Thursday, July 24, 2014

ওষুধও নিরাপদ নয়!:কালের কন্ঠ

র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট আনোয়ার পাশা আফসোসের সুরে বললেন, ‘দেশটাকে খুবই আজব মনে হয়। যে ওষুধ মানুষের জীবন রক্ষা করে, সেই ওষুধ নিয়েই এক শ্রেণির মানুষ অসাধু ব্যবসা করে যাচ্ছে। ভেজাল ও নকল ওষুধ বানিয়ে মানুষকে ঠকিয়ে, মানুষের জীবন বিপন্ন করে টাকা রোজগারে লিপ্ত হচ্ছে।’ খাদ্যে ভেজাল ও বিষ নিয়ে তুমুল হৈচৈ চলছে দেশে। অভিযানও চলছে সমানে। এর মাঝে আবার অভিযান চালাতে হচ্ছে নকল ওষুধের বিরুদ্ধেও।
হাতেনাতে প্রমাণ মিলছে, জীবন রক্ষাকারী ওষুধে কিভাবে অবলীলায় ভেজাল বা বিষ মিশিয়ে বেশি মুনাফার আয়োজন করছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। তাই বলা যায়, ভেজাল খাদ্য খেয়ে অসুস্থ মানুষ চিকিৎসার আওতায় গিয়ে জীবন বাঁচাতে আশ্রয় নেবে যে ওষুধে, সেই ওষুধও এখন আর নিরাপদ নয়। ভেজাল, নকল ও অনুপযোগী ওষুধ ছড়িয়ে পড়ছে দেশজুড়ে। দেশের ভেতরে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী যেমন এসব নকল ও ভেজাল ওষুধ বানিয়ে বাজারে ছাড়ছে, তেমনি আরেক চক্র চোরাই পথে বিভিন্ন দেশ থেকে নিয়ে আসছে অনুমোদনহীন নানা ওষুধ। প্রশাসন অভিযান চালিয়েও নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছে না এসব অবৈধ বাণিজ্য। পরিণতিতে দেশের মানুষের জীবন হয়ে পড়ছে বিপন্ন। ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতির একাধিক সদস্য জানান, ক্যান্সারের মতো জটিল বিভিন্ন রোগের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন জীবন রক্ষাকারী অ্যান্টিবায়োটিক মেরোপেনাম ইনজেকশন। কম্পানিভেদে এর একেকটি ভায়ালের দাম দুই হাজার-আড়াই হাজার টাকা। জানা যাচ্ছে, বড় বড় ওষুধ কম্পানির এ জাতীয় ওষুধও এখন ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় নকল বেরিয়েছে। তবে দেশের সবচেয়ে বড় ওষুধ মার্কেট ঢাকার মিটফোর্ডে কেবল মেরোপেনামই নয়, বেশি প্রচলিত সব ওষুধেরই নকল পাওয়া যায়। বিভিন্ন কম্পানির ও কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে মিটফোর্ডের ব্যবসায়ীদের সতর্ক করা হলেও খুব একটা কাজ হচ্ছে না। ম্যাজিস্ট্রেট আনোয়ার পাশা আরো বলেন, ‘আমরা সাধারণত বিভিন্ন মার্কেটে অভিযান চালিয়ে খুঁজে খুঁজে ভেজাল, নকল ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ জব্দ করে থাকি। এ ছাড়া মাঝেমধ্যে নকল ওষুধের কারখানারও সন্ধান পাই। এ ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ দুই বছর ও সর্বনিম্ন সাত দিনের সাজা দেওয়া হয়ে থাকে।’ সরকারের ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের তথ্য মতে, গত এক বছরে (জুন ২০১৩-জুন ২০১৪) দেশের বিভিন্ন এলাকায় ৬৫৩টি অভিযান চালিয়ে  প্রায় ১০ কোটি টাকা মূল্যের বিভিন্ন ধরনের নকল, ভেজাল, চোরাই, মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ আটক করা হয়েছে। এ সময় বিভিন্ন মেয়াদে ১০৫ জনকে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে এবং দুই কোটি ২৫ লাখ ৯৬ হাজার ৭৫০ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে। ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক সেলিম বারামী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘জীবন রক্ষাকারী ওষুধ নিয়েও এক শ্রেণির মানুষ জঘন্য ব্যবসায় লিপ্ত হচ্ছে। তারা বিভিন্ন জেনেরিকের ওষুধ নকল করে বাজারে ছাড়ছে। এর মধ্যে অ্যান্টিক্যান্সার, অ্যান্টিবায়োটিক থেকে শুরু করে যৌন উদ্দীপক ও হরমোনাল ওষুধও রয়েছে। এ ছাড়া ফুড সাপ্লিমেন্টের অনেক আইটেম বাজারে ছাড়া হচ্ছে, যেগুলো খেলে মানবদেহের কোনো উপকার তো হয়ই না, বরং মারাত্মক ক্ষতি বয়ে আনে।’ ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘মাঝেমধ্যে আমরা বিভিন্ন মাধ্যমে খবর পেয়ে বিভিন্ন স্থানে অভিযান পরিচালনা করে এসব ভেজাল ও নকল ওষুধ উদ্ধার করলেও তা পর্যাপ্ত নয়। বিশেষ করে জনবলের অভাবে প্রয়োজনমতো বাজার মনিটরিং করা সম্ভব হয় না। এ ছাড়া এ ধরনের ব্যবসার সঙ্গে অনেক সময় শক্তিশালী চক্র জড়িত থাকায় ধরা পড়া লোকজন সাজা খেটে কিংবা জামিনে বেরিয়ে আবারও একই ধরনের কাজে লিপ্ত হয়।’ রাজধানীর ধানমণ্ডির বাসিন্দা ব্যবসায়ী আলমগীর হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘অনেক দিন ধরেই জটিল রোগে ভুগছি। প্রতিদিন কয়েক ধরনের ওষুধ খেতে হচ্ছে। জীবন বাঁচানোর জন্য ওষুধ খাব, তাতেও যদি ভেজাল ও নকলের বিপদ থাকে, তবে আর উপায় কী!’ তিনি বলেন, সরকারের উচিত যেকোনো মূল্যে ওষুধকে নিরাপদ রাখা, ওষুধের ভেজাল-নকল ঠেকানো না গেলে, তা খুবই ভয়াবহ ব্যাপার হবে।’ সর্বশেষ এক অভিযান সম্পর্কে র‌্যাবের ম্যাজিস্ট্রেট আনোয়ার পাশা জানান, গত ৯ জুলাই রাজধানীর পল্টনের ২৭/৭/এ তোপখানা রোডের পাঁচতলা বাড়ির নিচতলায় অভিযান চালিয়ে একটি কথিত কারখানা থেকে সাত প্রকারের নকল অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ, ওষুধ তৈরির উপকরণ, লেভেলসহ ২০ লাখ টাকার মালামাল জব্দ করা হয়। নকল ওষুধ তৈরির অভিযোগে কারখানার মালিক আমিনুল এহসানকে দুই বছরের কারাদণ্ড ও দুই লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। তিনি জানান, দণ্ডপ্রাপ্ত আমিনুল বিভিন্ন ওষুধ কম্পানিতে চাকরি করতেন। ১০ বছর আগে চাকরি ছেড়ে নিজেই নকল ওষুধ তৈরির কারখানা করেন। নকল ওষুধ তৈরির ব্যবসা করে তিনি বিপুল সম্পদ গড়ে