রহীতা এবং সুবিধাভোগী দুই প্রতিষ্ঠানের হিসাবে ঋণের টাকা ছাড়া অন্য কোনো লেনদেন হয়নি বললেই চলে। ঋণের টাকা লেনদেন শেষে ঢাকার ইন্ডাস্ট্রিজের হিসাবটি বন্ধ করে দেয়া হয়। বাধ্যতামসূলক হলেও একটি ঋণ বিতরণের আগে সিআইবির তথ্য ও পর্ষদের অনুমোদন নেয়া হয়নি। সূত্র জানায়, এক কোম্পানির নামে ঋণ নিয়ে অন্য কোম্পানি বেনামে সুবিধাভোগ করতেই এই জালিয়াতি করা হয়েছে। এর সহায়ক হিসেবে বেআইনিভাবে হিসাব খোলা, জালিয়াতদের আড়াল করতে তিন শাখায় টাকা স্থানান্তর, অন্যের সম্পত্তি বন্ধক দেয়ার ঘটনা ঘটেছে ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়, শাখা ও দুই কোম্পানির কর্মকর্তাদের সহায়তায়। এই অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ব্যাংক কর্মকর্তাদের শনাক্ত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে এবি ব্যাংকের এমডি শামীম আহমেদ চৌধুরীর কাছে চিঠি পাঠানো হয়েছে। চিঠিতে ঋণ আদায় না হলে এটি খেলাপি করে এর বিপরীতে প্রভিশন রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এই ঘটনার পর প্রত্যাহার করা হয়েছে ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপককে। দায়িত্ব নিয়েছেন নতুন ব্যবস্থাপক। এবি ব্যাংক সূত্র জানায়, তারা নিয়ম-কানুন মেনেই ঋণ দিয়েছে উত্তরা ট্রেডার্সকে। এর দায় তাদেরই। ফলে ঋণের টাকা উত্তরা ট্রেডার্সের কাছ থেকেই আদায় করা হবে। এ বিষয়ে জানার জন্য এবি ব্যাংকের এলিফ্যান্ট রোড শাখার ব্যবস্থাপক আরশাদ মাহমুদ খানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ বিষয়ে কোনো কিছুই বলতে চাননি। গ্রাহকের গোপনীয়তা রক্ষায় তিনি অঙ্গীকারবদ্ধ। এ বিষয়ে জানতে তিনি ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন। একই বিষয়ে বক্তব্য জানতে উত্তরা ট্রেডার্সের কর্ণধার গিরিধারী লাল মোদি গ্র“পের কার্যালয় মতিঝিলের রহমান চেম্বারে যোগাযোগ করে কথা বলার মতো কাউকে পাওয়া যায়নি। মহাখালীর অফিসে টেলিফোনে যোগাযোগ করেও তাদের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। টেলিফোনে হিসাব বিভাগের একজন কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে জানান, কোম্পানির কর্ণধার গিরিধারী লাল মোদি দেশে আছেন কিনা তা তিনি জানেন না। এ বিষয়ে তিনি কোনো কথা বলতেও নারাজ। অতি দ্রুততায় ঋণ : এলিফ্যান্ট রোড শাখায় উত্তরা ট্রেডার্সের নামে ২০১৩ সালের ২ জুলাই একটি চলতি হিসাব খোলা হয়। একই দিন ব্যাংকের কারওয়ানবাজার শাখায় নিউ ঢাকা ইন্ডাস্ট্রিজের নামে অপর একটি হিসাব খোলা হয়। এর একদিন আগে ১ জুলাই চলতি মূলধন হিসেবে ৭০ কোটি টাকা ঋণের জন্য শাখায় আবেদন করে উত্তরা ট্রেডার্স। হিসাব খোলার নয় দিন পর ১১ জুলাই শাখা থেকে ঋণ প্রস্তাব প্রধান কার্যালয়ে পাঠানো হয়। এর মাত্র দুই সপ্তাহ পর ২৫ জুলাই ব্যাংকের পর্ষদ ৫৫ কোটি টাকার ঋণ অনুমোদন করে। এর চার দিন পর ২৯ জুলাই শাখাকে ঋণ অনুমোদনের কথা জানানো হয়। শাখা থেকে ৩১ জুলাই ও ৫ আগস্ট