Monday, July 7, 2014

রোজা-ঈদ ঘিরে বেপরোয়া জাল টাকার কারবারিরা:কালের কন্ঠ

দেশের বিভিন্ন স্থানে দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে জাল টাকা চক্রের কারবারিরা। দেশি চক্রের সঙ্গে বিদেশিরাও জড়িয়ে পড়েছে এই কাজে। তবে রাজধানী ঢাকায় তারা বেশি সক্রিয়। রোজা ও ঈদ সামনে রেখে তৎপরতা বাড়িয়েছে তারা। মহল্লার বাজার, নামিদামি শপিং মল থেকে শুরু করে ব্যাংকের এটিএম বুথেও মিলছে জাল টাকা। গোয়েন্দাদের অসুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, ১০০০, ৫০০ ও ১০০ টাকার নোট বেশি জাল করছে প্রতারকরা। তবে অভিযোগ রয়েছে, চক্রের সদ
স্যদের বিরুদ্ধে থানায় মামলা হলেও যথাযথ তদন্ত হচ্ছে না। কিছু মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া হলেও দুর্বল তদন্তের কারণে সহজেই জামিন নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে আসামিরা। সাক্ষীর অভাবে আদালতে অনেক মামলার সুরাহা হচ্ছে না। আসামি শনাক্ত না হওয়ায় অনেক মামলা খারিজ করে দিচ্ছেন আদালত। সূত্র জানায়, ১৯৯৮ থেকে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত জাল নোট-সংক্রান্ত মামলা হয়েছে ছয় হাজার ৯৯৫টি। এর মধ্যে আদালতে নিষ্পত্তি হয়েছে মাত্র এক হাজার ২৮৫টি মামলা। প্রায় দেড় হাজারেরও বেশি মামলার তদন্তাধীন। তদন্ত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছে, তদন্ত হিমঘরে আটকে আছে। এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল কালের কণ্ঠকে বলেন, 'জাল টাকা চক্রের সদস্যদের ধরতে পুলিশ-র‌্যাবের অভিযান চলছে। যেসব মামলা থানায় রয়েছে সেগুলো দ্রুত তদন্ত করে অভিযোগপত্র দিতে বলা হয়েছে। রমজান ও ঈদকে সামনে রেখে যাতে প্রতারকরা সক্রিয় হতে না পারে সে জন্য নানা কৌশল নেওয়া হচ্ছে। বিদেশি কিছু চক্র জাল টাকার ব্যবসায় জড়িত আছে বলে আমরা তথ্য পেয়েছি। ওই সব চক্রের সদস্যদের চিহ্নিত করে দ্রুত আইনের আওতায় আনার প্রক্রিয়া চলছে।' গোয়েন্দা সূত্র জানায়, জাল নোট-সংক্রান্ত যেসব মামলার নিষ্পত্তি হয়, সেগুলোতেও আশানুরূপ সাজা হচ্ছে না। এর অন্যতম কারণ, সাক্ষী দিতে আসে না কেউ। গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেও সাক্ষীদের আনা সম্ভব হচ্ছে না। পুলিশ সূত্র জানায়, কিছুদিন আগে যাত্রাবাড়ী থেকে ২৮ হাজার টাকার জাল নোটসহ রহিম নামে একজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। রহিম পুলিশকে জানিয়েছে, রমজান ও ঈদে প্রতারকদের তৎপরতা বেশি থাকবে। জাল টাকা বানানোর সময় কিছু অসাধু ব্যাংক কর্মকর্তার সহযোগিতা নেওয়া হয়। তবে ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে জানিয়েছেন, ঈদের সময় জাল টাকা চক্রের সদস্যরা যাতে সক্রিয় হতে না পারে সে ব্যাপারে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। মাঝে-মধ্যে দেখা যায়, সাক্ষীর অভাবে মামলার তদন্ত ও বিচারকাজে ব্যাঘাত ঘটে। তার পরও পুলিশের আন্তরিকতার অভাব নেই। কত মামলা : পুুলিশ সূত্র জানায়, গত ১৫ বছরে মামলা হয়েছে ছয় হাজার ৯৯৫টি। আদালতে নিষ্পত্তি হয়েছে এক হাজার ২৮৫টি। এর মধ্যে ১৯৯৮ সালে ঢাকাসহ সারা দেশে মামলা ছিল ৭৯৪টি। ওই বছর নিষ্পত্তি হয় ২২টি মামলা। পরের বছর ২৯৬টি মামলার মধ্যে নিষ্পত্তি হয় ১৪টি। ২০০০ সালে মামলা হয় ২৮০টি, নিষ্পত্তি হয় ৫৪টি। ২০০১ সালে ২৫৮ মামলার মধ্যে নিষ্পত্তি হয় ৭৬টি। ২০০২ সালে মামলা হয় ৪৬০টি, নিষ্পত্তি হয় ৮৪টি। ২০০৩ সালে মামলা হয় ৩৭৪টি, নিষ্পত্তি হয় ৯৬টি। ২০০৪ সালে ৩৭১টি মামলার মধ্যে নিষ্পত্তি হয় ১১৮টি। ২০০৫ সালে ৫১৯টি মামলা হয়, নিষ্পত্তি