পরিবারের সাথে ঈদ করতে তিন বছর পর মালয়েশিয়া থেকে গত বৃহস্পতিবার দেশে এসেছেন ভোলার আবদুস ছালাম। ট্যাক্সিতে ভাইকে নিয়ে বিমানবন্দর থেকে বিকেল সাড়ে ৪টায় সদরঘাট টার্মিনাল ভবনের ভিআইপি গেটের সামনে পৌঁছতেই কুলিরা ঘিরে ধরে তাদের। নিজেরাই মালামাল নিতে পারবেন বললেও কোনো কাজ হয়নি। ইজারাদারের নিয়োজিত কুলিদের সাফ কথা নিজেরা বহন করলেও মালামালের জন্য দেড় হাজার টাকা দিতে হবে তাদের। এক হাজার টাকা মাল পরিবহনের জন্য
আর ৫০০ টাকা ঈদের বকশিশ। অনেক অনুরোধের পর এক হাজার টাকায় পার পান সালাম। পটুয়াখালীর যাত্রী মনোয়ার হোসেনের কাছ থেকে হাতে বহনকৃত একটি লাগেজের জন্য দেড় শ’ টাকা দাবি করল এক কুলি। পরে এক শ’ টাকায় রক্ষা তার। আমতলীর যাত্রী সিরাজুল ইসলাম ২৫ কেজি চালের বস্তা এবং একটি ব্যাগ নিয়ে টার্মিনালে নামেন। কুলিরা তাকে ঘিরে ধরে এক শ’ টাকা দাবি করে। টাকা না দিলে বস্তা যাবে না বলে টেনে-হিঁচড়ে সিরাজুলের মাথা থেকে চালের বস্তা নামিয়ে ফেলে কুলিরা। অনেক কাকতি মিনতি করার পরও অসহায় ও গরিব এই যাত্রীর কাছ থেকে ৫০ টাকা আদায় করা হয়। ঢাকার সদরঘাট টার্মিনালে ঈদকে সামনে রেখে যাত্রীদের মালামাল পরিবহনে কুলিদের দৌরাত্ম্য চরম পর্যায় পৌঁছেছে। প্রতিদিন এতে হাতে নাজেহাল হচ্ছেন যাত্রীরা। এমনকি কুলিদের টানাটানির কারণে টাকা ও মোবাইল গায়েব হয়ে যাচ্ছে যাত্রীদের পকেট থেকে। একই সাথে ঘাটে তৎপর পকেটমার, টানা পার্টি ও অজ্ঞান পার্টি। নদীবন্দর সূত্র জানায়, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপ (বিআইডব্লিউটিএ) ২০১০ সালের ১ জুলাই ঢাকা নদীবন্দরের অধীন সদরঘাট টার্মিনালে যাত্রী হয়রানি বন্ধে ইজারা প্রথা বাতিল করেন। নৌ যোগাযোগের এই প্রধান বন্দরটিতে চালু করা হয় শ্রম যার মজুুরি তার নীতিতে শ্রম ব্যবস্থপনা। অর্থাৎ যাত্রী নিজের মালামাল বহন করলে কোনো টোল দিতে হবে না। যদি কোনো যাত্রী দরকার মনে করেন তাহলে মাল বহন করবে কুলি। এ েেত্র সরকার নির্ধারিত প্রতি কেজিতে এক টাকা টোল আদায় করা যাবে। এতে মাস কয়েক সদরঘাট টার্মিনালের চিত্র পাল্টে গিয়েছিল। যাত্রীসাধারণের মালামাল টানাটানি ছিল না। কিন্তু মাস দু-এক যেতে না যেতেই ফিরে যায় আগের অবস্থায়। এখনো তা অব্যাহত আছে এবং ঈদকে কেন্দ্র করে তা চরমে পৌঁছেছে। একটু ভারী মালামাল বহন করলেই যাত্রীদের কাছ থেকে ইচ্ছেমতো টোল আদায় করছে কুলিরা (ঘাট শ্রমিক)। নাজেহালও করা হচ্ছে যাত্রীদের। যাত্রীদের মালামাল পরিবহন ইজারামুক্ত হলেও ইচ্ছামতো টোল আদায় করছে ইজারাদারের নিয়োজিত শ্রমিকেরা। ঢাকা নদীবন্দরের বন্দর কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম কুলিদের হাতে যাত্রী হয়রানির কথা স্বীকার করে বলেন, মাঝে মধ্যে যাত্রী হয়রানির অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু হয়রানির শিকার হলেও যাত্রীরা বেশির ভাগ সময় অভিযোগ করে না বলে ব্যবস্থা নেয়া যায় না। যতদূর সম্ভব শোনার সাথে সাথে ব্যবস্থা নেয়া হয়। আমাদের তদারকি বাড়ানো হচ্ছে। তিনি বলেন, ইজারাদারের সদিচ্ছা থাকলে মালামাল পরিবহনে যাত্রী হয়রানি বন্ধ করা সম্ভব। সরেজমিন দেখা গেছে, বিআইডব্লিউটিএ প্রতিটি মোটরসাইকেল লঞ্চে তোলা কিংবা ঘাটে নামানোর জন্য ২৫ টাকা নির্ধারণ করে দিলেও ইজারাদারের লোকজন জোর করে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা আদায় করেছে। এ ছাড়া স্টিলের আলমারি টার্মিনাল ভবনের গেট থেকে লঞ্চে তোলা কিংবা ঘাটে নামানোর জন্য ১০০ টাকা নির্ধারণ করা হলেও ৫০০ টাকার নিচে নেয়া হয় না। একইভাবে স্টিল বা কাঠের খাটের জন্য ১০০ টাকা নির্ধারিত থাকলেও ৫০০ টাকা, সব আয়তনের ফ্রিজে ৫০ টাকার স্থলে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা, টেলিভিশন ২০ টাকার স্থলে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা, ২০ কেজি ওজনের ব্যাগ বা বস্তা ২০ টাকার স্থলে ১০০ টাকা, ৩০ কেজি ওজনের দু’টি ব্যাগ ৫০ টাকার স্থলে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা আদায় করা হচ্ছে। এ ছাড়া টার্মিনাল ও পন্টুনে রয়েছে হকার, ছিনতাইকারী, টানা পার্টি, অজ্ঞান পার্টির দৌরাত্ম্য। যাত্রীদের জন্য বিশ্রামাগার থাকে ভাসমান ও অপরাধীদের দখলে। টার্মিনালে ভিড়ের মধ্যে প্রতিদিনই মোবাইল ও টাকা হারাচ্ছেন যাত্রীরা। এ ছাড়া অজ্ঞান পার্টির কবলে পড়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন যাত্রীরা। টানা পার্টি যাত্রীর ব্যাগ কেড়ে নিয়ে দৌড়ে পালাচ্ছে। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌচলাচল (যাত্রী পরিবহন) সংস্থার সাবেক সহসভাপতি সাহাবউদ্দিন মিলন বলেন, আমাদের কাছে অনেক অভিযোগ আসছে যাত্রী হয়রানির। আর ঈদের সময় হয়রানির মাত্রা কয়েক গুণ বেড়ে যায়। টার্মিনালে হয়রানি বন্ধ ও সুষ্ঠু যাত্রী ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে বন্দর কর্মকর্তা ও ইজারাদারকে বারবার বলা হলেও তারা কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছেন না।
No comments:
Post a Comment