নিখোঁজ হচ্ছেন একের পর এক। স্বজনেরা অপেক্ষায় আছেন কখন ফিরে আসবেন তারা। কিন্তু ফিরে আসছেন না। ২০০৯ সাল থেকে চলতি বছরের ২৮ আগস্ট পর্যন্ত এ তালিকায় রয়েছেন দেড়শতাধিক মানুষ। এর মধ্যে রাজনৈতিক নেতা, ছাত্র, চাকরিজীবী, ব্যবসায়ীসহ অনেক মানুষই আছেন। গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্মরণে আজ ৩০ আগস্ট পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক দিবস। বিশ্বের প্রতিটি দেশের মতো এ দেশেও এ দিনে মানুষ গুম হওয়া ব্যক্তিদের উদ্ধারে দাবি জানানো হবে।
মানবাধিকার সংগঠন অধিকার জানিয়েছে, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে গুমের ঘটনা ঘটে, যা যুদ্ধ পরবর্তীকালেও বিভিন্ন সরকারের আমলে অব্যাহত আছে। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে গুম হয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে বিশিষ্ট চলচ্চিত্র নির্মাতা জহির রায়হান, বামপন্থী নেতা সিরাজ সিকদার ও ুদ্র জাতিগোষ্ঠীর নেত্রী কল্পনা চাকমা অন্যতম। সংগঠনটি জানিয়েছে ২০০৯ সাল থেকে চলতি বছরের ২৮ আগস্ট পর্যন্ত ১৫০ জন গুমের শিকার হয়েছেন। ১০ মাস ধরে নিখোঁজ সুমন, তরিকুল ইসলাম ঝন্টু, আব্দুল কাদের ভূঁইয়া মাসুম, মাজহারুল ইসলাম রাসেল, আসাদুজ্জামান, আল আমিন, এ এম আদনান চৌধুরী ও সুমনের খালতো ভাই জাহিদুল করিম তানভীর। সাজেদুল ইসলাম সুমন ছিলেন ঢাকা মহানগর ৩৮ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক। ২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর র্যাব-১ লেখা গাড়িবহর সুমনকে তুলে নিয়ে যায়। ঘটনাস্থল ভাটারা থানা হলেও ওই থানায় একটি সাধারণ ডায়েরিও গ্রহণ করেনি। একই সাথে নিখোঁজ হওয়া মাসুম, তানভীর, রানা ও রাসেলের পরিবার ‘বাসা থেকে বের হওয়ার পর আর ফিরে আসেনি’ এ কথা লেখার শর্তে গুলশান, তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল ও মুগদা থানায় পৃথক জিডি করেছে। নিখোঁজ হওয়া প্রতিটি পরিবারের কাহিনী প্রায় একই। কেউ কেউ জিডি বা মামলা দায়ের করতে সক্ষম হলেও ওই পর্যন্তই শেষ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা নিখোঁজ ব্যক্তিদের উদ্ধারে কোনোই ব্যবস্থা নেয়নি বলে সবার অভিযোগ। সূত্র জানায়, নিখোঁজের তালিকায় যোগ হচ্ছে নতুন নতুন অনেক মানুষের নাম। গত বছর ২৪ জুন রাজধানীর বাড্ডার শাহজাদপুর এলাকা থেকে সাদা পোশাকের লোকজন তুলে নিয়ে যায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রকে। তারা হলেনÑ তাজাম্মুল আলী ও আজিজুর রহমান। ওই বছরের ২৬ জুন তুলে নেয়া হয় আব্দুস সালাম ও নুরুল আমিন নামের আরো দুই যুবককে। গত ৪ এপ্রিল রাজধানীর মিরপুর মাজার রোডের দ্বিতীয় কলোনির ডায়মন্ড গার্মেন্টের সামনে থেকে অপহৃত হন ছাত্রদল নেতা মফিজুল ইসলাম রাশেদ (৩২)। ডিবির জ্যাকেট পরিহিত একদল লোক রাশেদকে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যায়। গত ৪ এপ্রিল রাজশাহী থেকে অপহৃত হন রাজশাহী মহানগর শিবিরের দফতর সম্পাদক আনোয়ারুল