Wednesday, August 20, 2014

কোচিংয়ের নামে হাজার কোটি টাকা লোপাট!:কালের কন্ঠ

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তীচ্ছু শিক্ষার্থীরা ভর্তির আগে কোচিংয়ের পেছনে জনপ্রতি গড়ে ব্যয় করে ৪৩ হাজার ৯৮ টাকা। ভর্তীচ্ছু প্রায় ৯৩ শতাংশ শিক্ষার্থীই কোচিং করতে বাধ্য হয়। দেশের ১২টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে পরিচালিত এক গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে এ তথ্য। এ গবেষণা থেকে পাওয়া পরিসংখ্যান অনুসারে, বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিক্যাল কলেজে ভর্তীচ্ছু শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের কাছ থেকে কোচিং ব্যবসায়ীরা প্রতিবছ
র লোপাট করে নিচ্ছে কয়েক হাজার কোটি টাকা। শিক্ষামন্ত্রীর মতে, এই টাকার পরিমাণ ৩২ হাজার কোটি টাকা। ধারণা করা হচ্ছে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সমন্বিত উদ্যোগ সফল না হওয়ার পেছনে এই বাণিজ্যিক স্বার্থ বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) অধীন ‘উচ্চশিক্ষা মানোন্নয়ন প্রকল্প’ (হেকেপ) থেকে সম্প্রতি এ সমীক্ষা পরিচালিত হয়। এর ভিত্তিতে প্রস্তুত গবেষণা প্রতিবেদনটি ইউজিসির পক্ষ থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়েছে।  ওই গবেষণা অনুসারে, উচ্চশিক্ষায় ভর্তির জন্য শিক্ষার্থীদের জনপ্রতি যে টাকা ব্যয় করতে হয়, তা তার অভিভাবকের বার্ষিক আয়ের ৭ ভাগের এক ভাগ। এসব শিক্ষার্থীর অভিভাবকের বার্ষিক গড় আয় মাত্র তিন লাখ ১০ হাজার টাকা বলে সমীক্ষায় উঠে এসেছে। প্রতিবেদন অনুসারে গত বছর যারা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে তাদের মধ্যে প্রায় ৮৪ শতাংশ শিক্ষার্থীকেই ভর্তির আগে কোচিং করতে হয়েছে। গত বছর কোচিং বাবদ জনপ্রতি ব্যয় করতে হয়েছে গড়ে ৩১ হাজার ৩৭৯ টাকা। অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় এ বছর কোচিংয়ের প্রতি আগ্রহ এবং ব্যয় দুটোই বেড়েছে। হেকেপের এই সমীক্ষাটি দেশের ১২টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক, সুধীসমাজের প্রতিনিধি এবং ভর্তীচ্ছু শিক্ষার্থীদের মধ্যে পরিচালিত হয়। নির্দিষ্ট প্রশ্নমালায় মোট ৮৭৬ জনের মতামত গ্রহণ করা হয়। হেকেপের গবেষণা কর্মকর্তা ড. সিরাজুল ইসলাম জানান, সমীক্ষায় প্রাপ্ত ফলাফলের ভিত্তিতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিয়ে একটি কর্মশালার আয়োজন করা হয়। তার ভিত্তিতে সুনির্দিষ্ট সুপারিশমালাও প্রস্তুত করা হয়। ওই সুপারিশে ভর্তি নিয়ে শিক্ষার্থীদের উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, অর্থ ব্যয়, এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ছোটাছুটির মতো সীমাহীন ভোগান্তি দূর করতে অনতিবিলম্বে সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ‘গুচ্ছ পদ্ধতির সমন্বিত ভর্তি ব্যবস্থা’ প্রবর্তনের কথা বলা হয়েছে। গবেষণা প্রতিবেদন অনুসারে সমীক্ষায় মোট উত্তরদাতার ৭২.১৬ শতাংশ গুচ্ছ পদ্ধতির ভর্তি পরীক্ষা আয়োজনের জন্য মতামত দিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ৮৯ শতাংশও এর প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। গত বছর ৭ জুলাই শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের নিয়ে গুচ্ছ পদ্ধতির ভর্তির বিষয়ে সিদ্ধান্তের জন্য বৈঠক করেছিল। সে সভায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া আর সব বিশ্ববিদ্যালয় সমন্বিত উদ্যোগের প্রতি একমত পোষণ করে। পরবর্তী বছর থেকে এই পদ্ধতি কার্যকর করার সিদ্ধান্ত হয় বলে শিক্ষামন্ত্রী তখন গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন। কিন্তু এ বছর এই পদ্ধতি কার্যকর করার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এ ব্যাপারে গত ১৩ আগস্ট এইচএসসি পরীক্ষার ফল ঘোষণাকালে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্বায়ত্তশাসিত, আমরা তাদের ওপর কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে পারি না। এ ছাড়া এর পেছনে অনেক বিষয় রয়েছে। বিশাল অংশের কোচিং বাণিজ্য হচ্ছে। বছরে প্রায় ৩২ হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য