দুটি চেকের মাধ্যমে সাড়ে ২৭ কোটি টাকা করে মোট ৫৫ কোটি টাকা ওই হিসাবে স্থানান্তর করে। ৩১ জুলাই স্থানান্তর হওয়া টাকার মধ্যে ১৭ কোটি টাকা এবি ব্যাংকের প্রিন্সিপাল শাখার মাধ্যমে কারওয়ানবাজার শাখায় নিউ ঢাকা ইন্ডাস্ট্রিজের হিসাবে এবং বাকি ১০ কোটি আইএফআইসি ব্যাংকের ধানমণ্ডি শাখা ঢাকা ইন্ডাস্ট্রিজের হিসাবে স্থানান্তর করা হয়। এছাড়া ৫ আগস্ট জমা হওয়া টাকা ওই দিন ও পরের দিন মোট দু’দিনে ৫টি চেকে ২৮ কোটি টাকা এবি ব্যাংকের প্রিন্সিপাল শাখার মাধ্যমে ঢাকা ইন্ডাস্ট্রিজের কারওয়ানবাজার শাখার হিসাবে স্থানান্তর করা হয়। এবি ব্যাংকের কারওয়ানবাজার শাখায় ঢাকা ইন্ডাস্ট্রিজের হিসাবে স্থানান্তর করা টাকা পুনরায় পাঠানো হয়েছে প্রিন্সিপাল শাখায়। ওই শাখা থেকে টাকা নগদ তুলে নেয়া হয়েছে। মাত্র ২৫ কার্য দিবসের মধ্যে এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে, যা অস্বাভাবিক মনে করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পরে উত্তরা ট্রেডার্স স্থানীয় ট্রেডিং ব্যবসা বাড়ানোর জন্য ২৫ আগস্ট আরও ২৫ কোটি টাকা চেয়ে আবেদন করে এলিফ্যান্ট রোড শাখায়। এর দু’দিন পর ২৭ আগস্ট শাখা থেকে প্রস্তাব পাঠানো হয় প্রধান কার্যালয়ে। এর দু’দিন পর ২৯ আগস্ট প্রধান কার্যালয় থেকে শাখায় পাঠানো হয় ঋণ মঞ্জুরিপত্র। কিন্তু এই ঋণ মঞ্জুরের আগে সিআইবির ছাড়পত্র নেয়া ও পর্ষদের অনুমোদন নেয়া হয়নি। পর্ষদের অনুমোদন ছাড়াই ব্যাংকের প্রধান কার্যায় থেকে শাখাকে ঋণ প্রদানের নির্দেশনা দেয়াতে প্রমাণিত হচ্ছে, এই জালিয়াতির সঙ্গে ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জড়িত। ওই অর্থ উত্তরা ট্রেডার্সের এলিফ্যান্ট রোড শাখার হিসাবে ২ সেপ্টেম্বর জমা করার পর ২, ৩ ও ৪ সেপ্টেম্বর তিনটি চেকের মাধ্যমে আবার প্রিন্সিপাল শাখায় স্থানান্তর করা হয়। ওখান থেকে কারওয়ানবাজার শাখায় ঢাকা ইন্ডাস্ট্রিজের হিসাবে স্থানান্তর করা হয়। ওই টাকা আবার প্রিন্সিপাল শাখায় স্থানান্তর করে নগদ তুলে নেয়া হয়। মাত্র ৮ কার্য দিবসে টাকা তুলে নেয়া হয়, যা অস্বাভাবিক মনে করা হচ্ছে। কেননা, ঋণের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতে কমপক্ষে ২/৩ মাস সময় লাগে। উত্তরা ট্রেডার্সের ঋণের টাকা তোলার পর গত ৩ অক্টোবর ঢাকা ইন্ডাস্ট্রিজের হিসাবটি বন্ধ করে দেয়া হয়। এর মাধ্যমে বেনামে ঋণ নেয়ার জন্যই ঢাকা ইন্ডাস্ট্রিজের নামে হিসাবটি খোলা হয়েছিল। ঋণের বিপরীতে জামানত হিসেবে বন্ধক রাখা সম্পত্তির মালিকানা উত্তরা গ্র“পের হাতে নেই। ওই সম্পত্তির মালিক ঢাকা ইন্ডাস্ট্রিজ। এর মাধ্যমে উত্তরা ট্রেডার্সের নাম ব্যবহার করে বেনামে ঋণ সুবিধা ভোগ করেছে ঢাকা ইন্ডাস্ট্রিজ। যেসব অনিয়ম : প্রচলিত নিয়মে হিসাব খোলার আগে শনাক্তকারীর মাধ্যমে গ্রাহকের পরিচয় নিশ্চিত হতে হবে। এছাড়া হিসাব খোলা যাবে না। এই ক্ষেত্রে গ্রাহকের পরিচয় নিশ্চিত না হয়েই হিসাব খোলা হয়েছে। হিসাব খোলার আগেই ঋণের জন্য আবেদনকারীর