Wednesday, August 27, 2014

রংপুরে হাত বাড়ালেই মাদক:প্রথম অালো

কার কথা বাদ দিয়ে কার কথা বলব। এদের মধ্যে ১৩ বছর বয়সী ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র থেকে ৬০ বছরের বৃদ্ধ শিক্ষক, মাঝবয়সী সরকারি কর্মচারী থেকে উঠতি বয়সের যুবক, তরুণ ব্যবসায়ী থেকে চিকিৎসক—সবাই আছেন। বড়ই মর্মস্পর্শী আর বিস্ময়কর তঁাদের জীবনকাহিনি। মাদকের নিষ্ঠুর পদাঘাতে কেউ লাখ লাখ টাকার ব্যবসা ধ্বংস করে সর্বস্বান্ত; কেউবা জড়িয়েছেন ভয়ংকর অপরাধ চক্রে। পরিবার তছনছ হয়ে গেছে কারও কারও। মাদকই এখন রংপুর নগরের অন্যতম প
্রধান সমস্যা। পাওয়া যাচ্ছে হাত বাড়ালেই। নগরের খামারপাড়া, কলেজপাড়া, আলমনগর, মডার্ন মোড়, পার্ক মোড়, সাতমাথা, আশরতপুর, পুরাতন ট্রাকস্ট্যান্ড, চকবাজার, জলকর, হুনুমানতলা, রেলস্টেশন, হাজীরহাট, মেডিকেল কলেজ মোড়, দর্শনা মোড় এবং শহরের অদূরে বুড়িরহাট ও গঙ্গাচড়া এলাকাগুলো মাদক কেনাবেচার প্রধান কেন্দ্র। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, মাদকের ব্যবসা হচ্ছে তিনটি ধাপে। একটি দল সীমান্ত পাড়ি দিয়ে মাদক নিয়ে আসে। তারা পৌঁছে দেয় রংপুরের এজেন্টদের কাছে। এজেন্টরা বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে খুচরা বিক্রেতাদের দিয়ে এসব মাদক বিক্রি করায়। দরিদ্র পরিবারের নারী ও শিশুদের মাদক বিক্রি, পরিবহন ও খুচরা বিক্রির কাজে ব্যবহার করছে নেপথ্যের হোতারা। তারা থেকে যাচ্ছে আইনের নাগালের বাইরে। মাদকের ব্যবহার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে মাদকাসক্তি নিরাময়কেন্দ্রের সংখ্যা, বাড়ছে অপরাধ। আর বাড়ছে দায়দায়িত্ব নিয়ে পুলিশ ও মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মধ্যে পরস্পরের প্রতি চাপান-উতোর। কয়েকটি ঘটনা: ‘ছিনতাই বলেন, চুরি-ডাকাতি, হাইজ্যাক বলেন, কিছুই বাদ নাই’—কথাগুলো বলছিলেন বছর তিরিশেক বয়সের এক যুবক। নেশা করছেন নয় বছর ধরে। চাকরি করতেন। নেশার কারণে সেটা গেছে। প্রতিদিন নেশার জন্য লাগত প্রায় তিন হাজার টাকা। ঘরের জিিনসপত্র চুরি করে বিক্রি করার পর শুরু করেন চুরি-ছিনতাই। ঘরে স্ত্রী, দুটি ছেলেমেয়ে। অবশেষে বাবা-মা-স্ত্রী সবাই মিলে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ভর্তি করিয়েছেন নগরের এক নিরাময়কেন্দ্রে, চিকিৎসা চলছে। বয়স ষাট ছঁুই ছঁুই। পেশায় স্কুলশিক্ষক। আর অল্প কিছুদিন আছে অবসর গ্রহণের। সেরা শিক্ষকের সম্মাননাও পেয়েছেন একবার। গোপনে গোপনে বহুদিন থেকে জড়িয়ে আছেন নেশায়। রাতে ঘরে ফেরেন না। স্ত্রী-সন্তানেরা কেউ টঁু শব্দ করে না। কারণ, সবাই তাঁকে ‘বাঘের মতো’ ভয় পায়। জমি-জিরাত সব শেষ করে ‘বিবেকের দংশনে’ স্বেচ্ছায় মাদক নিরাময়কেন্দ্রে ভর্তি হয়েছেন। শিক্ষকের মতোই ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়া মাত্র ১৩ বছরের এক পঁুচকে নেশায় জড়িয়ে বড়িতে সৃষ্টি করেছে ঘোর অশান্তি। টাকা দেওয়া বন্ধ হওয়ায় জড়িয়েছে ছিনতাইয়ে। তাকে ভর্তি করিয়ে দিয়ে গেছে তার পরিবার। এক যুবক ধ্বংস করেছেন ৮০ লাখ টাকার ব্যবসা। শহরে নিজের ক্লিনিক আছে এমন এক চিকিৎসক গোপনে চিকিৎসা নিচ্ছেন এখানে। আছেন এক সরকারি কর্মচারী, যাঁকে তাঁর সন্তানেরা ভর্তি করিয়ে দিয়েছে এখানে। তরুণদের সংখ্যা ৭০ শতাংশ: নগরের একটি মাদক নিরাময়কেন্দ্রের পরিচালক গুলশান আরা