অভ্যন্তরীণ নৌচলাচল অধ্যাদেশ অনুযায়ী গঠিত হয়নি নৌ-আদালত। আইনবহির্ভূতভাবে চলছে বিভিন্ন মামলার বিচার কাজ। ১০ বছর আগে এই আদালতে নিষ্পত্তি হওয়া মামলাগুলোর রায় বাতিল করে দিয়েছিলেন আপিল আদালত। পাশাপাশি আইন মেনে নতুন করে নৌ-আদালত গঠন এবং নিষ্পত্তি হওয়া মামলাগুলোর বিচার কাজ পুনরায় শুরুরও নির্দেশ দিয়েছিলেন আপিল আদালত। কিন্তু অদ্যাবধি বাস্তবায়ন হয়নি আদালতের এই নির্দেশ। এ অবস্থায় বিভিন্ন নৌ সংক্রান্ত মামলায় আ
সামিদের শাস্তি হলেও আদালতের বৈধতা প্রশ্নে আপিল আদালত থেকে খুব সহজেই খালাস পাচ্ছেন তারা। বিধান অনুযায়ী নৌ-আদালত গঠন করা না হলে ভবিষ্যতে এই আদালতের সব রায়ই অবৈধ হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন আইন বিশেষজ্ঞরা। নৌ-আদালত ও আপিল আদালতে নিষ্পত্তি হওয়া বিভিন্ন মামলার নথিপত্র ঘেঁটে এবং বিচার সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে পাওয়া গেছে উল্লিখিত সব তথ্য। অভ্যন্তরীণ নৌচলাচল অধ্যাদেশ ১৯৭৬ (সংশোধিত) ২০০৫-এর ৪৭-এর ৩ ধারায় বলা হয়েছে, ‘নৌ-আদালতে ন্যূনতম দুজন এবং অনধিক চারজন ন্যায়নির্ধারক উপদেষ্টা (এসেসর) উপস্থিত থাকবেন, যাদের মধ্যে একজন নৌ-বিষয়াদির ওপর ওয়াকিবহাল থাকিবেন এবং অপরদের অভ্যন্তরীণ জাহাজ পরিচালনা অথবা বাণিজ্য অথবা ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়াদির ওপর অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।’ নৌ চলাচল অধ্যাদেশের ৪৭-এর ৪ ধারায় বলা হয়েছে, ‘নৌ-আদালতের প্রত্যেক ন্যায়নির্ধারক উপদেষ্টা আদালতের সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট পর্যাপ্ত কারণে অনুমতি সাপেক্ষে অনুপস্থিত থাকা ছাড়া তিনি প্রতিটি প্রসিডিংয়ে আদালতে উপস্থিত থেকে তার মতামত লিখিতভাবে প্রদান করিবেন যা প্রসিডিংয়ে রেকর্ড থাকবে।’ বিচার সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, গত দশ বছরে আলোচিত নৌদুর্ঘটনার ৫৪টি মামলার রায় দিয়েছে নৌ-আদালত। পাশাপাশি নৌচলাচল অধ্যাদেশপরিপন্থী অপরাধের (নৌযানের সার্ভে রেজিস্ট্রেশন না থাকা, সনদধারী চালক না থাকা, জীবন রক্ষাকারী সরঞ্জাম না থাকা ইত্যাদি) অভিযোগে দায়ের করা আড়াই হাজার মামলার রায় দিয়েছেন এই আদালত। কিন্তু নিষ্পত্তি হওয়া এসব মামলার বিচার কাজ পরিচালনার সময় নিয়োগ দেয়া হয়নি একজনও এসেসর। এমনকি প্রতিটি প্রসিডিংয়ে আদালতে উপস্থিত থাকেননি তারা কেউ। এছাড়া প্রসিডিংয়ে রেকর্ড করা হয়নি এসেসরদের লিখিত মতামতও। জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক শনিবার টেলিফোনে যুগান্তরকে বলেন, ‘ন্যায়নির্ধারক উপদেষ্টার উপস্থিতি ও মতামত ছাড়াই নৌ-আদালতে মামলা নিষ্পত্তি করা হয়েছে তা আমার জানা ছিল না। তবে শিগগিরই নৌ-আদালতে কমপক্ষে দুজন ন্যায়নির্ধারক উপদেষ্টা নিয়োগ দেয়ার ব্যবস্থা করা হবে।’ অনুসন্ধানে জানা গেছে, নৌ-আদালতের দেয়া বিভিন্ন মামলার দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতে আপিল করেন আসামিপক্ষ। আপিল আবেদনগুলোতে উল্লেখ করা হয়েছে, অভ্যন্তরীণ নৌচলাচল অধ্যাদেশ অনুযায়ী নৌ-আদালত গঠন না করেই মামলার রায় দেয়া হয়েছে, যা আইনের পরিপন্থী। আদালতের রায় বাতিল করে সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের খালাস দেয়া হোক। নৌ-আদালতের বিচারাধীন শতাধিক মামলার আসামির আইনজীবী মোঃ জাহাঙ্গীর হোসেন যুগান্তরকে বলেন, ‘আসামিদের হয়ে বারো বছর যাবৎ নৌ-আদালতে মামলা পরিচালনা করছি। এই সময়ের মধ্যে এই আদালতে কোনো ন্যায়নির্ধারক উপদেষ্টা নিয়োগ দেয়া হয়নি। ন্যায়নির্ধারক উপদেষ্টা ছাড়াই মামলার বিচার কাজ পরিচালনা করছে নৌ-আদালত। নৌচলাচল অধ্যাদেশ অনুযায়ী নৌ-আদালত গঠন করা হয়নি। যে কারণে এই আদালতের আদেশ কোনোভাবেই বৈধ হতে পারে না।’ সুপ্রিমকোর্টের এই আইনজীবী আরও বলেন, ‘আইন অনুযায়ী নৌ-আদালত গঠন না করার কারণ দেখিয়ে আপিল আদালত থেকে অনেক মামলার আসামিকে খালাস করিয়েছি। এখনও করছি।’ অপরদিকে নৌ-আদালতের প্রসিকিউটিং অফিসার পারভীন সুলতানা যুগান্তরকে বলেন, ‘এটা সত্যি কথা যে, গত দশ-বারো বছরে নৌ-আদালতে কোনো ন্যায়নির্ধারক উপদেষ্টাকে নিয়োগ দেয়া হয়নি। তাদের উপস্থিতি ও মতামত ছাড়া নৌ-আদালতের দেয়া রায় বাতিল করে আপিল আদালত পুনরায় মামলার বিচার করার নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু কোনো সরকার আদালতের ওই আদেশ বাস্তবায়ন করেননি। যে কারণে তাদের ছাড়াই মামলার বিচার কাজ অনুষ্ঠিত হচ্ছে।’ সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, নৌ-আদালতের বর্তমান বিচারক মোহাম্মদ কামাল হোসেন শিকদার ন্যায়নির্ধারক উপদেষ্টা নিয়োগ দেয়ার জন্য ১৩ আগস্ট সমুদ্র পরিবহন অধিদফতরের মহাপরিচালককে চিঠি দিয়েছেন। কিন্তু তা এখনও বাস্তবায়ন করা হয়নি। মামলার নথিপত্র ঘেঁটে জানা গেছে, মেরিন কোর্টের মামলা নম্বর এমএসি ৩৮৬/২০০৮। এ মামলার আসামি হলেন আশরাফ আলী খোকন। মামলায় বলা হয়, আসামি খোকন ৪০ অর্শ্বশক্তির অধিক ইঞ্জিন ক্ষমতাসম্পন্ন স্পিডবোট পরিচালনা করেন। ওই স্পিডবোটের কোনো সার্ভে রেজিস্ট্রেশন নেই। জীবনরক্ষাকারী ও অগ্নিনির্বাপক কোনো যন্ত্রপাতি নেই। নৌযানে যোগ্যতা সনদধারী কোনো চালক নেই, যা দণ্ডনীয় অপরাধ। এ মামলায় নৌ-আদালতের বিচারক নৌচলাচল অধ্যাদেশ ১৯৭৬-এর ৬১(ব), (এফ) ৬৬ (এ) ধারায় দোষী সাব্যস্ত করে বিশ হাজার টাকা জরিমানা ও সাড়ে পাঁচ মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেন। ২০১১ সালের ১১ মে নৌ-আদালতের তৎকালীন বিচারক মোঃ জাকির হোসেন এ আদেশ দেন। এ আদেশের বিরুদ্ধে ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতে আপিল করেন আসামি খোকন। আদালত মামলাটি বিচারের জন্য ঢাকার বিশেষ জজ-২ আদালতে পাঠান। এ আদালতের তৎকালীন বিচারক বিশেষ দায়রা জজ মোঃ মোজাম্মেল হক ২০ জানুয়ারি নৌ-আদালতের দেয়া দণ্ড বাতিল করে দেন। এই রায়ে বিচারক মোঃ মোজাম্মেল হক