পেরুর রাজধানী লিমাতে জলবায়ুসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সম্মেলন, কপ-২০-এর প্রথম সপ্তাহের আলোচনা শেষে চূড়ান্ত খসড়া গ্রহণের ব্যাপারে অগ্রগতি সীমিত। তবে এ কয় দিনের দর-কষাকষির পর প্রধান গ্রুপগুলোর অবস্থান পরিষ্কার হয়ে এসেছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোর দাবি সত্ত্বেও উন্নত দেশগুলো, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিযোজনের জন্য নতুন অর্থের প্রতিশ্রুতির ব্যাপারে অনাগ্রহ প্রকাশ করেছে। কয়েকটি প
শ্চিম ইউরোপীয় দেশেরও একই অবস্থান। উন্নয়নশীল দেশগুলোর দাবি, এ পর্যন্ত অভিযোজনের জন্য গঠিত ‘সবুজ জলবায়ু তহবিলের’ সমর্থনে যে অনুদানের প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে, নতুন চুক্তিতে উন্নত দেশগুলোকে তার বাইরে নতুন প্রতিশ্রুতি দিতে হবে। জাতিসংঘের অঙ্গ সংস্থা, পরিবেশ কর্মসূচি বা ইউনেপ-এর প্রকাশিত এক নতুন প্রতিবেদন তাদের এ দাবিকে আরও জোরালো করবে। ইউনেপ বলছে, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি থেকে উদ্ভূত সংকট এড়াতে আগের হিসাবের চেয়ে অনেক বেশি অর্থায়নের প্রয়োজন হবে। ইউনেপ এ জন্য উন্নত বিশ্ব থেকে উন্নয়নশীল বিশ্বে লাগসই প্রযুক্তি হস্তান্তর ত্বরান্বিত করার ওপরও জোর দিয়েছে। প্রযুক্তি হস্তান্তরে যে অন্তরায় রয়েছে, তা দূর করে চলতি বিধিনিষেধ সংশোধনেও প্রস্তাব রেখেছে ইউনেপ। গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের মাত্রা নিয়ে উন্নত দেশগুলো নিজেদের মতভেদই কাটিয়ে উঠতে পারেনি। এ প্রেক্ষাপটে অভিযোজনের জন্য অর্থায়ন নিয়ে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে মতভেদের কারণে নতুন জটিলতা দানা বেঁধেছে। জলবায়ু সংকট মোচনে যে অর্থায়ন দরকার, সে প্রশ্নে সম্মেলনে বিলি করা একটি খসড়া কাঠামো (‘নন-পেপার’) নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিবাদ জানিয়েছে। ওই খসড়া কাঠামোতে প্রস্তাব করা হয়, উন্নত দেশগুলো অর্থায়নের যে প্রতিশ্রুতি দেবে, তা তাদের ইতিমধ্যে ঘোষিত অনুদানের বাইরে হতে হবে। উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি ‘সবুজ তহবিলে’র জন্য ৩০০ কোটি ডলার দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে। সুইজারল্যান্ডও অর্থায়নের নতুন প্রতিশ্রুতির বিরুদ্ধে। তারা এমন কথাও বলেছে যে, নতুন অর্থায়নের দাবি বাদ না দেওয়া হলে তারা চুক্তিতে স্বাক্ষর করবে না। লিমা সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী একজন বেসরকারি প্রতিনিধি প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, ইতিপূর্বে বিলি করা ‘নন-পেপারটির’ জায়গায় একটি আনুষ্ঠানিক খসড়া চুক্তি আজ সোমবার নাগাদ সম্মেলনে বিলি করার সম্ভাবনা রয়েছে। সম্মেলন সচিবালয়ের অনুরোধে বিভিন্ন দেশ ইতিমধ্যে তাদের সংশোধিত ‘প্রস্তাবমালা’ সরবরাহ করেছে। কপ থেকে বাংলাদেশের প্রত্যাশা: প্রথম আলোকে পাঠানো লিখিত বার্তায় জলবায়ুবিজ্ঞানী ও লন্ডনভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের সিনিয়র ফেলো সলিমুল হক জানিয়েছেন, বাংলাদেশসহ হুমকির সম্মুখীন উন্নয়নশীল দেশগুলো এই সম্মেলনে দুটি ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট অগ্রগতি প্রত্যাশা করে। প্রথমত, ক্ষতিকর গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস