ফের সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছে জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি)। চলছে নতুন সদস্য সংগ্রহের কাজ। সেই সঙ্গে পুরনো সদস্যদের সংগঠিত করে সক্রিয় করা হচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে বান্দরবানের থানচির দুর্গম পাহাড়ে ১০ একর জমির ওপর প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও ক্যাম্প গড়ে তুলেছেন জেএমবির অন্যতম সংগঠক শামীন মাহফুজ ওরফে সুমন ওরফে ম্যানরিং মং (ছদ্মনাম)। কৃষি খামারের আড়ালে গড়ে তোলা ওই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে বোমা তৈরি ও গুপ্ত হামল
ার প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। সম্প্রতি গাইবান্ধা জেলার অন্তত ৩০ যুবককে সেখানে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও ক্যাম্প চালাতে দেশের চার বড় ব্যবসায়ী অর্থায়ন করছেন। গ্রেফতার হওয়া জেএমবির অন্যতম সংগঠক শামীন মাহফুজসহ তিন সদস্য রিমান্ডে জেএমবির পুনরুত্থান সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর এসব তথ্য দিয়েছেন বলে ডিবি পুলিশ জানিয়েছে। ডিবির উপ-পুলিশ কমিশনার কৃষ্ণপদ রায় যুগান্তরকে বলেন, ‘জেএমবির পুনরুত্থানের চেষ্টার ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট তথ্য পেয়েছি। তাদের পরিকল্পনা ও নেটওয়ার্ক সম্পর্কে জানার চেষ্টা করছি। বিভিন্ন ব্যক্তি ও এনজিও তাদের অর্থ জোগান দিচ্ছে। অর্থদাতাদের নজরদারিতে রাখা হয়েছে। জেএমবির অন্য সদস্যদের ধরতে গোয়েন্দা পুলিশ কাজ করছে।’ ডিবির রিমান্ডে : বুধবার রাতে সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল এলাকা থেকে ডিবির সহকারী পুলিশ কমিশনার মাহমুদা আফরোজ লাকীর নেতৃত্বে দুটি টিম অভিযান চালিয়ে জেএমবির অন্যতম সংগঠক শামীন মাহফুজসহ সদস্য জাহিদুর রহমান ও ইসমাইল হোসেনকে গ্রেফতার করে। তাদের কাছ থেকে বোমা, বোমা তৈরির সরঞ্জাম এবং একটি ল্যাপটপ উদ্ধার করা হয়। ওই ল্যাপটপে জেএমবির পুনরুত্থান সম্পর্কে ও বোমা হামলা চালানো বিষয়ে নানা তথ্য ছিল। এই তিনজন আগে ‘জামাতুল মুসলিমীন’ নামক জঙ্গি সংগঠনের সদস্য ছিলেন। ওই সংগঠনের সব কার্যক্রম বন্ধ হওয়ায় তারা জেএমবিতে যোগ দেন। বৃহস্পতিবার ওই তিনজনকে দুটি মামলায় তিন দিন করে মোট ছয় দিনের রিমান্ড নেয় ডিবি। সম্প্রতি ময়মনসিংহের ত্রিশালে পুলিশের প্রিজন ভ্যান থেকে আসামি ছিনতাইয়ের সঙ্গে তারা জড়িত আছে কি-না সে বিষয়েও জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। জানান দিতেই আসা : আইনশৃংখলা বাহিনীর তৎপরতায় দীর্ঘদিন ধরে জেএমবির কার্যক্রম অনেকটা বন্ধ ছিল। শীর্ষ নেতাদের অনেকেই গ্রেফতার হয়ে কারাগারে, কেউ কেউ বিদেশে পালিয়ে যায়। গ্রেফতার এড়িয়ে দেশে থাকা জেএমবির সদস্যরা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে। তারা বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। তাদের চাঙ্গা করতে ও জেএমবি সম্পর্কে দেশবাসীকে জানান দিতে রাজধানী ঢাকায় সিরিজ বোমা হামলার পরিকল্পনা করেন শামীন মাহফুজ। সেই পরিকল্পনানুযায়ী ঈদকে কেন্দ্র করে ঢাকায় আসেন শামীন মাহফুজ, জাহিদুর রহমান ও ইসমাইল হোসেন। ঈদের পরে ঢাকা ফাঁকা থাকবে- এই সুযোগে তারা বিভিন্ন স্থানে বোমা হামলা চালাবে, এমনটিই পরিকল্পনা ছিল। তবে তার আগেই ডিবির হাতে গ্রেফতার হয়ে যান