দারিদ্র্য বিমোচনের নামে দেশের ২৯১টি উপজেলায় প্রায় পাঁচ লাখ গ্রাহককে ৪১১ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এসব গ্রাহকের অর্ধেকই এখন ঋণখেলাপি। খেলাপিদের বেশির ভাগই প্রকৃত গরিব নন। তাঁদের নামে ঋণ নিয়েছেন স্থানীয় প্রভাবশালী, টাউট, ঋণ বিতরণকারী মাঠ কর্মকর্তা ও পদস্থ কর্মকর্তাদের আত্মীয়স্বজন বা ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিরা। ঋণদানকারী এই আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নাম পল্লী দারিদ্র্য বিমোচন ফাউন্ডেশন (পিডিবিএফ)। সরকারের
পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন এই স্বায়ত্ত–শাসিত প্রতিষ্ঠানটি ‘শতভাগ সফল ও স্বয়ংসম্পূর্ণ’ বলে দাবি করে। গ্রামের গরিব মানুষকে ক্ষুদ্রঋণ দিয়ে স্বাবলম্বী করা এর কাজ হলেও গত প্রায় সাড়ে তিন বছরের চিত্র উল্টো। এই সময়ের মধ্যে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে নানা জালিয়াতি হয়েছে, লুটপাট করা হয়েছে প্রায় শত কোটি টাকা। ভুয়া নাম-ঠিকানা ব্যবহার করে মাঠকর্মীরা কোটি কোটি টাকা ঋণ দিয়েছেন। ঋণ বিতরণ বেশি দেখিয়ে খেলাপি ঋণ ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। অনেক কর্মী টাকা ব্যাংকে জমা না দিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য করছেন। পিডিবিএফের অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষায় এই দুর্নীতি ও লুটপাটের চিত্র বেরিয়ে এসেছে। কানাডার দাতা সংস্থা সিডার অর্থায়নে ২০০০ সালে পিডিবিএফের যাত্রা শুরু। এ পর্যন্ত সিডা ও সরকার এই প্রতিষ্ঠানকে প্রায় ১০০ কোটি টাকা অনুদান দিয়েছে। সরকার পর্যায়ক্রমে আরও ২০০ কোটি টাকা দিচ্ছে নতুন ১০০ উপজেলায় কর্মসূচি সম্প্রসারণের জন্য। স্থায়ী, অস্থায়ী এবং প্রকল্প মিলিয়ে প্রায় চার হাজার জনবল রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বহুমুখী অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতায় জড়িয়ে পড়েছেন এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মাহবুবুর রহমান। তিনি ছিলেন এ প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক এবং তাঁর নিয়োগ নিয়ে শুরুতে প্রশ্ন তোলে বৈদেশিক সাহায্যপুষ্ট প্রকল্পের নিরীক্ষা অধিদপ্তর। নানা কৌশলে তিনি প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হয়ে নীতিনির্ধারণী দুটি পরিচালক (মাঠ পরিচালন ও মানবসম্পদ) এবং সৌরশক্তি প্রকল্পের পরিচালকের পদ কবজা করে রেখেছেন। এসব পদের দায়িত্ব নেওয়ায় মাঠপর্যায়ে ঋণ কার্যক্রম, নিয়োগ, বদলি ও অপসারণের নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী হয়েছেন তিনি। তবে মাহবুবুর রহমানের দাবি, যোগ্য কর্মকর্তা না থাকায় তিনি এসব কাজ দেখভাল করেন। খেলাপি ঋণ বাড়ছে, ঝুঁকিতে কর্মীদের তহবিল: গত মার্চ পর্যন্ত পিডিবিএফের পুরোনো কর্ম এলাকা ২৯১ উপজেলায় খেলাপি ঋণগ্রাহক ছিল ৫১ শতাংশ। মোট ঋণগ্রহীতা চার লাখ ৯৭ হাজার ৪০ জন। এঁদের মধ্যে খেলাপি দুই লাখ ৫৪ হাজার। আর মেয়াদোত্তীর্ণ খেলাপি এক লাখ ৮৪ হাজার, যাঁদের ঋণ ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। এখন পর্যন্ত মাঠে বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ৪১১ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ ৬৫ কোটি ১১ লাখ টাকা। আর খেলাপি ঋণ ২০ কোটি ১৯ লাখ। এই ৮৫ কোটি ৩০ লাখ টাকা খেলাপি বলা হলেও বাকি প্রায় সোয়া তিন শ কোটি টাকার অনেকটাই আছে শুধু হিসাবের