হচ্ছে কোচিংয়ের নামে। ফলে এরা বসে নেই। দেশের কোচিং বাণিজ্যের অন্যতম কেন্দ্র ফার্মগেট এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কোনো কোচিং সেন্টারেই সিট খালি নেই। গত জুন মাসে এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরই কোচিং সেন্টারগুলোতে ভর্তি ও ক্লাস শুরু হয়ে যায়। ‘উ’ আদ্যাক্ষরের একটি কোচিং সেন্টারেই ভর্তি হয়েছে প্রায় ৯ হাজার শিক্ষার্থী। একেকজন শিক্ষার্থীর কাছ থেকে নেওয়া হয়েছে ১২ থেকে ১৬ হাজার টাকা। গ্রিন রোডে একই কোচিং সেন্টারের আরেকটি শাখায়ও একই অবস্থা। ফার্মগেটের শতাধিক কোচিং সেন্টারে কম করে হলেও ৫০ হাজার শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে। আশপাশের বাসাবাড়ি ও মেসেও এখন কোচিং সেন্টার। মৌলভীবাজারের সাংবাদিক আবদুল হামিদ মাহবুব তাঁর ছেলেকে ফার্মগেটের একটি কোচিং সেন্টারে ভর্তি করিয়েছেন। তিনি হিসাবে করে দেখিয়েছেন কোচিং সেন্টারে ভর্তি হওয়া প্রতিজন শিক্ষার্থীর পেছনে অভিভাবকদের ব্যয় করতে হচ্ছে প্রায় ৪৬ হাজার ৫০০ টাকা। তাঁর মতে, প্রতি শিক্ষার্থীকে প্রতি মাসে হোস্টেলে দিতে হচ্ছে চার থেকে ছয় হাজার টাকা। থাকা ও খাওয়ার জন্য ছয় থেকে আট হাজার টাকা। প্রত্যেককে থাকতে হচ্ছে তিন থেকে চার মাস। এর বাইরে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর হাতখরচ তো আছেই। তাঁর মতে, কেবল ফার্মগেট এলাকায় কোচিং সেন্টারগুলোতে ভর্তি হওয়া ৫০ হাজার শিক্ষার্থীর মোট খরচ হবে ২৩২ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এ ছাড়া ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় কোচিং সেন্টারগুলোর শাখা এবং দেশের বিভাগীয় ও জেলা শহরগুলোর শাখার হিসাব যোগ করলে টাকার অঙ্কটা অবিশ্বাস্য রকম হবে। তা হাজার কোটি টাকার কম হবে না। নিজের ছেলেকে কেন ভর্তি করিয়েছেন, এ প্রশ্নের জবাবে আবদুল হামিদ বলেন, ‘ওর সঙ্গের প্রায় সবাই কোনো না কোনো কোচিংয়ে ভর্তি হয়েছে। এই অবস্থায় আমি যদি তাকে না দেই সে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত থাকবে। তাই বাধ্য হয়ে ভর্তি করিয়েছি। আমি আরো অনেক অভিভাবকের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি, তাঁরাও আমাকে একই কথাটা বলেছেন। এ ছাড়া একটি বাস্তব কারণও আছে, এক ঘণ্টার ভর্তি পরীক্ষায় এমসিকিউ (বহু নির্বাচনী প্রশ্ন) পদ্ধতির প্রশ্নের ধরন সম্পর্কেও নিশ্চয়ই একটা ধারণা পাবে। কারণ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার যে ব্যয়, তাতে করে আমরা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ কোনোভাবেই হারাতে চাই না। উচ্চ শিক্ষায় ভর্তির এমন একটি পদ্ধতি বের করা উচিত, যাতে এইচএসসি পরীক্ষার পর আর কোনো ভর্তি পরীক্ষা দিতে না হয়। তাহলেই কেবল কোচিং ব্যবসা বন্ধ হতে পারে। কোচিং বাণিজ্য ও এর পেছনে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, আগে শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা দিয়ে আনন্দময় অবসর সময় কাটাত। এখন তাদের ভর্তি নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় কাটাতে হয়। কোচিংয়ের পেছনে সময় ও অর্থ ব্যয় করতে হয়। এটা অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। না হলে এর সুদূরপ্রসারী কুপ্রভাব পড়বে। এ ব্যাপারে সরকারকেই প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে, প্রয়োজনে কঠোর হতে হবে। এ বছর এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় আট লাখ ৮৫ হাজার ৭০ জন শিক্ষার্থী পাস করেছে। এর মধ্যে জিপিএ ৫ পেয়েছে ৭০ হাজার ৬০২ জন। এর বিপরীতে ৩৫টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন রয়েছে মাত্র ৪৩ হাজার।  আর সরকারি-বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে আসনসংখ্যা হচ্ছে আট হাজার ৩৫০টি। এই হিসাবে জিপিএ ৫ প্রাপ্তদের সবাই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা মেডিক্যালে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাবে না। এসব প্রতিষ্ঠানে ভর্তির জন্য শিক্ষার্থীদের তীব্র প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হতে হবে।

No comments:

Post a Comment