Wednesday, August 13, 2014

মাওয়ায় লঞ্চডুবি : সাক্ষ্য দিতে গিয়ে স্বজনদের আহাজারি:নয়াদিগন্ত

‘আমি টাকা চাই না। আমার সন্তানকে ভিক্ষা চাই। তোমরা আমার সন্তানকে ফিরিয়ে দাও। আমি কি নিয়া বাচুম। আমার বুক খালি হয়ে গেছে। আমার মাকে ছাড়া আমি বাঁচব না।’ পদ্মায় পিনাক-৬ দুর্ঘটনার পর গঠিত তদন্ত কমিটির কাছে সাক্ষ্য দিতে এসে এ কথা বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন গাজীপুরের কাপাসিয়া উত্তরখাম গ্রামের বিউটি আক্তার (৪৫)। ঈদের পর পরিবারের সাথে বেড়িয়ে ফিরছিলেন দাদার বাড়ি ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেরার পীরেরচর গ্রাম থেকে। পরিবা
রের অন্য সদস্যদের সাথে তার ১৪ বছরের মেয়ে ইসরাত জাহান মিমও ছিল। অন্যরা বাঁচলেও বাঁচাতে পারেননি মেয়ে মিমকে। মিমের কথা বলতে গিয়ে একপর্যায়ে জ্ঞান হারান তিনি। এরপর সুস্থ করে সাক্ষ্য নেয়া হয় তার। পদ্মায় ডুবে যাওয়া পিনাক-৬ উদ্ধারকার্যক্রম বন্ধ করে এখন সাক্ষ্য গ্রহণ করছে তদন্ত কমিটি। গতকাল সকাল থেকে মাওয়া রেস্ট হাউজে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটির সাক্ষ্য গ্রহণ করে। দুর্ঘটনাকবলিত লঞ্চ থেকে বেঁচে যাওয়া যাত্রী, প্রত্যক্ষদর্শী ও নদী থেকে ভাসমান যাত্রীদের তুলে আনা স্পিডবোট চালকদের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়। গতকাল মঙ্গলবার বেঁচে ফিরে আসা পাঁচজনসহ দু’জন স্পিডবোট চালক সাক্ষ্য দেন। তদন্ত কমিটি বলছে, দুর্ঘটনার কারণ উদঘাটন করে তা চিহ্নিত করা এবং এ নৌরুটে যাতে আর কোনো দুর্ঘটনা না হয় সে ব্যাপারে একটি সুপারিশ পেশ করার জন্য মূলত এই সাক্ষ্য গ্রহণ করা হচ্ছে। গতকাল বেলা সাড়ে ১১টা থেকে সাক্ষ্য গ্রহণ করেন নৌ মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব নুরুর রহমানকে প্রধান করে গঠিত সাত সদস্যের তদন্ত টিম। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন বুয়েটের অধ্যাপক গৌতম কুমার সাহা, ডিআইডব্লিউটিএ’র প্রকৌশল বিভাগের সদস্য ফিরোজ আহমেদ, নৌ মন্ত্রণালয়ের চিফ নটিক্যাল সার্ভেয়ার মো: কে এম জসিম উদ্দিন, সমুদ্র পরিবহন অধিদফতরের ম্যাজিস্ট্রেট সাইফুল হাসান, বিআইডব্লিউটিসির প্রধান প্রকৌশলী (অতিরিক্ত) আব্দুর রহিম তালুকদার, মুন্সীগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) নজরুল ইসলাম সরকার। অপর দিকে সাক্ষ্য দিয়েছেন বেঁচে যাওয়া যাত্রীদের ও প্রত্যক্ষদর্শীদের মধ্যে মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার হাসমকান্দি গ্রামের আবুল কালাম (৬০), গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলার ছোকারকান্দি গ্রামের আনিসুর রহমান (৩৮), গাজীপুর জেলার কাপাসিয়া উপজেলার উত্তরখামের বিউটি আক্তার (৪৫), ফরিদপুর ভাঙ্গা উপজেলার সরইবাড়ী গ্রামের রবিউলের স্ত্রী চামেলী বেগম (৩৬), মাদারীপুরের শিবচরের সুমন মাহমুদ (২০), মাদারীপুরের শিবচরের বাংলাবাজার গ্রামের ইদ্রিস ঢালী (৬০), স্পিডবোট চালক লৌহজং উপজেলার মাহাবুব হোসেন, মনিরুজ্জামান মনির, ওয়াহিদ সরদার ও আসাদুল। কমিটির প্রধান নুরুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, এ দুর্ঘটনার কারণ জেনে সেটা নিশ্চিত করতে হবে। এরপর যাতে করে এ নৌরুটে আর কোনো দুর্ঘটনা না হয় সে ব্যাপারে একটি রিপোর্ট দিতে হবে। আগামী ১০ কার্যদিবসের মধ্যে রিপোর্ট পেশ করবে এ তদন্ত কমিটি। তিনি বলেন, গতকাল প্রত্যক্ষদর্শী পাঁচজনসহ সাতজনের শুনানি গ্রহণ করা হয়েছে। একই সাথে মাওয়া থেকে মাদারীপুর, শরীয়তপুর ও দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করা হয়েছে। নুরুর রহমান জানান, আমরা ঘটনাস্থলে মাওয়াঘাট, কাঁঠালবাড়িঘাট ও কাওরাকান্দিতে ঘাটে কথা বলেছি। তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য-উপাত্ত