দেয়। গ্রামবাসী পালানোর সময় জাহিদ ও তাঁর সহযোগীরা গুলি করে চার গ্রামবাসীকে হত্যা করে। সপ্তম অভিযোগ, ৩১ মে শহীদনগর কোদালিয়া গ্রামের দিঘলিয়া-ঘোড়ামারা বিলে জাহিদ ও তাঁর সহযোগীরা তিনজকে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করে। পরে তারা বনগ্রাম ও মেহেরদিয়া গ্রামে এক ব্যক্তিকে হত্যা ও অসংখ্য ঘরবাড়ি লুট করে আগুন দেয়। অষ্টম অভিযোগ, একই দিন বেলা দেড়টার দিকে রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনারা গোয়ালদি গ্রামের রাজেন্দ্র নাথ রায় ও দুই বছরের শিশু বুলু খাতুনকে হত্যা করে। নবম অভিযোগ, ৩১ মে বেলা সাড়ে তিনটার দিকে জাহিদের নেতৃত্বে রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনারা পুরপাড়া গ্রামে হামলা চালিয়ে ১০ জনকে হত্যা করে। দশম অভিযোগ অনুসারে, একাত্তরের ১ জুন ভোরবেলা জাহিদ ও তাঁর সহযোগী এবং পাকিস্তানি সেনারা বাগাট ও চুরিয়ার চর গ্রামে হামলা ও ১০-১৫ জন নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করে। চার অভিযোগে কারাদণ্ড: ২, ৩, ৪ ও ১১ নম্বর অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় জাহিদকে বিভিন্ন মেয়াদে সশ্রম কারাদণ্ড দেন ট্রাইব্যুনাল। দ্বিতীয় ও তৃতীয় অভিযোগ অনুসারে, একাত্তরের ২৮ এপ্রিল থেকে ২৮ মে পর্যন্ত জাহিদ হোসেন ও সহযোগী রাজাকাররা জংগুর্দি-বাগুটিয়া গ্রামে হামলা চালিয়ে হিন্দুদের বাড়িঘরে আগুন দেয় ও ধর্মান্তরিত না হলে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দেয়। জীবন বাঁচাতে বাধ্য হয়ে অনেক হিন্দু ধর্মান্তরিত হন, অনেকে দেশ ছেড়ে চলে যান। এ দুটি অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় জাহিদকে পাঁচ ও ১০ বছর সশ্রম কারাদণ্ড দেন ট্রাইব্যুনাল। চতুর্থ অভিযোগ, একাত্তরের ২৭ মে চাঁদেরহাট গ্রামের বণিকপাড়ার এক হিন্দু নারীকে ধর্ষণ করেন জাহিদ। সহযোগী রাজাকাররা ওই গ্রামের আরেক নারীকে ধর্ষণ করেন। ধর্ষণের শিকার ওই দুই নারী ও তাঁদের পরিবার ভারতে চলে যান। এ অভিযোগে জাহিদকে ২০ বছরের কারাদণ্ড দেন আদালত। ১১তম অভিযোগ, একাত্তরের ১ জুলাই জংগুর্দি-বাগুটিয়া গ্রামের কানাইলাল মণ্ডলকে হত্যার জন্য গুলি করেন জাহিদ। তবে প্রাণে বেঁচে যান কানাই, কনুইয়ের কাছে গুরুতর আহত হন। এ অভিযোগে জাহিদকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেন ট্রাইব্যুনাল। এক অভিযোগে খালাস: জাহিদের বিরুদ্ধে প্রথম অভিযোগ ছিল, একাত্তরের ২৭ এপ্রিল বনগ্রামে হামলা চালিয়ে ঘরবাড়ি লুট ও অগ্নিসংযোগ এবং ১৭ জনকে অপহরণ। প্রমাণিত না হওয়ায় এই অভিযোগ থেকে তাঁকে খালাস দেন আদালত। রায়ের শেষদিকে বলা হয়, ট্রাইব্যুনালের এই রায়ের বিরুদ্ধে আসামি জাহিদ হোসেন আগামী ৩০ দিনের মধ্যে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করতে পারবেন। তবে এর আগে