হয় ১৪৮টি। ২০০৬ সালে মামলা হয় ৫০২টি, নিষ্পত্তি হয় ১৯১টি। ২০০৭ সালে ৫২১ মামলার মধ্যে ১৪৬টি নিষ্পত্তি হয়। ২০০৮ সালে মামলা হয় ৪২৪টি, নিষ্পত্তি হয় ১২৩টি। ২০০৯ সালে মামলা হয় ৩৯৩টি, নিষ্পত্তি হয় ১০২টি। ২০১০ সালে মামলা হয় ৪৯০টি, নিষ্পত্তি হয় ৭২টি। ২০১১ সালে মামলা হয় ৪২২টি, নিষ্পত্তি হয় ৩৯টি। ২০১২ সালে মামলা হয়েছে চার শতাধিক, গত বছর হয়েছে ৪৯১টি। পুলিশ হেড কোয়ার্টার্সের এক কর্মকর্তা বলেন, এখনো প্রায় দেড় হাজার মামলার তদন্ত শেষ হয়নি। ঢাকা, চট্টগ্রাম, বরিশাল, ফেনী, বগুড়া, মেহেরপুরসহ অন্তত বিশ জেলায় মামলার সংখ্যা বেশি। মামলাগুলোর তদন্ত দ্রুত শেষ করতে এসপিদের বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আদালতে বিচারাধীন মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি হবে বলে আশাবাদী তিনি। এ ব্যাপারে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের জাল টাকা প্রতিরোধ টিমের এক কর্মকর্তা বলেন, সাক্ষী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে তাদের কোনো দুর্বলতা থাকে না। মাঝে মধ্যে সাক্ষী আদালতে হাজির করা হলেও আসামিপক্ষের আইনজীবীরা টালবাহানা করতে থাকেন। একপর্যায়ে সাক্ষীরা গতি হারিয়ে ফেলেন। জাল টাকার শাস্তি : ডিবির এক কর্মকর্তা ও এক আইনজীবী কালের কণ্ঠকে বলেন, ১৯৭২ সালের সংশোধিত আইনে জাল টাকার কারবারিদের মৃত্যুদণ্ডের শাস্তির বিধান ছিল। ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে জাল টাকা বা জাল স্ট্যাম্পের সঙ্গে জড়িতদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডের বিধান করা হয়। পরে ১৯৮৭ সালের ১৯ জানুয়ারি আইন সংশোধন করে জাল নোটের সঙ্গে জড়িতদের মৃত্যুদণ্ড বা ১৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডসহ অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড দেওয়ার বিধান রাখা হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, কিছু ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা জাল সিন্ডিকেটের (চক্র) সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন বলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অভিযোগ রয়েছে। তাঁরা পুলিশ বা র‌্যাবকে ফাঁকি দিয়ে জাল নোট বাজারে ছাড়ছেন। বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থা-এসবির সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাজারে প্রায় ৫০০ কোটি টাকার বেশি জাল নোট রয়েছে। বাংলাদেশের পাশাপাশি বিদেশি কয়েকটি সিন্ডিকেটও জাল টাকা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। বেড়েছে জাল নোটের দামও : জাল নোট বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক পর্যালোচনায় বলা হয়েছে, প্রতারক চক্র আগের তুলনায় জাল নোটের দাম বাড়িয়েছে। আগে প্রতি লাখ জাল টাকা বিক্রি হতো সাত থেকে ১০ হাজার টাকায়। এখন বিক্রি হচ্ছে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পাশাপাশি বিভিন্ন বাহিনীর তৎপরতার কারণে জাল নোট তৈরির প্রবণতা কমেছে, তাই দাম বেড়েছে বলে মনে করছেন ডিবির এডিসি ছানোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে মুদ্রা জালিয়াতির ঘটনা ঘটছে বাংলাদেশে। তার পরে আছে যুক্তরাষ্ট্র। জাল টাকা শনাক্ত মেশিন : ঈদ ঘিরে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে জাল নোট শনাক্তকরণ মেশিন সরবরাহ করা হয়। এটিএম বুথ, বাজার ও পশুর হাটে মেশিন সরবরাহ করা হয়। সর্বশেষ গত ঈদুল আজহায় পশুর হাটগুলোর জন্য ২০০টি জাল নোট শনাক্তকারী মেশিন দেওয়া হয়।    

No comments:

Post a Comment