তুলেছেন। বর্তমান স্থানে পাঁচতলা নিজস্ব বাড়ির নিচতলায় প্রায় সাড়ে তিন বছর ধরে নকল ওষুধ তৈরি করছেন। ওষুধের নকল মোড়ক ও লেভেল প্রিন্টিং প্রেস থেকে ছাপাতেন। বাড়ির নিচতলার তিনটি রুম বাইরে থেকে তালা দিয়ে বন্ধ করে ডুরাসেফ, নাভাসেফ, সিমক্স, সেফক্সসহ সাত প্রকারের দামি অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ তৈরি করতেন। এর মধ্যে নাভাসেফ ওষুধটি শিশুদের জন্য অ্যান্টিবায়োটিক ড্রপ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। বাংলাদেশ কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতির যুগ্ম সম্পাদক মনির হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ওষুধের দোকানে অভিযান চালানো হয়। আমরা এর কোনো যৌক্তিকতা খুঁজে পাই না। কারণ ওষুধ তো আর দোকানদাররা বানায় না, বানায় কোনো না কোনো ওষুধ কম্পানি। সাধারণত এক শ্রেণির ওষুধ কম্পানি বিদেশ থেকে নিম্নমানের কাঁচামাল আমদানি করে তা অপেক্ষাকৃত ছোট বা অখ্যাত কম্পানির কাছে বিক্রি করে; আবার কেউ কেউ মিটফোর্ডের কাঁচামালের মার্কেটেও পরোক্ষভাবে ব্যবসায় যুক্ত থাকে। ফলে নিম্নমানের, নকল বা ভেজাল ওষুধ তৈরিতে মূল অপরাধী হচ্ছে ওষুধ প্রস্তুতকারী কম্পানি। কিন্তু এসব কম্পানি সব সময়ই রহস্যজনক কারণে ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়।’ ওষুধ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, ভেজাল ও নকল ওষুধের পাশাপাশি পার্শ্ববর্তী দেশসহ বিভিন্ন দেশ থেকে এ দেশের কিছু হাসপাতাল, ক্লিনিক ও এক শ্রেণির ডাক্তার চোরাই পথে মূল্যবান কিছু ওষুধ আনিয়ে থাকেন, যে ওষুধগুলো এ দেশের মানুষের জন্য উপযুক্ত নয় বলে অনুমোদন দেওয়া হয় না। আবার কিছু ওষুধ আছে, যেগুলো এ দেশে বহুল উৎপাদিত হওয়ার ফলে বাইরে থেকে আনার প্রয়োজন নেই। দেশের বড় কয়েকটি হাসপাতাল এ চক্রের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। গত ৯ জুলাই হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে অবৈধভাবে আমদানি করা প্রায় দুই কোটি টাকার ওষুধ আটক করে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, শাহজালালের কাস্টমস হলের কনভেয়ার বেল্ট থেকে দুটি লাগেজ আটক করা হয়। পরে তল্লাশি করে গর্ভপাতের, ব্যথানাশক বিভিন্ন ধরনের ওষুধ উদ্ধার করা হয়। ওষুধগুলো পাকিস্তানের তৈরি। তবে এগুলো দুবাই থেকে ইত্তেহাদের একটি ফ্লাইটে করে ঢাকায় আনা হয়। এর আগে গত এপ্রিলের শেষ দিকে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের এক অভিযানে ফাইভ স্টার হাসপাতাল বলে পরিচিত স্কয়ার, অ্যাপোলো, শমরিতা, ল্যাবএইড, ইউনাইটেড, সেন্ট্রাল হাসপাতালসহ আরো কয়েকটি হাসপাতাল থেকে উদ্ধার করা হয়েছে বিপুল পরিমাণ অবৈধ ওষুধ। এসব ওষুধ বৈধ প্রক্রিয়ায় দেশে আমদানি হয়নি কিংবা বাংলাদেশে বাজারজাত করার জন্য অনুমোদনও ছিল না। ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর সূত্র জানায়, দেশের বাজারে চোরাই পথে আসা এক শর বেশি বিদেশি ওষুধ রয়েছে বলে তাদের নজরে আছে। এর মধ্যে ৪০-৪২টি সবচেয়ে বেশি প্রচলিত। এসবের মধ্যে সর্দি-জ্বর, ব্যথানাশকের ওষুধ থেকে শুরু করে ক্যান্সার, হৃদরোগ ও যৌন উদ্দীপক ওষুধও রয়েছে। পাশাপাশি কয়েকটি নিষিদ্ধ ওষুধও রয়েছে। এসব ওষুধের মধ্যে আমেরিকা, জার্মানি, থাইল্যান্ড, ভারত ও পাকিস্তানের ওষুধই বেশি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক আ ব ম ফারুক কালের কণ্ঠকে বলেন, সাধারণত যেসব ওষুধ বাংলাদেশে প্রয়োজন নেই কিংবা মানুষের জন্য ক্ষতিকর, এসব ওষুধই সরকার অনুমোদন দেয়নি। কিন্তু এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী অধিক মুনাফার আশায় এসব অবৈধ, নিষিদ্ধ ও ক্ষতিকর ওষুধ চোরাই পথে দেশে ঢুকিয়ে ছোট-বড় বিভিন্ন হাসপাতাল ও ফার্মেসিতে বিক্রি করে থাকে। এর আগে গত বছরের শেষ দিকে ঢাকার মিটফোর্ডের পাঁচ শতাধিক ওষুধের দোকানে অভিযানকালে ৮০টি দোকান ও গোডাউন থেকে বিপুল পরিমাণ নকল, ভেজাল, আন-রেজিস্টার্ড, ক্ষতিকর ওষুধ, ফুড সাপ্লিমেন্ট, মেডিক্যাল ডিভাইস, সার্জিক্যাল আইটেম উদ্ধার ও জব্দ করা হয়। এসব ওষুধের মধ্যে নকল ও মেয়াদোত্তীর্ণ অ্যান্টিবায়োটিক, অ্যান্টিহিস্টামিন, ভিটামিন, হরমোন, যৌন উত্তেজক, ব্যথানাশক ও স্টেরয়েড আইটেম ছিল। ওষুধ ও জনস্বাস্থ্য খাতের বিশেষজ্ঞরা জানান, নকল, ভেজাল, নিম্নমানের বা মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধের প্রসঙ্গ এলেই চলে আসে ঢাকার মিটফোর্ড ওষুধ মার্কেটের নাম। ওই এলাকার প্রায় তিন হাজার পাইকারি ওষুধ ও কেমিক্যালের দোকানের মধ্যে অনেকেই এ ধরনের অসাধু ব্যবসায় যুক্ত। এদিকে কেবল বেনামি বা অখ্যাত কম্পানিই নয়, কোনো কোনো খ্যাতিমান কম্পানিও সুকৌশলে অসাধু সুবিধা আদায়ে বহুল প্রচলিত ওষুধের সঙ্গে ভেজাল মিশিয়ে বাজারে ছাড়ছে। কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতির নেতা মনির হোসেন বলেন, ‘আমরা জানি, অনেক ওষুধ কম্পানি বিদেশে রপ্তানির জন্য উন্নতমানের ওষুধ বানালেও দেশের মার্কেটের জন্য নিম্নমানের ওষুধ বানিয়ে থাকে, নানা ভেজাল দিয়ে থাকে। কিন্তু সেগুলোর দিকে কর্তৃপক্ষ কোনোই নজর দিচ্ছে না। বরং নেপথ্যে থাকা অপরাধীচক্রের কারণে নিরীহ ব্যবসায়ীরাও হয়রানি ও ক্ষতিগ্রস্ত হন।’ মনির হোসেন বলেন ‘আমরাও চাই ওষুধের ব্যবসায় স্বচ্ছতা আসুক, দুর্নাম দূর হোক। ওষুধে ভেজাল বা নকল কোনোভাবেই কারো কাম্য হওয়া উচিত না।

No comments:

Post a Comment