ইয়াসমিন জানালেন, তাঁদের এখানে যারা আসে, তাদের ৭০ শতাংশের বয়স ১৫ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। মাদকাসক্তদের মধ্যে প্রায় ৬০ শতাংশ ছাত্র, তরুণ ব্যবসায়ী বা বেকার যুবক। শিক্ষক আসেন প্রায় ১০ শতাংশ। তাঁরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে বেসরকারি উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজে শিক্ষকতা করেন। চাকরিজীবী আসেন প্রায় ১৫ শতাংশ। নিরাময়কেন্দ্র থেকে ফিরে গিয়ে কেউ কেউ আবার আসক্ত হয়ে পড়ে। তাদের বলা হয় ‘স্লিপ করা’। তরুণদের মধ্যেই স্লিপ করাদের সংখ্যা বেশি। চল্লিশোর্ধ্বদের মধ্যে এটা তেমন ঘটে না। রংপুর নগরে মাদকাসক্তি নিরাময়কেন্দ্র আছেই ১০টি। প্রতিটিতে কুড়িজনের মতো আসক্তকে আবাসিক হিসেবে তিন মাসের চিকিৎসা ও অন্যান্য সেবা দেওয়া হয়। পরে তাদের পর্যবেক্ষণে রাখা হয় দুই বছর পর্যন্ত। প্রতি মাসে নতুন করে ১৫০ জন থেকে ২০০ জন মাদকাসক্ত এসব নিরাময়কেন্দ্রে ভর্তি হয়। এ থেকে বোঝা যায় মাদকাসক্তির ভয়াবহ বিস্তার। নগরে মুন, ডিসকো, হাওয়াসহ কয়েকজন চিহ্নিত নারী মাদক ব্যবসায়ী আছেন। এ ছাড়া মাদকসম্রাট হিসেবে চিহ্নিত সুলতান। তাঁদের একাধিকবার গ্রেপ্তার করা হয়েছে। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, জামিনে বেরিয়ে এসে তাঁরা আবার আগের ব্যবসায় ফিরেছেন। এখন তাঁরা নতুন কৌশল অবলম্বন করেছেন। শহরের ছিন্নমূল বা দরিদ্র পরিবারের শিশু ও স্বামী পরিত্যক্ত নারীদের দিয়ে মাদক বহন ও বিক্রি করাচ্ছেন। তাঁরা ছাড়া আরও অনেক বড় ব্যবসায়ী রয়েছেন, যাঁরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছেন বলে নগরবাসীর অভিযোগ। সীমান্ত দিয়ে আসছে: রংপুর নগরের মাদকের বড় চালান আসছে লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রাম সীমান্ত দিয়ে। এ দুটি জেলার দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে ভারতের সঙ্গে। আগে নীলফামারী দিয়ে বড় বড় জারিকেনে করে ফেনসিডিল এনে এপারে বোতলজাত করা হতো। তা এখন বন্ধ। লালমনিরহাট-কুড়িগ্রাম সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া সব স্থানে নেই। এ দুই জেলার সীমান্তে নদী থাকায় চোরাকারবারিরা নৌপথকেই মাদক পাচারের প্রধান পথ হিসেবে ব্যবহার করছে। অনেক সময় মাদকদ্রব্য পলিথিনের বড় বড় গাঁট বেঁধে ওপার থেকে নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। এপারের ব্যবসায়ীরা সেই গাঁটগুলো তুলে নেন। এ দুই জেলার সীমান্তবর্তী স্থানে বসতবাড়ির ছদ্মাবরণে ওপার থেকে আসা মাদকের মজুত গড়ে তোলা হয়েছে। সেখান থেকে বিভিন্ন জায়গায় মাদকগুলো পাঠানো হয়। সীমান্ত পারাপার ও পাশের জেলায় পরিবহনের কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে দরিদ্র পরিবারের নারী ও শিশুদের। পুলিশি অভিযানে মূলত এসব নারী ও শিশুই বেশি আটক হয়। পরে তারা জামিনে বের হয়ে আসে। পুলিশ সুপার আবদুর রাজ্জাক বলছেন, রংপুরের আশপাশে ছয়টি জেলার সঙ্গে পার্শ্ববর্তী দেশের সীমান্ত। মাদক ঢুকছে সীমান্ত দিয়ে। নিয়ন্ত্রণ করতে হলে সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ বন্ধ ও অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণের প্রধান ভূমিকা রাখতে হবে সংশি­ষ্ট অধিদপ্তরটির। চলতি বছরের গত সাত মাসে পুলিশ মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ৩৩৩ জনকে আটক করেছে, মামলা হয়েছে ২৭৪টি। এ সময় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর গ্রেপ্তার করেছে ২২ জনকে, মামলা হয়েছে ৫২টি। পুরোনো অভিযোগ: জেলার মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপপরিচালক দিলারা রহমান বললেন, তাঁদের কোনো অস্ত্রধারী লোকবল নেই। পুলিশের সাহায্য ছাড়া তাঁদের পক্ষে অভিযান পরিচালনা বা গ্রেপ্তার করা প্রায় অসম্ভব। এ ছাড়া রয়েছে লোকবলের স্বল্পতা। সমস্যা হলো, মাদকসংক্রান্ত প্রচলিত আইনটি ১৯৯০ সালের। এ আইনের বেশ দুর্বলতা রয়েছে। এ কারণে গ্রেপ্তারকৃতরা সহজেই জামিন পেয়ে যায়। বিশেষ করে নারী ও শিশুরা। এই সুযোগ নিয়ে রংপুরে মাদক ব্যবসায়ীরা দরিদ্র পরিবারের নারী ও শিশুদের ব্যবহার করছেন। এ জন্য বিদ্যমান আইন সংশোধন করে যুগোপযোগী করা দরকার। অধিদপ্তর থেকে এ ব্যাপারে সংশি­ষ্ট মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করা হয়েছে। রংপুর সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র গোলাম কবির বললেন, ‘আমরা অনেক সময় মাদক ব্যবসায়ী বা ছিনতাইকারীদের আটক করে পুলিশে সোপর্দ করি, কিন্তু পরে দেখা যায় তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া এ বিষয়ে পুলিশকে অবহিত করলেও তারা নানা অজুহাত দেখিয়ে গড়িমসি করে। দ্রুত পদক্ষেপ নেয় না।’ মাদকবিরোধী কর্মকাণ্ডে রজনৈতিক দলের নিষ্ক্রিয় ভূমিকায়ও নগরবাসী অসন্তুষ্ট। অনেকে অভিযোগ করেছেন, সরকারি দলের লোকেরা প্রশাসনের সঙ্গে যোগসাজশ করে মাদক ব্যবাসীদের সঙ্গে জাড়িত রয়েছেন বা পৃষ্ঠোপোষকতা দিচ্ছেন। মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তুষার কান্তি মণ্ডল বলেন, সরকারি দল হিসেবে অনেকে সুযোগসন্ধানী দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হওয়ার চেষ্টা করে। প্রশাসনকে বলা হয়েছে, মাদক বা ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িত দলের কাউকে পাওয়া গেলে তাঁর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে। মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক শামসুজ্জামান বলেছেন, রংপুরে মাদকের বিস্তারের জন্য প্রশাসনের দুর্বলতা ও সরকারি দলের সহযোগিতা কাজ করছে। সামাজিক আন্দোলন হচ্ছে না: মাদকের ভয়াবহ বিস্তার সত্ত্বেও রংপুরে এর বিরুদ্ধে বড় কোনো সামাজিক প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে ওঠেনি। মাদকবিরোধী উল্লেখযোগ্য সভা-সমাবেশ, শোভাযাত্রা বা মানববন্ধনের মতো কর্মসূচিও হচ্ছে না। প্রশাসনের ওপর সামাজিক শক্তির কোনো চাপ নেই। সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সহসভাপতি ও একটি বেসরকারি কলেজের অধ্যক্ষ ফখরুল আলমের মন্তব্য, একসময় রংপুরে যে শক্তিশালী সামাজিক আন্দোলন ছিল, এখন তা নেই। আন্দোলন হওয়া দরকার, সচেতন হওয়া উচিত—এ ধরনের কথা সবাই বলছেন, কিন্তু দায়িত্ববোধের জায়গা থেকে এগিয়ে এসে কেউ সক্রিয় হচ্ছেন না। মাহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক হাসনা চৌধুরী, কমিউনিটি পুলিশের সদস্যসচিব সুশান্ত ভৌমিকসহ অনেকেই বলেছেন, বিচ্ছিন্নভাবে যে জনসংযোগ, সেমিনার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে মাদকবিরোধী প্রচারকাজ চলছে, তা যথেষ্ট নয়। সংগঠনগুলোর মধ্যেও কোনো সমন্বয় নেই।

No comments:

Post a Comment