Wednesday, August 20, 2014

শুল্কমুক্ত বন্ড সুবিধা নিয়ে স্বেচ্ছাচার:কালের কন্ঠ

রপ্তানির উদ্দেশ্যে ২০টি বিল অব এন্ট্রির মাধ্যমে পাঁচ কোটি ৪১ লাখ ৯৯ হাজার ৩৭০ টাকা শুল্কায়নযোগ্য মূল্যের কাঁচামাল আমদানি করে গাজীপুরের নান্দুয়াইনের মেসার্স হংকং গার্মেন্ট লিমিটেড। ঢাকার কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট অফিসের কর্মকর্তারা সরেজমিনে গিয়ে দেখেন, বন্ডেড গুদামে কাঁচামাল নেই। এমনকি কারখানার ঘরগুলোর ভেতরে পোশাক তৈরির কোনো যন্ত্রপাতিও নেই। আশপাশের লোকজনের সঙ্গে আলাপ করে কর্মকর্তারা জানতে পারেন, ওই ক
ারখানায় কোনো শ্রমিক নেই। কোনো দিন কোনো শ্রমিককে কাজ করতেও দেখেনি তারা। অর্থাৎ বন্ডেড ওয়্যারহাউসের আওতায় শুল্ককরমুক্ত সুবিধায় আনা কাঁচামাল অবৈধভাবে ঢাকার খোলা বাজারে বিক্রি করে দিয়েছেন ওই কারখানার মালিক। অনিয়মটি ধরা পড়ার পর দ্য কাস্টমস অ্যাক্ট, ১৯৬৯-এর ১১১ ধারায় ছয় কোটি ৪৬ লাখ ৬৭ হাজার ২৭০ কোটি টাকা দাবি করেছে কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট। কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের কর্মকর্তারা জানান, এ রকম দু-একটি কারখানা বা প্রতিষ্ঠান নয়, বন্ড সুবিধার অপব্যবহার করছে এ সুবিধা পাওয়া ছয় হাজার ২৯টি প্রতিষ্ঠানের প্রায় অর্ধেকই। কিন্তু ঢাকার একটি অফিসে বসে এ বিভাগের ১৭ জেলার এতগুলো কারখানার অনিয়ম ধরা সম্ভব হয় না কর্মকর্তাদের পক্ষে। বন্ড সুবিধায় শুল্কমুক্তভাবে আমদানি করা কাঁচামাল দিয়ে তৈরি পণ্য বিদেশে রপ্তানি না করে খোলাবাজারে বিক্রির মাত্র কিছু অংশ ধরতে সক্ষম হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। তাতেই দুই হাজার ৫০টি প্রতিষ্ঠানের এ ধরনের অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া গেছে, যাদের ব্যবসা পরিচিতি নম্বর (বিজনেস আইডেন্টিফিকেশন নম্বর- বিআইএন) বাতিল করে তাদের আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট। ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের হিসাব অনুযায়ী, বন্ডেড ওয়্যারহাউসের আওতায় প্রতিবছর শুধু আমদানি পর্যায়ে ৩০ হাজার কোটি টাকারও বেশি শুল্ককর অব্যাহতি দিয়ে থাকে সরকার। স্থানীয় পর্যায়ে মূল্য সংযোজন কর (মূসক) অব্যাহতির হিসাব বিবেচনায় নেওয়া হলে এর পরিমাণ আরো অনেক বেশি হবে। ৩০ হাজার কোটি টাকারও বেশি রাজস্ব ছাড় দিয়ে আমদানি করা পণ্য যাতে খোলাবাজারে বিক্রি না হয়, তা প্রতিরোধ করার দায়িত্ব পিয়ন-দারোয়ান মিলিয়ে মাত্র ২০৬ জনের ওপর। অথচ জনবল দরকার এক হাজারেরও বেশি। আর ঢাকার সেগুনবাগিচার ছোট্ট একটি অফিসে বসে পুরো ঢাকা বিভাগের কারখানাগুলোকে নজরে রাখতে হিমশিম খেতে হয় তাঁদের। প্রতিষ্ঠানটির কমিশনার ড. মো. সহিদুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ঢাকায় বসে বন্ড সুবিধা ভোগ করা ১৭ জেলার ৬০২৯টি কারখানার ওপর নজরদারি সম্ভব নয়। তাই সীমিত জনবল ও সামর্থ্যে সর্বোচ্চ চেষ্টা সত্ত্বেও বন্ড সুবিধার অপব্যবহার পুরোপুরি রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। এ ছাড়া চোখের সামনে বন্ড সুবিধার অপব্যবহার হলেও অনেক সময় নিয়মনীতির কারণে তা ধরার উপায় থাকে না।’ কর্মকর্তারা জানান, বন্ড সুবিধার অপব্যবহার রোধে বর্তমান কমিশনার আগের চেয়ে বেশি তৎপর। ফলে বন্ড সুবিধা ভোগ করা অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠান, বন্ড সুবিধায় এনে খোলাবাজারে বিক্রিসহ বিভিন্ন অনিয়মের দায়ে ২০৫০টি প্রতিষ্ঠানের বিআইএন স্থগিত করা হয়েছে। অথচ তিন মাস আগেও এই সংখ্যা ছিল মাত্র ১৫০। আর ঢাকা বিভাগের ৬০২৯টি প্রতিষ্ঠানে জরিপ চালিয়ে এর মধ্যে ৩৫০টির কোনো অস্তিত্বই পাওয়া যায়নি, যাদের লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে রাজস্ব ফাঁকির দাবিনামাও কয়েক গুণ বেড়েছে। ২০১২ সালে রাজস্ব দাবিনামার পরিমাণ ছিল ৪১ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। ২০১৩ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৮৩ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। আর ২০১৪ সালের ৩০ জুলাই পর্যন্ত রাজস্ব দাবিনামার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৪০ কোটি ৬২ লাখ টাকা। প্রায় ১৩০টি প্রতিষ্ঠানের ১৮১ জন পরিচালক বা মালিকের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে। সার্টিফিকেট মামলা করা হয়েছে প্রায় ৬৫০টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। বন্ড সুবিধার অপব্যবহার রোধে নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করে কমিশনার সহিদুল ইসলাম বলেন, পোশাক খাতের ইউডি (ইউটিলাইজেশন ডিক্লারেশন) ইস্যুর ক্ষমতা ১৯৯৩ সাল থেকে বিজিএমইএকে দেওয়া হয়েছে। একজন পোশাক মালিক এক লাখ পিস শার্ট রপ্তানির অর্ডার পাওয়ার পর তিনি যখন ইউডি নেন তখন প্রতি পিসে হয়তো আড়াই গজ ফেব্রিকস হিসাব করে বন্ড সুবিধায় আড়াই লাখ গজ কাপড় আমদানি করেন। কিন্তু আদতে দেখা গেল প্রতিটি শার্ট তৈরিতে ফেব্রিক্স লেগেছে দুই গজ করে। এতে দুই লাখ গজের ফেব্রিক্স দিয়ে শার্ট বানিয়ে রপ্তানি করল, বাকি ৫০ হাজার গজ কাপড় খোলাবাজারে বিক্রি করে দিল। এই অনিয়ম রোধ করা দুষ্কর উল্লেখ করে সহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা শুধু অডিট করি। অডিট করতে গিয়ে দেখি কাগজপত্র ঠিকঠাক রয়েছে। প্রতি পিস শার্টের জন্য আড়াই গজ করে আমদানি করা আড়াই লাখ গজ ফেব্রিক্সই ব্যবহার করা হয়েছে। তখন আমাদের আর কিছুই করার থাকে না।’ সহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা শুধু নিরীক্ষা করি। পদ্ধতির মধ্যেও অনেক গলদ রয়েছে। তাই বন্ড সুবিধায় শুল্কমুক্তভাবে আনা পণ্য অনেকে খোলাবাজারে বিক্রি করে রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে। এর চেয়েও বড় ক্ষতি হচ্ছে স্থানীয় উদ্যোক্তাদের। কারণ তাঁরা বিপুল পরিমাণ শুল্ক দিয়ে কাঁচামাল আমদানি করে পণ্য তৈরি করছেন স্থানীয় বাজারের জন্য। সেখানে বিনা শুল্কে আনা কাঁচামাল বা কাঁচামালের নামে আনা ফিনিশড পণ্য দেশে উৎপাদিত পণ্যের চেয়েও সস্তায় বিক্রি হচ্ছে। এতে কেবল বিনিয়োগকারীদেরই ক্ষতি হচ্ছে না, কর্মসংস্থান ও সার্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতেও মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এ কারণে কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের বর্তমান কর্তৃপক্ষ বন্ড সুবিধায় আনা পণ্য যাতে কোনোভাবেই স্থানীয় বাজারে ছড়িয়ে পড়তে না পারে তা রোধ করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে। কর্মকর্তারা জানান, বর্তমানে বন্ড সুবিধা ভোগ করা ৬০২৯টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে গার্মেন্ট রয়েছে ৪০৬২টি, প্রচ্ছন্ন বন্ড রয়েছে ১৪৫৫টি, সাভারে অবস্থিত ঢাকা ইপিজেডে ১৪৩টি, নারায়ণগঞ্জের আমদজী ইপিজেডের ৪০টি প্রতিষ্ঠান, সুপারভাইজড বন্ড ১২৫টি প্রতিষ্ঠান, হোম কনজাম্পশন বন্ড ৫১টি এবং প্রিভিলেজড, ডিপ্লোমেটিক বন্ড ও ডিউটি ফ্রি বা পেইড শপগুলো ২৩টি বন্ড সুবিধা ভোগ করছে। এ সুবিধার অপব্যবহার কেবল পোশাক খাত নয়, অন্যান্য খাতেও ছড়িয়ে পড়েছে। গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর বর্তমান কমিশনার সহিদুল ইসলাম জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান গোলাম হোসেনের কাছে বন্ড সুবিধার অপব্যবহার রোধে নেওয়া কার্যক্রম ও ফল সংবলিত একটি প্রতিবেদন জমা দেন। সেখানে বলা হয়, বন্ড সুবিধার অপব্যবহার ছড়িয়ে পড়ছে ইপিজেডগুলোতেও। ওই প্রতিবেদন জমা দেওয়ার আগের আট মাসে দৈবচয়ন পদ্ধতিতে কিছু প্রতিষ্ঠানে পুনঃনিরীক্ষা চালিয়ে বিপুল পরিমাণ শুল্ক ফাঁকির তথ্য পায় কাস্টমস বন্ড কমিশনার কার্যালয়। প্রতিবেদনের তথ্যমতে, ঢাকার জিরাবোর গুমাইল এলাকার অ্যাচিভ এক্সেসরিজ তিন কোটি ৫৫ লাখ টাকা; ৩৪/৩৫ উমেশ দত্ত রোড, বকশীবাজার, লালবাগের দীপা পলি অ্যান্ড এক্সেসরিজ ৯৬ লাখ; উত্তরখানের কাঁচকুড়ার মিশেল কম্পানি ১০ কোটি; সাভারের মির্জানগরের এমএবি স্পিনিং লিমিটেড এক কোটি ১৪ লাখ; ১৯০ আরামবাগ, মতিঝিলের রিও ফ্যাশন লিমিটেড ১১ কোটি; ৭ হাটখোলা রোড, সূত্রাপুরের মৃণ¥য় ফ্যাশন অ্যান্ড ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল এক কোটি ৬৮ লাখ; আশুলিয়ার পূর্ব নরসিংহপুরের ভিনটেজ গার্মেন্ট এক কোটি ৭৪ লাখ; আশুলিয়া উপজেলার জিরাবো এলাকার ঘোষবাগে অবস্থিত মেসার্স প্যারাগন প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং লিমিটেড এক কোটি ৩৩ লাখ  এবং গাজীপুরের টঙ্গী এলাকার মেসার্স ব্রিলিয়াস্ট হীরা লিমিটেড দুই কোটি ৬৬ লাখ টাকা রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের কোনো কোনোটির কাছে দাবিনামা পাঠানো ও কোনোটির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করার কথা উল্লেখ আছে প্রতিবেদনে।   দীর্ঘদিন ধরে অনেক প্রতিষ্ঠানের নিরীক্ষা অসম্পূর্ণ রয়েছে উল্লেখ করে কাস্টম বন্ড কমিশনারেটের কমিশনার রাজস্ব বোর্ডকে জানিয়েছেন, তিন বছরের বেশি সময় ধরে অডিট অনিষ্পন্ন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৬৮৬টি। এত বিপুল পরিমাণ প্রতিষ্ঠানের নিরীক্ষা হালনাগাদ না থাকা বন্ড সুবিধার অপব্যবহারের ঝুঁকি সৃষ্টি করে। হালনাগাদ নিরীক্ষা না করানো ও দাবিনামার কারণে প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষকে কারণ দর্শাও নোটিশ জারি করা হলে প্রায়ই এসব অপরাধী নোটিশের কোনো জবাব দেয় না। এমনকি শুনানিতে ডাকলেও উপস্থিত হয় না তারা। এ সমস্যা সমাধানের জন্যই এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের মালিকদের ব্যাংক হিসাব জব্দ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এটা করার পর অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদের হদিস পাওয়া যাচ্ছে। অনেক মালিক নিজে থেকেই এসে যোগাযোগ করছেন। তাই এভাবে অস্তিত্বহীন বা বন্ড সুবিধার অপব্যবহারকারী প্রতিষ্ঠানের মালিকদের ব্যাংক হিসাব জব্দ করার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন কর্মকর্তারা।

No comments:

Post a Comment