অর্থঋণ আদালতের মামলাজট কমাতে আইন সংশোধনীর সুপারিশ আসছে আইন কমিশন থেকে। খেলাপি ঋণ আদায়ে বিদ্যমান অর্থঋণ আদালত আইনকে যুগোপযোগী করতে কমিশন কাজ করছে। আগামী এক-দেড় মাসের মধ্যেই কমিশন তাদের সুপারিশ আইন মন্ত্রণালয় বরাবর পেশ করবে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আইন কমিশনের সদস্য অধ্যাপক ড. শাহ আলম নয়া দিগন্তকে বলেন, অর্থঋণ আদালত আইনে জমে থাকা মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করতে বিদ্যমান আইনকে যুগোপযুগী করার কাজ চলছে। কাজট
ি সম্পন্ন হলেই প্রতিবেদন আকারে কমিশনের সুপারিশ সরকারের কাছে পেশ করা হবে। এ দিকে অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, অর্থঋণ আদালতে এ পর্যন্ত বিচারাধীন রয়েছে প্রায় ৩০ হাজার মামলা। প্রতি মাসে গড়ে ১০০ থেকে ১৫০ মামলা দায়ের হচ্ছে। পুরো ব্যাংকিং সেক্টরে প্রায় এক লাখ মামলা বিচারাধীন রয়েছে। দুই বছর আগে সংশ্লিষ্ট এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী অর্থাৎ ২০১১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত অর্থঋণ আদালতে সবচেয়ে বেশি মামলা দায়ের করেছে রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংক। অগ্রণী ব্যাংকের মোট মামলা ৮,১৯৬টি। মামলায় অগ্রণী ব্যাংকের দাবিকৃত অর্থ ২,৬৬০ কোটি টাকা। সোনালী ব্যাংকের ৭৩৮৪টি, জনতা ব্যাংকের ৭ হাজার এবং রূপালী ব্যাংকের ৫,৭০৩টি মামলা রয়েছে। আদালতে যেসব মামলা বিচারাধীন কিংবা স্থগিত রয়েছে তাতে জনতা, সোনালী, রূপালী ও অগ্রণী ব্যাংকের দাবি মোট ৯,৯৯৭ কোটি টাকা। ঋণ খেলাপিদের মধ্যে অন্তত দেড় ডজন ব্যক্তি রয়েছেন যাদের প্রত্যেকের ঋণ ১০০ কোটি টাকারও বেশি। বৃহৎ ঋণ খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত এসব খেলাপি উচ্চ আদালতে রিট করে ১ হাজার ৩৪৩ কোটি টাকা আদায় কার্যক্রম আটকে দিয়েছেন। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, অর্থঋণ আদালতের রায়ের ৯০ ভাগ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পে এলেও উচ্চ আদালতে ঋণ খেলাপিদের রিট ও আপিলের পরিপ্রেেিত অর্থ আদায় সম্ভব হচ্ছে না। একটি মামলা থেকে সৃষ্টি হচ্ছে একাধিক মামলা। এতে বছরের পর বছর ঝুলে থাকছে মূল মামলা। সরকারের নতুন আইন প্রণয়নের পরও অনাদায়ী থেকে গেছে চারটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের কয়েক হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া উচ্চ আদালতে অর্থঋণ মামলার শুনানির জন্য পর্যাপ্ত বেঞ্চ না থাকায় বাড়ছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান সংক্রান্ত মামলার জট। আইন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য সরকার ২০০৩ সালে একটি আইন করে। একই বছর ১ মে আইনটি কার্যকর হয়। এ আইনে ব্যাংক কর্তৃপ মামলা দায়েরের তিন মাসের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি এবং উপযুক্ত কারণ দর্শিয়ে আরো এক মাস মামলা কার্যক্রম বিলম্ব করার বিধান রাখা হয়েছে। অর্থঋণ আদালত আইনের ১২ ধারায় মামলা দায়েরের প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে বলা হয়েছে, ব্যাংক কর্তৃপ প্রথম ঋণ খেলাপি সাব্যস্ত করে বিবাদির বিরুদ্ধে পত্রিকায় বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে লিগ্যাল নোটিশ দেবে। বিবাদি এতে সাড়া না দিলে সংশ্লিষ্ট ঋণগ্রহীতার সম্পত্তি নিলামে বিক্রির জন্য বিজ্ঞাপন দেবে। বিবাদি এতেও সাড়া না দিলে ব্যাংক কর্তৃপ অর্থঋণ আদালতে মামলা করবে। মামলা দায়েরের এক মাসের মধ্যে বিবাদি আদালতে হাজির না হলে আদালত বন্ধকী সম্পত্তি বিক্রির সমন জারি করবে। কিন্তু ব্যাংক ও আদালতের এসব প্রক্রিয়ার প্রথম ধাপেই গৃহীত পদেেপর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে তা স্থগিতের আবেদন জানিয়ে হাইকোর্টে রিট দায়ের হয়। এতে ব্যাংক ও আদালতের পদেেপর ওপর উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ ও রুল জারি হয়। হাইকোর্টের বেঞ্চ স্বল্পতার কারণে রুলের শুনানি কার্যতালিকায় ওঠে না। পুরো কার্যক্রম ঝুলে থাকে অনির্দিষ্টকালের জন্য। আর একচেটিয়া এ সুযোগটি কাজে লাগান ঋণ খেলাপিরা। উচ্চ আদালতের আইনজীবীরা মনে করেন, অর্থঋণ আদালত আইনটি স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। বিচারিক আদালত রায় দিয়ে দিলেও আইনের দুর্বলতা ধরা পড়ে উচ্চ আদালতে। আইনগত দুর্বলতার কারণেই এ আইনের আওতায় খেলাপিদের কাছ থেকে অর্থ উদ্ধার বিলম্বিত হচ্ছে। তারা মনে করেন, অর্থঋণ আইনের বেশ কিছু দুর্বলতার সুযোগে ঋণ খেলাপিরা উচ্চ আদালতে চাতুর্যপূর্ণভাবে রিট দায়ের করে থাকেন। এ ছাড়া ব্যাংকগুলোতে নিয়োজিত প্যানেলভুক্ত অনভিজ্ঞ আইনজীবীর তুলনায় ঋণ খেলাপিদের আইনজীবী অনেক দ ও অভিজ্ঞ। যার কারণে উচ্চ আদালতে রিটের শুনানিতে ব্যাংক প যুক্তি-তর্কে হেরে যায়। দলীয় আনুগত্য ও তদবিরের মাধ্যমে নিয়োগের অভিযোগ রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর লিগ্যাল অ্যাডভাইজারদের বিরুদ্ধে। সরকারি দলের প্রতি আনুগত্যের কারণে তাদের যোগ্যতা নিয়ে কখনো প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় না। যার ফলে অর্থঋণ আদালতে মামলাজট বাড়ছেই।
No comments:
Post a Comment