তারা। রিমান্ডে তদন্ত কর্মকর্তাদের কাছে এ তথ্য জানিয়েছেন শামীন মাহফুজ। তবে মানুষ মারার পরিকল্পনা ছিল না। তদন্ত কর্মকর্তাদের কাছে শামীন আরও জানিয়েছেন, জেএমবি সংগঠনটি যে সংগঠিত ও কার্যক্রম আছে তা জানান দিতেই সিরিজ বোমা হামলা চালানোই ছিল তার মূল পরিকল্পনা। কৃষি খামারের আড়ালে : জিজ্ঞাসাবাদে তদন্ত কর্মকর্তাদের শামীন মাহফুজ জানিয়েছেন, বান্দরবানের থানচির পাহাড়ী এলাকা বলিপাড়া, বনাইপাড়া, কমলাবাগান ও চাকমাপাড়ায় কৃষি খামারের নামে তিনি ৪৫ একর জমি লিজ নিয়েছেন। এর মধ্যে ৩৫ একর জমিতে ছাগল খামারসহ চাষাবাদ করেন। বাকি ১০ একর জমির ওপর প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও ক্যাম্প করা হয়েছে। ২০১১ সালের শেষ দিকে এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও ক্যাম্প করা হয়। শামীন মাহফুজ আগে ‘জামাতুল মুসলিমীন’ নামে একটি জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ২০১১ সালের প্রথম দিকে তিনি জেএমবিতে যুক্ত হন। গাইবান্ধা জেলার অন্তত ৩০ যুবককে ওই প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। এই ৩০ জন দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। তাদের বয়স ২০ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। ম্যানরিং মং ছদ্মনামে শামীন জেএমবির সদস্য সংগ্রহ করতেন। পিএইডি ডিগ্রি : শামীন মাহফুজ উপ-জাতি পাহাড়ি খুমিদের সম্প্রদায়ের ওপর পিএইচডি করার নামে বান্দরবানের থানচিতে যান। পিএইচডির জন্য তিনি ২০১০ সালের ড. ফারজানা ইসলামের তত্ত্বাবধানে গষেষনা শুরু করেন। ফারজানা ইসলাম জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর বলে জানতে পেরেছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। আল কায়েদার সান্নিধ্য পাওয়ার চেষ্টা : জেএমবি ও আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের শীর্ষ নেতাদের অনেকেই পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশে পালিয়ে রয়েছে। এর মধ্যে এজাজ আহমেদ, আনোয়ার হোসেন ওরফে ফারুক, ইমরানুল হক ও জাহিদুর রয়েছেন পাকিস্তানে। পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত বাংলাদেশী বিভিন্ন পলাতক জঙ্গিদের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রেখে তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কাজ করছিলেন শামীনসহ গ্রেফতারকৃত তিনজন। জেএমবির হয়ে আল কায়েদার সঙ্গে সমন্বয় করছেন পাকিস্তানে পলাতক ইমরানুল হক। ইমরানুলের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ শামীনের। বৃহস্পতিবার ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে ডিবির যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেছেন, আল কায়েদার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার জন্য জেএমবি আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া বাংলাদেশের কয়েকটি জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, এনজিও আদলে জঙ্গি সংগঠন আরসিইউডি আল কায়দার সমর্থন পাওয়ার চেষ্টা করে আসছে। এই তিনজনকে গ্রেফতার অভিযানে নেতৃত্বদানকারী ডিবির সহকারী পুলিশ কমিশনার মাহমুদা আফরোজ লাকী বলেন, দেশে যে কোনো ধরনের জঙ্গি তৎপরতা সমূলে উৎখাত করা হবে। এ জন্য গোয়েন্দা পুলিশ প্রয়োজনীয় সব ধরনের ব্যবস্থা নেবে।
No comments:
Post a Comment