Monday, July 7, 2014

ব্যয় তিন গুণ বেশি!:কালের কন্ঠ

কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে প্রতি মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে সাধারণত ১০ থেকে ১২ কোটি টাকার মতো খরচ হয়। বাংলাদেশসহ আন্তর্জাতিকভাবে এ হিসাবই মোটামুটি স্বীকৃত। বাগেরহাটের রামপালে এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের কয়লাভিত্তিক যে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি বর্তমানে বাস্তবায়নাধীন রয়েছে, সেটিরও প্রতি মেগাওয়াট উৎপাদনে ব্যয় ধরা হয়েছে ১১ কোটি টাকা। এ ছাড়া দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়ায় নির্মাণাধীন ২৭৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যু
ৎকেন্দ্রে প্রতি মেগাওয়াটের উৎপাদন ব্যয় হবে ১০ কোটি টাকা। কিন্তু কক্সবাজারের মাতারবাড়ীতে প্রস্তাবিত এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটিতে প্রতি মেগাওয়াট উৎপাদন ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৪ কোটি টাকা। পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রস্তাবিত এই ব্যয় অস্বাভাবিক। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ীও এটি অবাস্তব। এখান থেকে পুকুরচুরির ধান্দা চলছে বলেও মন্তব্য করেন তাঁরা। জানা যায়, মাতারবাড়ী গ্রামে প্রস্তাবিত বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে উৎপাদন ব্যয় ছাড়াও অন্য সব খাতে যে ব্যয় ধরা হয়েছে, সেগুলোও চোখ কপালে ওঠার মতো। যন্ত্রপাতি ক্রয়, পরামর্শক নিয়োগ, ভূমি উন্নয়ন, ভূমি অধিগ্রহণ, যানবাহন ক্রয়সহ সব খাতেই অবিশ্বাস্য অর্থ বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য আমদানি করা কয়লার দামও ধরা হয়েছে বর্তমান বাজারমূল্যের চেয়ে অনেক বেশি। এসব কারণে অস্বাভাবিকভাবে প্রকল্পের মোট ব্যয় বেড়ে গেছে। অবাস্তব এই প্রস্তাবের ওপর আপত্তি জানিয়ে পরিকল্পনা কমিশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলেছেন, এতে অর্থ অপচয় ও আত্মসাতের আশঙ্কা রয়েছে। চূড়ান্ত অনুমোদনের আগে এই প্রকল্পের ব্যয় বাস্তবসম্মত করার পরামর্শ দিয়েছেন তাঁরা। বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, মাতারবাড়ীতে এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পটি বর্তমান সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকার প্রকল্প। এই বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ৪০ হাজার ৩২১ কোটি টাকা। এর বেশির ভাগ অর্থই আসবে জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগী সংস্থা (জাইকা) থেকে। সংস্থাটি বৃহৎ এই প্রকল্পে বাংলাদেশকে ২৮ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা ঋণ দেবে। এ ছাড়া সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে জোগান দেওয়া হবে সাত হাজার ৩৩৮ কোটি টাকা। বাকি তিন হাজার ৯৯৮ কোটি টাকা আসবে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা কোল পাওয়ার জেনারেশন কম্পানি লিমিটেডের (সিপিজিসিবিএল) নিজস্ব উৎস থেকে। জাইকার সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের ঋণ চুক্তি এরই মধ্যে সই হয়েছে। ২০২৩ সালে এই প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা। জানা যায়, জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদনের আগে গত সপ্তাহে এই প্রকল্পের ওপর পরিকল্পনা কমিশনে এক জরুরি বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বৈঠকে বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব, কমিশনের সদস্যসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে এই প্রকল্পের খাতভিত্তিক যে ব্যয় ধরা হয়েছে, তাতে আপত্তি তুলে সংশোধনের পরামর্শ দিয়েছেন কমিশনের সদস্যরা। দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, ৬২০ মেগাওয়াট পিকিং পাওয়ার প্লান্ট এবং বাগেরহাটের রামপাল মৈত্রী তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে মেগাওয়াটপ্রতি উৎপাদন ব্যয় ধরা হয়েছে গড়ে ১০ থেকে ১২ কোটি টাকা। কিন্তু প্রস্তাবিত মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য উৎপাদন ব্যয় কেন ৩৪ কোটি টাকা-  প্রশ্ন করা হলে মাতারবাড়ী প্রকল্পের সিপিজিসিবিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল কাশেম কালের কণ্ঠকে বলেন, অন্য প্রকল্পের সঙ্গে মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্রের তুলনা করাটা ঠিক হবে না। কেননা এটি ভিন্ন একটি প্রকল্প। এর সমজাতীয় প্রকল্প আর নেই। কারণ মাতারবাড়ীতে শুধু বিদ্যুৎকেন্দ্রই নির্মাণ হবে না, সেখানে বন্দর, চ্যানেল, জেটিও নির্মিত হবে। সর্বোপরি সেখানে অত্যাধুনিক শহরও নির্মিত হবে। একই সঙ্গে রাস্তা-ঘাট ও অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণ করা হবে। এসব কারণে এই প্রকল্পের উৎপাদন ব্যয়ও বেশি ধরা হয়েছে। দরপত্র আহ্বানের পর ব্যয় কমে যাবে বলে দাবি করেন এমডি। তবে এ যুক্তির সঙ্গে একমত নন পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক বি ডি রহমতউল্লাহ। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘পৃথিবীর অন্যান্য দেশে যেসব তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মিত হয়, তা শহর থেকে অনেক দূরেই হয়। সেখানে নতুন করে অবকাঠামো নির্মাণ করতে হয়। তার পরও মেগাওয়াটপ্রতি এত দাম পড়ে না। মাতারবাড়ীতে ব্যয়ের যে প্রস্তাব করা হয়েছে, বাস্তবতার সঙ্গে তার কোনো মিল নেই।’ তিনি বলেন, ‘এখান থেকে চুরি করার ধান্দা করা হচ্ছে। এ ছাড়া আর কিছু নয়।’ জানা যায়, তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে যে পরিমাণ কয়লার প্রয়োজন হবে, তা অস্ট্রেলিয়া, ইন্দোনেশিয়া, মোজাম্বিক ও দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আমদানি করা হবে। এতে পরিবহনসহ প্রতি টন কয়লার দাম ধরা হয়েছে ১০ হাজার ২৫৫ টাকা। কিন্তু কমিশন ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমান বাজারমূল্যের সঙ্গে এই ব্যয়ের মিল নেই। আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি টন কয়লার দাম আট থেকে ৯ হাজার টাকার মধ্যে। এ প্রসঙ্গে বি ডি রহমত উল্লাহ বলেন, প্রতি টন কয়লার দাম ৯ হাজার টাকার বেশি হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এই প্রকল্পের আওতায় মোট ৪০টি যানবাহন কেনার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগের পক্ষ থেকে। এর মধ্যে রয়েছে ৯টি জিপ, সাতটি ডাবল কেবিন পিকআপ, দুটি মাইক্রোবাস, তিনটি কার, ১৬টি মোটরসাইকেল, দুটি স্পিডবোট এবং একটি অ্যাম্বুল্যান্স। এসব যানবাহন কেনা বাবদ ব্যয় ধরা হয়েছে ২২ কোটি টাকা। কিন্তু বিদ্যুৎ বিভাগের এই প্রস্তাবে আপত্তি জানিয়েছেন কমিশনের সদস্য ড. শামসুল আলম। গত সপ্তাহে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে তিনি বলেন, একটি প্রকল্পের আওতায় এত যানবাহন কেনার কোনো প্রয়োজন নেই। যানবাহনের পরিমাণ কমিয়ে অর্থ সাশ্রয়ের পরামর্শ দেন তিনি। প্রস্তাবিত মাতারবাড়ী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে পরামর্শক খাতেও অস্বাভাবিক অর্থ বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। এই খাতে সাড়ে ৬০০ কোটি টাকা রাখা হয়েছে। কিন্তু এই প্রস্তাবেও প্রশ্ন তুলে কমিশন বলছে, বাংলাদেশ ও জাপানের বিশেষজ্ঞদের জন্য পরামর্শক বাবদ যে টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে, তা অযৌক্তিক। এটাকেও যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনার পরামর্শ দেওয়া হয় ওই বৈঠকে। জানা গেছে, এক হাজার ৪৮২ একর জমির ওপর মাতারবাড়ী তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মিত হবে। দেশের জমিস্বল্পতার কথা বিবেচনা করে তা কমানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া প্রায় দেড় হাজার একর জমি অধিগ্রহণে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। এই ব্যয়ও কমানোর কথা বলা হয়েছে। তবে বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা বলেছেন, প্রায় দেড় হাজার একর জমির ওপর বিদ্যুৎকেন্দ্র ছাড়াও জেটি, রাস্তা, বাঁধ নির্মাণ করা হবে। এ ছাড়া আবাসিক ভবন, মাধ্যমিক বিদ্যালয়, কলেজ ভবনও নির্মাণ করা হবে। পাশাপাশি মসজিদ, শপিং সেন্টার, হাসপাতাল, ডরমিটরি, রেস্টহাউস, বিনোদন পার্ক, লেক ও পুকুর নির্মাণেরও পরিকল্পনা রয়েছে। সব মিলিয়ে মাতারবাড়ী গ্রামকে একটি অত্যাধুনিক শহর হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতেই এসব ব্যয় ধরা হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ এম শামসুল আলম এ ব্যাপারে কালের কণ্ঠকে বলেন, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে যে ব্যয় ধরা হয়েছে, এর কোনো কারিগরি ও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। সম্পূর্ণ অনুমান করে এই ব্যয় ধরা হয়েছে। কারণ, প্রতি মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় কোনোভাবেই ৩৪ কোটি টাকা হতে পারে না। তিনি বলেন, মাতারবাড়ীতে আবাসিক ভবন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শপিং সেন্টার, হাসপাতালের মতো অবকাঠামো নির্মাণ করা হলে সেগুলোর জন্য আলাদা বরাদ্দ রাখার কথা। সেই ব্যয়কে উৎপাদন ব্যয়ের সঙ্গে যুক্ত করার মানে নেই। শামসুল আলম বলেন, মাতারবাড়ীকে অর্থনৈতিক হাব হিসেবে গড়ে তোলা হবে, সেটা ভালো কথা। কিন্তু সেটা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের সঙ্গে মেলানো হলে তা হবে সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। যদি সেটা করা হয়ে থাকে, তা গায়ের জোরে করা হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। জানা যায়, এই প্রকল্পের আওতায় ৩৭৩ ইউনিট আবাসিক ভবন নির্মাণ করা হবে। এ জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ১৩২ কোটি টাকা। এত বিশাল ভবন নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে কমিশন। এ ছাড়া প্রকল্প অফিসের জন্য আসবাবপত্র, যন্ত্রপাতি সংগ্রহের জন্য ১৩ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। এই ব্যয়ও কমানো যেতে পারে বলে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এদিকে কমিশনের কর্মকর্তারা অভিযোগ করেছেন, বিশাল আকারের এই প্রকল্পে বাস্তবায়নকারী সংস্থার অবদান খুবই কম। সিপিজিসিবিএল এই প্রকল্পে মাত্র চার হাজার কোটি টাকা জোগান দিচ্ছে। অবকাঠামো উন্নয়নে সংস্থার নিজস্ব তহবিল থেকে অর্থ জোগানের ব্যবস্থা রাখা হয়নি। শুধু জনবল ও বেতন-ভাতা খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে। সরকারি তহবিলের দিকেই কম্পানির ঝোঁক বলে অভিযোগ করেছেন কমিশনের কর্মকর্তারা। তবে সিপিজিসিবিএলের কর্মকর্তারা বলেছেন, তাঁদের এই কম্পানি নতুন করে গঠন করা হয়েছে। এ জন্য তাঁদের কোষাগারে অর্থের সংকট রয়েছে। তাই এই প্রকল্পে প্রত্যাশামাফিক অর্থ বরাদ্দ দেওয়া যায়নি। আগামী অর্থবছরে এই প্রকল্পের জন্য অর্থ বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে ১৭৪ কোটি টাকা। অথচ পুরো বিদ্যুৎ বিভাগের ৫০টিরও বেশি প্রকল্পের জন্য থোক বরাদ্দ রয়েছে ২১৯ কোটি টাকা। শুধু একটি প্রকল্পে ১৭৪ কোটি টাকা বরাদ্দ দিলে বাকিগুলোর কী অবস্থা হবে, এমন প্রশ্নেরও কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা।

No comments:

Post a Comment