খাতায়। প্রতিষ্ঠানটির হিসাব বিভাগের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, বিদ্যমান সংকট চলতে থাকলে ২০১৬ সাল নাগাদ বিপর্যয়ের মুখে পড়বেন কর্মীরা। তাঁদের ভবিষ্য তহবিল, আনুতোষিক, মোটরসাইকেল তহবিল ও কল্যাণ তহবিলের ১৪৮ কোটি টাকা বন্ধক রেখে ১১০ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ নেওয়া হয়েছে। তবে কর্মীদের জমানো ৩০ কোটি ৫০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র কেনা আছে, যা এখন পর্যন্ত নিরাপদ বিনিয়োগ। পিডিবিএফ সূত্রে জানা যায়, একটি সরকারি ও দুটি বেসরকারি ব্যাংক থেকে ঋণ (১২-১৩ শতাংশ সুদে) নিয়ে ক্ষুদ্র ঋণ হিসেবে (১৮ শতাংশ) বিনিয়োগ করা হলেও তা চরম ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। তহবিল-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, একদিকে ব্যাংক ঋণের সুদ দিতে হচ্ছে, অন্যদিকে ওই ঋণের টাকা ক্ষুদ্রঋণ হিসেবে বিতরণ করলে তা খেলাপিদের পকেটে চলে গেছে। পিডিবিএফের প্রধান কার্যালয়ে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সঙ্গে দেখা করে এসব বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বিস্ময় প্রকাশ করে জানতে চান, ‘এসব তথ্য কোথায় পেলেন?’ একপর্যায়ে তিনি বলেন, ঋণ নেওয়া ও দেওয়া চলমান প্রক্রিয়া। এখানে তিনি সংকট দেখছেন না। ফাউন্ডেশনের একজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মাসে ১২-১৪ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করার চেয়ে এদিক-সেদিক করে ১২ থেকে ১৫ লাখ টাকা পকেটে নেওয়াকে নিরাপদ ভাবছেন অনেক মাঠকর্মী। টাকা নেওয়ার পর চাকরি গেলেও তাঁরা সমস্যা মনে করছেন না। ওই টাকা মাঠে ভুয়া ঋণ হিসেবে দেখানোর ফলে প্রকৃত জালিয়াতি উদ্ঘাটনেও বেশ সময় লাগবে। সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে বেশি ঋণ জালিয়াতি ধরা পড়ে বরিশাল অঞ্চলে। ওই অঞ্চলের উপপরিচালক তাছলিমা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, টাকা মেরে কেউ পার পাবে না। তিন সেরা মাঠকর্মীর কাণ্ড: কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করায় সেরা মাঠকর্মী হিসেবে রমা রানী হালদারকে গত বছর মন্ত্রণালয় পুরস্কৃত করে। ‘কাউনিয়া সোনালী সমিতি’র সদস্য পারুল বেগম ও তাঁর মেয়ে হালিমা বেগমকে ভুয়া নামে তিনি ৫৭টি ঋণ দিলেও তাঁরা সাড়ে নয় লাখ টাকা পরিশোধ করতে পারছেন না। ভারতীয় শাড়ির ব্যবসা করা পারুল লোকসানের কারণে টাকা দিতে না পারায় বিষয়টি জানাজানি হয়। নিরীক্ষায় বেরিয়ে এসেছে রমা রানীর সঙ্গে পারুলের যোগসাজশ থাকার বিষয়টি। এ রকম আরও কয়েকটি আর্থিক অনিয়ম করেছেন ওই সেরা কর্মী। নিরীক্ষা দল সরেজমিনে গিয়ে এক সপ্তাহে তাঁর মাত্র ৩৩ শতাংশ ঋণ আদায় পেয়েছে। জানতে চাইলে মাঠ কর্মকর্তা রমা রানী বলেন, এক হাতে এত ঋণ চলে যাওয়ার বিষয়টি তিনি বুঝতে পারেননি। এই ঋণ তিনি আদায় করতে পারবেন। এক বছর সময় নিয়েছেন। বরিশালের বানারীপাড়ায় কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করে পুরস্কৃত ও প্রশংসিত হন সুজলী রানী মজুমদার ও নাছরিন বেগম। দূরবর্তী গ্রামের আত্মীয়স্বজন ও ছিন্নমূল নারীদের সদস্য করে, এমনকি এক ব্যক্তির নামে একাধিক ঋণ দিয়ে টাকার অঙ্ক ও ঋণগ্রহীতার সংখ্যা বাড়িয়েছেন তাঁরা। ঋণ বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানান, এই তিন কর্মী তিন কোটি টাকা বিতরণ করলেও যে পরিমাণ জালিয়াতি হয়েছে, তাতে চাকরি চলে গেলেও তাঁদের