বলেন, ‘নৌ-আদালতের বিচারক বিচার কার্যক্রম পরিচালনা করার সময় নৌচলাচল অধ্যাদেশের ৪৭(৩) ধারা মতে ন্যায়নির্ধারক উপদেষ্টা (এসেসর) নিয়োগ করেন নাই এবং ৪৭(৪) ধারা মতে ন্যায়নির্ধারক উপদেষ্টাগণ প্রতিটি প্রসিডিংয়ে আদালতে উপস্থিত থাকেন নাই ও তাহাদের লিখিত মতামত প্রসেডিংতে রেকর্ড করেন নাই। দেখা যায়, নৌ-আদালতের বিচারক বিচারকার্য পরিচালনা করার সময় এসেসর নিয়োগ ও মতামত ব্যতীত তর্কিত রায় ও দণ্ডাদেশ দিয়েছেন যা আইনবহির্ভূত। নৌ-আদালতের দেয়া রায় ও দণ্ডাদেশ রহিত করা হইল। নৌচলাচল অধ্যাদেশ, ১৯৭৬-এর ৪৭ ধারা অনুযায়ী নৌ-আদালত গঠনপূর্বক মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তি করার নির্দেশ দেওয়া গেল।’ আরও জানা গেছে, এমএসি মামলা নম্বর ৪০৪/২০০৮। মামলার আসামি হলেন মোঃ তাজল বেপারি। এ মামলায় নৌ-আদালত ২০১০ সালের ১১ মে আসামি তাজুলকে চার মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড ও পনের হাজার টাকা জরিমানা করেন। নৌ-অধ্যাদেশ অনুযায়ী ন্যায়নির্ধারক উপদেষ্টাদের উপস্থিতি ও মতামত প্রসিডিং রেকর্ড না করার দায়ে নৌ-আদালতের দণ্ডাদেশ বাতিল করেন ঢাকার বিশেষ জজ-১ আদালতের বিচারক মোঃ মোজাম্মেল হক। উল্লিখিত দুটি মামলার মতো নৌ-আদালতের একাধিক মামলার রায় বাতিল করেছেন আপিল আদালত। পাশাপাশি নৌ-চলাচল অধ্যাদেশ অনুযায়ী নৌ-আদালত গঠনেরও নির্দেশ দিয়েছেন। জানতে চাইলে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ সোমবার টেলিফোনে যুগান্তরকে বলেন, ‘আমার জানা ছিল না যে, নৌচলাচল অধ্যাদেশ অনুযায়ী ন্যায়নির্ধারক উপদেষ্টা ছাড়াই নৌ-আদালতে বিচার কাজ অনুষ্ঠিত হয়েছে। আইন মেনে নৌ-আদালত গঠন না করার কারণেই তো নৌ-আদালতের রায় বাতিল করেছেন আপিল আদালত। অবশ্যই বলা যায়, আইন না মেনে বিচার যদি হয় তাহলে সেই বিচারকে সঠিক বলা যাবে না। নৌ-আদালতের রায় বাতিল করে দেয়া আপিল আদালতের রায়ের আলোকে অবশ্যই বলা যায়, অভ্যন্তরীণ নৌচলাচল অধ্যাদেশ অনুযায়ী নৌ-আদালত গঠন না করে নৌ-আদালতের সব রায়ই আইনবহির্ভূত।’ সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি সিনিয়র আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন সোমবার টেলিফোনে যুগান্তরকে বলেন, নৌচলাচল অধ্যাদেশ ১৯৭৬-এর ৪৭ ধারা অনুযায়ী নৌ-আদালত গঠন না করে সরকার চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। এটা আইন মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতা। আইন অনুযায়ী নৌ-আদালত গঠন করার দায়িত্ব ছিল আইন মন্ত্রণালয়ের। আইন অনুযায়ী নৌ-আদালত গঠন না করার ফলে সরকারের সম্পদের অপচয় হচ্ছে। মানুষের ভোগান্তি বাড়ছে। মানুষ বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এটা একটা অমার্জনীয় অপরাধ হয়েছে। এর জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অবশ্যই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।
No comments:
Post a Comment