তাঁকে ট্রাইব্যুনালে এসে আত্মসমর্পণ করতে হবে অথবা তাঁকে গ্রেপ্তার করতে হবে। রায়ের অনুলিপি পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি), ঢাকা ও ফরিদপুরের জেলা ম্যাজিস্ট্রেটদের কাছে পাঠানোর এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। প্রতিক্রিয়া: রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে মামলা পরিচালনাকারী রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি মোকলেছুর রহমান বলেন, এ রায়ে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা ন্যায়বিচার পেয়েছেন। তবে আসামিপক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আবদুস শুকুর খান বলেন, জাহিদ হোসেন ন্যায়বিচার পাননি। তাঁর উচিত আত্মসমর্পণ করে এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা। তিনি আশা প্রকাশ করেন, সর্বোচ্চ আদালতে জাহিদ হোসেন ন্যায়বিচার পাবেন। রায় দ্রুত কার্যকরের দাবি ফরিদপুর অফিস জানায়, জাহিদ হোসেনের ফাঁসির রায়ে সন্তোষ ও স্বস্তি প্রকাশ করেছে নগরকান্দা ও সালথার ভুক্তভোগী মানুষসহ এলাকাবাসী। তাঁরা নগরকান্দা পৌর বিএনপির সহসভাপতি জাহিদের রায় দ্রুত কার্যকরের দাবি জানিয়েছেন। রায়ের পর প্রতিক্রিয়ায় গোয়ালদি গ্রামের রমেশ চন্দ্র রায় (৭৮) সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, ‘একাত্তরের ৩১ মে আমার ঠাকুরদা রাজেন্দ্র চন্দ্র রায়কে হত্যা করে জাহিদ। জাহিদের ফাঁসি কার্যকর হলে আমরা শান্তি পাব, স্বস্তি পাবে ঠাকুরদার বিদেহী আত্মা।’ গোয়ালদির নিহত শিশু বুলু খাতুনের ভাই আবদুল হান্নান মুন্সী (৬৭) বলেন, ‘এই দিনটির অপেক্ষায় ছিলাম। রায় কার্যকর হলেই বুঝব আমার বোনের হত্যার বিচার পেয়েছি।’ একাত্তরে ভাই নুরু মাতুব্বরকে হারানো কোদালিয়া-শহীদনগর ইউনিয়নের ঈশ্বরদী গ্রামের আবুল কাশেম মাতুব্বর (৬২) বলেন, ‘এ রায়ে আমি আনন্দিত। জাহিদের ফাঁসি দেখে মরতে চাই।’ চাঁদেরহাট বণিকপাড়ার ক্ষতিগ্রস্ত রবীন্দ্রনাথ দত্ত রায় দ্রুত কার্যকরের দাবি জানান। রায় ঘোষণার পর আনন্দ মিছিল করে নগরকান্দা ও সালথা উপজেলা আওয়ামী লীগ। জাহিদ ২০১১ সালের ১৭ জানুয়ারির নির্বাচনে নগরকান্দা পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হন। তবে শপথ নেওয়ার পরপরই তিনি পালিয়ে যান। তদন্ত সংস্থার সূত্র জানায়, তিনি বর্তমানে সুইডেনের স্টকহোমে আছেন। নগরকান্দা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বেলায়েত হোসেন বলেন, জাহিদের ফাঁসির দণ্ড কার্যকর হওয়ার মধ্য দিয়ে কলঙ্কমুক্ত হবে নগরকান্দা। নগরকান্দা বিএনপির সভাপতি গিয়াস মণ্ডল বলেন, ‘আমি নিজে মুক্তিযোদ্ধা। আমি মনে করি রায় যথার্থই হয়েছে।’ এদিকে জাহিদ হোসেনের ভাই শামসুল হুদা বলেন, ‘এ রায় নিয়ে আমাদের পরিবারের কোনো বক্তব্য নেই।’

No comments:

Post a Comment