ইসলাম মাসুম। গত ১১ এপ্রিল রাতে জয়পুরহাট জেলা জামায়াতের সেক্রেটারি ও জয়পুরহাট তালিমুল ইসলাম স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক নজরুল ইসলাম বাসা থেকে নিখোঁজ হন। এরপর একদিন বাসায় ফিরে আবারো নিখোঁজ হন তিনি। ২০১২ সালে ১৭ এপ্রিল রাজধানীর বনানী এলাকা থেকে নিখোঁজ হন বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক এমপি এম ইলিয়াস আলী ও তার গাড়িচালক আনসার আলী। এ ঘটনার আগে অপহরণের শিকার হন সিলেট জেলা ছাত্রদলের সহসাধারণ সম্পাদক দিনার ও ছাত্রদল নেতা জুনায়েদ। ২০১০ সালের ২৫ জুন রাতে রাজধানীর ফার্মগেটের ইন্দিরা রোড থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর সদস্য পরিচয়ে কে বা কারা ধরে নিয়ে যায় চৌধুরী আলমকে। কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র আল মুকাদ্দাস (২৩) ও ওয়ালিউল্লাহ (২৪) নিখোঁজ রয়েছেন ২০১২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি থেকে। ২০১০ সালের ১৭ এপ্রিল রাজধানীর কুড়িল বিশ্বরোড থেকে অপহৃত হন ঝালকাঠীর রাজাপুর থানা যুবদল নেতা মিজানুর রহমান জমাদ্দার ও তার দুই সহযোগী মুরাদ ও ফোরকান। কয়েক মাস পর ফোরকান বেরিয়ে এসে তাদের নিখোঁজ হওয়ার কাহিনী মিডিয়ার সামনে তুলে ধরেন। এর কয়েক দিন পরে আবারো নিখোঁজ হন ফোরকান। মিজানের কোনো হদিস মেলেনি আজো। এরপর মিজানের শ্যালক মিজান শিকদার এবং তার ভাতিজা সুমনকেও একইভাবে গাজীপুর ও মিরপুর থেকে অপহরণ করা হয়। সে থেকে তারাও নিখোঁজ। ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সহসভাপতি কে এম শামীম আখতার ২০১১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর থেকে নিখোঁজ। ২০১২ সালের ২৬ ডিসেম্বর গোপালগঞ্জের বোড়াশী পশ্চিমপাড়ার মান্দারতলা এলাকা থেকে অপহরণ হন উবায়দুর নামে এক যুবক। এ ঘটনায় ২১ জানুয়ারি গোপালগঞ্জ সদর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি এবং ৮ ফেব্রুয়ারি একটি মামলা হয়। একই দিন গোপালগঞ্জের কাশিয়ানি উপজেলার দক্ষিণ ফুকরার মিল্টন বাজার এলাকা থেকে অপহৃত হন মাহবুব নামে এক যুবক। ২০১১ সালের ৮ ডিসেম্বর রাজধানীর মিরপুর থেকে নিখোঁজ হন ুদ্র ব্যবসায়ী কালাম শেখ, তার মামাতো ভাই আবুল বাশার শেখ, আব্দুল করিম ও আতাউর রহমান ওরফে ইস্রাফিল। ২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল ঢাকা মহানগর হাকিম আদালত থেকে নিখোঁজ হন ব্যবসায়ী রেজাউল করিম রিজভি। ৮ এপ্রিল রাজধানীর সূত্রাপুর এলাকা থেকে নিখোঁজ হন ব্যবসায়ী তারিব উদ্দিন আহম্মেদ। ১৫ ফেব্রুয়ারি শাহজাহানপুর থেকে দোকান কর্মচারী রফিকুল ইসলাম। ২৪ মে জিন্দাবাহার লেন এলাকা থেকে ব্যবসায়ী আয়নাল মোল্লা। ২০১১ সালের ৮ ডিসেম্বর কামরাঙ্গীরচর আব্দুল আজিজ লেনের বাসিন্দা সুলতান হাওলাদার। ২০১২ সালের ২ অক্টোবর রাজধানীর দক্ষিণখান থেকে ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম। ২৬ অক্টোবর ফকিরাপুলের হোটেল অবসরের সামনে থেকে ফেনীর সারোয়ার জাহান বাবুল, ৮ নভেম্বর