নামে ঋণ প্রস্তাব প্রধান কার্যালয়ে পাঠানো, ঋণ অনুমোদন এবং টাকা ছাড় করা হয়েছে। পর্ষদের অনুমোদন এবং হালনাগাদ ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরোর (সিআইবি) তথ্য ছাড়াই গ্রাহককে দেয়া হয়েছে সীমাতিরিক্ত ঋণ। প্রচলিত নিয়মে হালনাগাদ সিআইবির তথ্য ছাড়া ঋণ দেয়ার সুযোগ নেই। ঋণের টাকা ছাড়া অন্য কোনো লেনদেন না করেই হিসাব বন্ধ করা হয়েছে। ঋণের টাকা আদায় না হলেও ৮ কোটি ৩৯ লাখ টাকা সুদ আয় দেখানো হয়েছে। এর মাধ্যমে মুনাফা জালিয়াতি করে বেশি দেখানো হয়েছে শাখার আয়। ঋণ আদায় না হওয়ায় এটিকে খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়নি। ঋণের বিপরীতে বন্ধকি সম্পত্তি যথাযথভাবে যাচাই না করে ঋণ দেয়ার মাধ্যমে আর্থিক ঝুঁকি নিয়েছে ব্যাংক- যা সম্পূর্ণ বিধিবহির্ভূত। ঋণের প্রকৃত সুবিধাভোগীকে আড়াল করতে তিনটি শাখায় ঋণের টাকা স্থানান্তর করে নগদ তুলে নেয়া হয়েছে। এলিফ্যান্ট রোড শাখা থেকে ঋণের টাকা স্থানান্তর করা হয়েছে প্রিন্সিপাল শাখায়, ওখান থেকে কারওয়ানবাজার শাখায়। ওই শাখা থেকে আবার প্রিন্সিপাল শাখায়। এ শাখা থেকে নগদ তোলা হয়েছে। ব্যাংকিং ব্যবস্থায় এই ধরনের অহেতুক স্থানান্তর অসৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তিন এমডি অপসারিত হয়েছিল : উত্তরা ট্রেডার্সের মালিক গিরিধারী লাল মোদি। তার বিরুদ্ধে রয়েছে নানা ধরনের অভিযোগ। মুদ্রা পাচার ও হুন্ডি ব্যবসার মতো অভিযোগও আছে। দীর্ঘদিন ধরে তিনি গণমাধ্যমে আসেননি। সম্প্রতি এবি ব্যাংকে এক জালিয়াতির ঘটনায় তার নাম আবার উঠে এসেছে। ঘটনা জানার পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকও নড়েচড়ে বসেছে। তারা কঠোরভাবে তদারকি করছে। এর আগে ২০০২ সালে ব্যাংকিং খাতে বড় ধরনের এক কেলেংকারির সঙ্গে তার নাম জড়িত ছিল। ওই সময়ে ওম প্রকাশ আগারওয়াল ও গিরিধারী লাল মোদি নামের দুই ব্যক্তি তিনটি ব্যাংক থেকে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছিলেন। ওই ঘটনার পর প্রথমে দু’জনই উধাও হয়ে গিয়েছিলেন। পরে অবশ্য গিরিধারী লাল মোদি ফিরে এসেছেন। এখন তিনি দেশে ব্যবসা করছেন। ওই সময়ে এই ঘটনায় বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংক, ন্যাশনাল ক্রেডিট অ্যান্ড কমার্স (এনসিসি) ব্যাংক এবং ওয়ান ব্যাংকের তৎকালীন তিন এমডিকে একদিনেই অপসারণ করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এছাড়া প্রায় একডজন ব্যাংক কর্মকর্তা চাকরিচ্যুত হয়েছিল। ওই ঘটনায় জড়িত ব্যাংক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শাস্তি হলেও যারা এর সুবিধাভোগী ছিলেন তাদের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। উল্টো ওই আলোচিত কেলেংকারির নায়ক গিরিধারী লাল মোদি এবি ব্যাংকের প্রায় সাড়ে ৮৮ কোটি টাকা জালিয়াতি করে হাতিয়ে নিয়েছেন।
Headlines from most popular newspapers of Bangladesh. বাংলাদেশে প্রকাশিত প্রধান প্রধান দৈনিক পত্রিকার সংবাদ শিরোনামগুলো এক নজরে দেখে নিন।