নিয়ে আলোচনা করা হবে। এরপর কমিটি একটি রিপোর্ট দেবে। সমুদ্র অধিদফতরের ম্যাজিস্ট্রেট সাইফুল হাসান বলেন, কী ধরনের তথ্য পাওয়া গেছে তদন্তের স্বার্থে এ মুহূর্তে তা বলা যাবে না। তবে তদন্ত কাজের অনেকটা অগ্রগতি হয়েছে বলে তিনি জানান। এ দিকে মাওয়া ও কাওরাকান্দি ঘাটে সাী দিতে আসা স্বজনেরা কান্নায় ভেঙে পড়েন। তারা বলেন, এখনো আমাদের স্বজনেরা নিখোঁজ রয়েছেন। তাদের লাশ পাওয়া যায়নি। অথচ সরকার লঞ্চ উদ্ধার কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়ে এখন সাক্ষ্য গ্রহণ করছে। কী হবে এই সাক্ষ্য গ্রহণ করে। গাজীপুরের কাপাসিয়া উত্তরখামের গ্রাম থেকে এসেছেন বিউটি আক্তার। তিনি জানান, তার ১৪ বছরের মেয়ে মিম ডেমরার একটি স্কুলে অষ্টম শ্রেণীতে পড়ত। লঞ্চডুবির চার দিন পর ভোলা থেকে মিমের লাশ উদ্ধার করা হয়। এরপর আর কিছু বলতে পারেননি। স্বামী মৃত মো: ইউসুফ। মাদারীপুরে বেড়াতে গিয়ে আসার পথে লঞ্চ দুর্ঘটনায় মেয়ে ইয়াসমীন, মেয়ের জামাই মকবুল হোসেন, দুই নাতি রিফাত ও কুলসীমা পদ্মায় নিখোঁজ হয়। তাদের একজনের লাশও পাওয়া যায়নি। তিনি বলেন, অন্যরা দুই-একজনকে পেয়েছেন। আমার এমনই ভাগ্য আমি কারো লাশ পেলাম না। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি জানান, লঞ্চই পেলো না। তাহলে লাশ কই পামু। আর এই সাক্ষ্য দিয়েই বা কী হবে। তিনি বলেন, সহায়তার টাকা লাগবে না। আমার সন্তানদের লাশ চাই। মাদারীপুরের শিবচর থানার দক্ষিণ ক্রোকচর গ্রামের মোশারফ হোসেনের ছেলে বেঁচে যাওয়া যাত্রী তিতুমীর কলেজের ছাত্র সুজন মাহমুদ জানান, লঞ্চে আমরা পাঁচজন ছিলাম। আমি ও খালা হাসি বেগম (৩০) উঠে আসতে পারলেও ইপা আক্তার (১৩), মিরাজ (৯) ও ইব্রাহিম (১৭ মাস) নদীতে হারিয়ে যায়। ইপা ও ইব্রাহিমের লাশ পেলেও মিরাজের সন্ধান এখনো মিলেনি। আনিছুর রহমান বলেন, অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাইয়ের কারণে প্রচণ্ড ঢেউয়ে লঞ্চে কিছুটা পানি উঠে পড়ে। এ সময় যাত্রীরা তাড়াহুড়ো শুরু করলে লঞ্চ দুর্ঘটনায় পড়ে। বেঁচে যাওয়া যাত্রী ও প্রত্যক্ষদর্শীরা মনে করেন আর অতিরিক্ত যাত্রীর বহন ও লঞ্চের মাস্টারদের অসতর্কতার কারণে প্রচণ্ড ঢেউয়ের তোড়ে লঞ্চটি পদ্মায় ডুবে যায়। অন্য দিকে সর্বশেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত বৈরী আবহাওয়ার কারণে স্থানীয় টোটকা পদ্ধতির উদ্ধার অভিযানও স্থগিত রয়েছে। মেঘনা চেইনকোপ্পা অ্যান্ড সাইকেল মার্টের স্বত্বাধিকারী হাসান ও ডুবুরি কামাল জানান, স্রোতের কারণে আপাতত উদ্ধারকাজ স্থগিত রাখা হয়েছে। তবে তারা যেখানে বস্তুর সন্ধান পেয়েছিলেন সেখানে একটি বয়া বেঁধে রাখা হয়েছে। এ দিকে মঙ্গলবার সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, বিআইডব্লিউটিএ’র উদ্ধারকারী জাহাজের মধ্যে রুস্তম ও হামজাসহ তিন-চারটি উদ্ধারকারী জাহাজ দুর্ঘটনাস্থলের চার-পাঁচ কিলোমিটার দূরে অবস্থান করছে। তবে তারা কোনো কাজ করছে না। বাকি সব জাহাজ মাওয়াঘাট ত্যাগ করে চলে গেছে। জেলা প্রশাসনের কন্ট্রোল রুমের কার্যক্রম গুটিয়ে নেয়া হয়েছে। মাদারীপুরের শিবচর সংবাদদাতা ডি এম হাবিবুর রহমান জানান, সোমবার সন্ধ্যায় মাদারীপুরের পৌর কবরস্থানে আরো একটি বেওয়ারিশ লাশ দাফন করা হয়েছে। এ নিয়ে এখানে বেওয়ারিশ ১৮টি লাশ দাফন করা হয়েছে। এ ছাড়া তদন্ত কমিটি কাওরাকান্দি ও কাঁঠালবাড়ী ঘাট এলাকায় বেশ কিছু স্থানীয় ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সাথে কথা বলে সাক্ষ্য গ্রহণ করেছে। গত ৪ আগস্ট মাওয়ার অদূরে পদ্মা নদীতে আড়াই শতাধিক যাত্রী নিয়ে এমএল পিনাক-৬ লঞ্চ ডুবে যায়। ওই ঘটনায় ৪৫ জনের লাশ উদ্ধার করা গেলেও এখনো ৬১ জন নিখোঁজ রয়েছেন।

No comments:

Post a Comment