লোকসান হবে না । সিডার টাকায় যাত্রা, অতঃপর বিদায়: জবাবদিহির ঊর্ধ্বে থাকতেই ২০০৮ সালে সিডার কাছ থেকে অর্থ সহায়তা নেওয়া বন্ধ করার অভিযোগ রয়েছে। এ প্রসঙ্গে মাহবুবুর রহমান বলেন, সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সঙ্গে সিডা কর্তৃপক্ষের বনিবনা হয়নি। ২০০৯ সালে তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর সিডার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তাদের অনেক শর্ত ছিল, পুরো কর্মকাণ্ড মূল্যায়ন করতে চেয়েছিল। তিনি বলেন, পরিস্থিতি এত দূর গড়িয়েছিল যে নতুনভাবে সিডাকে যুক্ত করার সুযোগ ছিল না। আয়-ব্যয়ে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতেই সিডা সফটওয়্যার তৈরি বাবদ এক কোটি টাকা দিয়েছিল। কিছু টাকা খরচ করার পর বিষয়টি এগোতে দেওয়া হয়নি। এ প্রসঙ্গে ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, এ ধরনের সফটওয়্যার তৈরির চিন্তাভাবনা রয়েছে। ফাউন্ডেশনের কর্মীদের জন্য মোটরসাইকেল কিনতে সিডা নয় কোটি টাকা সুদবিহীন ঋণ দিয়েছিল। ওই তহবিলের আট কোটি টাকা মূল তহবিলে নেওয়া হয়েছে। ফলে মোটরসাইকেল বিতরণ বন্ধ হয়ে গেছে। ব্যবস্থাপনা পরিচালক অবশ্য বলেছেন, শিগগির মোটরসাইকেল বিতরণ শুরু হবে। চার বছর নিরীক্ষা বন্ধ: ফাউন্ডেশনের প্রধান কার্যালয়ে চার বছর ধরে নিরীক্ষা বন্ধ রয়েছে। প্রতিবছরই তা করার কথা। প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটও পুরোনো এবং অসত্য তথ্যে ভরপুর। নিরীক্ষা বন্ধ রেখে প্রতিষ্ঠানের প্রকৃত চিত্র আড়াল করা হচ্ছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, নিয়মিত নিরীক্ষা হচ্ছে। প্রতিবেদন দেখতে চাইলে তিনি ২০১০ সালের পর থেকে কোনো প্রতিবেদন দেখাতে পারেননি। এসব অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা সম্পর্কে জানতে চাইলে পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের সচিব এম এ কাদের সরকার ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। ব্যবস্থাপনা পরিচালকের বক্তব্য নিয়ে আবার যোগাযোগ করা হলে সচিব বলেন, এমন একজন অযোগ্য কর্মকর্তা কীভাবে প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তা হলেন, তা তিনি ভেবে পান না। জরুরি বিষয়গুলো বোর্ডের সামনে এনে তিনি প্রতিষ্ঠানের আসল চেহারা আড়াল করে রাখেন। সাম্প্রতিক সময়ে অনিয়ম-দুর্নীতির বেশ কিছু অভিযোগ পাওয়ার কথা উল্লেখ করে সচিব জানান, এগুলো বোর্ড সভায় আলোচনা করে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের সচিব পদাধিকারবলে ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান। বতর্মান ও সাবেক কয়েকজন সচিব ঘাপলা বুঝতে পেরে ফাউন্ডেশনের আর্থিক প্রতিবেদনে সই করছেন না। এ প্রসঙ্গে ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, সই না করলেও সচিব মন্ত্রণালয়ের প্রধান হিসাব কর্মকর্তা। সচিব ছাড়াও পিডিবিএফের বোর্ড সদস্যদের মধ্যে আছেন বিআরডিবির মহাপরিচালক, রূপালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান, অর্থ মন্ত্রণালয়ের একজন যুগ্ম সচিব, একজন অধ্যাপক এবং ক্ষুদ্র ঋণগ্রহীতা তিনটি সমিতির তিনজন সদস্য। জানতে চাইলে বোর্ডের সদস্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ফেরদৌস জাহান বলেন, প্রতিষ্ঠানটির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ভালো ছিল। কিন্তু বাইরে থেকে এর প্রকৃত অবস্থা বোঝা ততটা সম্ভব নয়।
No comments:
Post a Comment