করায় সব দেশের সম্মতি ও দ্বিতীয়ত, জলবায়ু পরিবর্তনের সংকট নিরসনের লক্ষ্যে প্রস্তাবিত ১০ হাজার কোটি ডলারের ‘সবুজ তহবিল’ গঠনে উন্নত দেশগুলোর সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি। সলিমুল হক বলেন, লিমা সম্মেলনের অব্যবহিত পূর্বে এই তহবিলের জন্য কিছু প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে, কিন্তু তা বৈশ্বিক উষ্ণতা রোধে মোটেই পর্যাপ্ত নয়। তাঁর কথায়, এই সম্মেলনের সাফল্য নির্ভর করবে উন্নত দেশগুলো এ পর্যন্ত দেওয়া প্রতিশ্রুতির বাইরে কত দূর পর্যন্ত যেতে সম্মত হয়, তার ওপর। লিমা সম্মেলন বাংলাদেশের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। বৈশ্বিক তাপমাত্রা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে এই দেশের উপকূলবর্তী বিস্তীর্ণ এলাকা জলমগ্ন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এই সংকট কাটিয়ে উঠতে লাগসই অবকাঠামো নির্মাণ ও অভিযোজনের জন্য বাংলাদেশ ও অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশকে সাহায্য করতেই জাতিসংঘের উদ্যোগে ‘সবুজ তহবিল’ গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে জলবায়ু সংকট নিয়ে কাজ করে, এমন বেসরকারি সংগঠনগুলো ‘নগদ প্রাপ্তির লোভে’ অভিযোজনের ফাঁদে না পা দিতে বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোকে আহ্বান জানিয়েছে। প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপচারিতায় বাংলাদেশ এনভায়রনমেন্ট নেটওয়ার্ক (বেন)-এর আন্তর্জাতিক সমন্বয়কারী নজরুল ইসলাম বলেন, শুধু অভিযোজন নয়, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি প্রশমনেও বাংলাদেশ ও অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশকে ভূমিকা রাখতে হবে। অভিযোজন কাজের জন্য হয়তো বিদেশি তহবিল জুটবে, কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশ যে মহাবিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে, তার তুলনায় এই সামান্য অনুদান মোটেই গুরুত্বপূর্ণ নয়। প্রশমন বা মিটিগেশনই হচ্ছে শ্রেষ্ঠ অভিযোজন, বলেন নজরুল ইসলাম। ‘বেন’ এই সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলকে ভারতের ভূমিকায় প্রভাবিত না হওয়ারও পরামর্শ দিয়েছে। দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়ন অর্জনের লক্ষ্যে ভারত জীবাশ্ম জ্বালানি, বিশেষ করে গ্যাস ও তেলের ব্যবহার হ্রাস করতে আগ্রহী নয়। ‘বেন’ বলছে, ভারত একদিকে বাংলাদেশের চারদিকে কাঁটাতারের বেড়া দিচ্ছে, যাতে বাংলাদেশের মানুষ সে দেশে অনুপ্রবেশ না করতে পারে। অন্যদিকে দেশটি ‘প্রশমনে’র বিষয়ে আগ্রহী নয়। কারণ, তারা মনে করে, এতে তাদের দ্রুত উন্নয়নের লক্ষ্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অথচ প্রশমনের অভাবে বাংলাদেশের বিরাট অংশ সাগরের পানিতে নিমজ্জিত হবে এবং অনেক মানুষের অন্যত্র অভিবাসনের প্রয়োজন হবে। বেন মনে করে, জলবায়ু পরিবর্তনের ইস্যুতে ভারত ও বাংলাদেশের স্বার্থের ভিন্নতা আছে। এ কারণে এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশকে সব সময় ভারতের পেছনে সমবেত না হয়ে নিজ স্বার্থ রক্ষায় নিজস্ব অবস্থান গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি সে অবস্থানের পক্ষে অন্যান্য দেশের সঙ্গে জোট গড়ে তুলতে হবে।
No comments:
Post a Comment