রাজধানীর সূত্রাপুর থেকে ব্যবসায়ী মমিন হোসেন, ২৪ অক্টোবর রাজশাহী মহানগরীর লক্ষ্মীপুর ভাটাপা জামে মসজিদের ইমাম ও গোদাগাড়ী পালপুর ধরমপুর মহাবিদ্যালয়ের প্রভাষক আমিনুল ইসলাম, ২০১১ সালের ১৭ নভেম্বর মালিবাগ থেকে অপহরণ করা হয় ভোলার আরিফ, জসিম, জুয়েল, শেখ সাদী, দিদার, আকাশ ও মিরাজকে। ২৮ নভেম্বর আশুলিয়া থেকে জসিমের লাশ উদ্ধার হয়। ২৮ নভেম্বর হাতিরপুল এলাকা থেকে নিখোঁজ হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সূর্যসেন হল ছাত্রদলের সাহিত্য ও গবেষণা সম্পাদক শামীম হাসান সোহেল, ৫০ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রদলের সভাপতি ইসমাইল হোসেন ওরফে আলআমিন ও সদস্য মাসুম হোসেন। ১০ দিন পর মুন্সীগঞ্জ থেকে উদ্ধার হয় ইসমাইলের গলিত লাশ। ২০১১ সালের ১৯ অক্টোবর সাভারের কাতলাপুর এলাকা থেকে নিখোঁজ হন ঢাকা মহানগর ৪১ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি হাজী নুর মোহাম্মদ। এরপর ৩ ডিসেম্বর থেকে নিখোঁজ হন নূর হাজীর মেয়ের জামাই আব্দুল মান্নান ও তার বন্ধু ইকবাল হোসেন। ২০১২ সালের ৮ এপ্রিল পুরান ঢাকার ফরাশগঞ্জ এলাকা থেকে নিখোঁজ হন ব্যবসায়ী তাবির উদ্দিন আহম্মেদ রানা। ২০১১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর রাজধানীর গেন্ডারিয়া এলাকা থেকে নিখোঁজ হন তপন দাস। এভাবে নিখোঁজ রয়েছেন, আওয়ামী লীগ নেতা নুর মোহাম্মদ হাজী, তার জামাতা, নজরুল ইসলাম বাছা, ব্যবসায়ী হুমায়ুন, মাওলানা শামীম, ওয়ালি উল্লাহ, ছাত্রলীগ নেতা দেলোয়ার, শ্রমিক হাবিবুর রহমান, ব্যবসায়ী আব্দুল করিম হাওলাদার, ৯৮ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক তুষার ইসলাম টিটু, ফার্মগেটের ব্যবসায়ী ইউসুফ আলী সুজন, ব্যবসায়ী জহির রায়হান হিরণ, ব্যবসায়ী হাজী ওয়াজি উল্লাহ, সিদ্ধিরগঞ্জের সানাপাড়ের ইউনুস মুন্সি, তার মামাতো ভাই শেখেন মাতবর, তাদের সঙ্গী হাফিজুল ইসলাম স্বপন, চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক এলাকার মোজাফফর, ব্যবসায়ী শহীদুর রহমান, সূত্রাপুর থানা স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম আহ্বায়ক মো: মাসুদ, যাত্রাবাড়ীর গোলাম মুর্তাজা, বরিশালের করিম কুঠির এলাকার আলী হায়দার, বরিশালের জাগুয়া ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ও ওয়ার্ড বিএনপির সম্পাদক ফরিদ উদ্দিন, বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সহসভাপতি গোলাম মোস্তফা নান্না, ফরিদপুরের নগরকান্দার সোবহান ও গাইবান্ধার ব্যবসায়ী মিজানুর রহমানসহ অনেকেই। সম্প্রতি সিলেটের এক বিএনপি নেতা এবং তার গাড়িচালক উদ্ধার হয়েছেন। প্রায় চার মাস নিখোঁজ থাকার পরে তারা উদ্ধার হলেন। এর কয়েক দিন আগে এক শিক্ষক দীর্ঘদিন নিখোঁজ থাকার পরে পুলিশ তাকে গ্রেফতার দেখায়। সূত্র জানায়, আজ বেশ কয়েকটি মানবাধিকার সংগঠন জাতীয় প্রেস কাবের সামনে কর্মসূচি পালন করবে। তাদের সাথে থাকবে গুম হওয়া ব্যক্তিদের পরিবার।
No comments:
Post a Comment