Wednesday, August 27, 2014
অভিনব জালিয়াতি এবি ব্যাংকে:যুগান্তর
রহীতা এবং সুবিধাভোগী দুই প্রতিষ্ঠানের হিসাবে ঋণের টাকা ছাড়া অন্য কোনো লেনদেন হয়নি বললেই চলে। ঋণের টাকা লেনদেন শেষে ঢাকার ইন্ডাস্ট্রিজের হিসাবটি বন্ধ করে দেয়া হয়। বাধ্যতামসূলক হলেও একটি ঋণ বিতরণের আগে সিআইবির তথ্য ও পর্ষদের অনুমোদন নেয়া হয়নি। সূত্র জানায়, এক কোম্পানির নামে ঋণ নিয়ে অন্য কোম্পানি বেনামে সুবিধাভোগ করতেই এই জালিয়াতি করা হয়েছে। এর সহায়ক হিসেবে বেআইনিভাবে হিসাব খোলা, জালিয়াতদের আড়াল করতে তিন শাখায় টাকা স্থানান্তর, অন্যের সম্পত্তি বন্ধক দেয়ার ঘটনা ঘটেছে ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়, শাখা ও দুই কোম্পানির কর্মকর্তাদের সহায়তায়। এই অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ব্যাংক কর্মকর্তাদের শনাক্ত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে এবি ব্যাংকের এমডি শামীম আহমেদ চৌধুরীর কাছে চিঠি পাঠানো হয়েছে। চিঠিতে ঋণ আদায় না হলে এটি খেলাপি করে এর বিপরীতে প্রভিশন রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এই ঘটনার পর প্রত্যাহার করা হয়েছে ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপককে। দায়িত্ব নিয়েছেন নতুন ব্যবস্থাপক। এবি ব্যাংক সূত্র জানায়, তারা নিয়ম-কানুন মেনেই ঋণ দিয়েছে উত্তরা ট্রেডার্সকে। এর দায় তাদেরই। ফলে ঋণের টাকা উত্তরা ট্রেডার্সের কাছ থেকেই আদায় করা হবে। এ বিষয়ে জানার জন্য এবি ব্যাংকের এলিফ্যান্ট রোড শাখার ব্যবস্থাপক আরশাদ মাহমুদ খানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ বিষয়ে কোনো কিছুই বলতে চাননি। গ্রাহকের গোপনীয়তা রক্ষায় তিনি অঙ্গীকারবদ্ধ। এ বিষয়ে জানতে তিনি ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন। একই বিষয়ে বক্তব্য জানতে উত্তরা ট্রেডার্সের কর্ণধার গিরিধারী লাল মোদি গ্র“পের কার্যালয় মতিঝিলের রহমান চেম্বারে যোগাযোগ করে কথা বলার মতো কাউকে পাওয়া যায়নি। মহাখালীর অফিসে টেলিফোনে যোগাযোগ করেও তাদের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। টেলিফোনে হিসাব বিভাগের একজন কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে জানান, কোম্পানির কর্ণধার গিরিধারী লাল মোদি দেশে আছেন কিনা তা তিনি জানেন না। এ বিষয়ে তিনি কোনো কথা বলতেও নারাজ। অতি দ্রুততায় ঋণ : এলিফ্যান্ট রোড শাখায় উত্তরা ট্রেডার্সের নামে ২০১৩ সালের ২ জুলাই একটি চলতি হিসাব খোলা হয়। একই দিন ব্যাংকের কারওয়ানবাজার শাখায় নিউ ঢাকা ইন্ডাস্ট্রিজের নামে অপর একটি হিসাব খোলা হয়। এর একদিন আগে ১ জুলাই চলতি মূলধন হিসেবে ৭০ কোটি টাকা ঋণের জন্য শাখায় আবেদন করে উত্তরা ট্রেডার্স। হিসাব খোলার নয় দিন পর ১১ জুলাই শাখা থেকে ঋণ প্রস্তাব প্রধান কার্যালয়ে পাঠানো হয়। এর মাত্র দুই সপ্তাহ পর ২৫ জুলাই ব্যাংকের পর্ষদ ৫৫ কোটি টাকার ঋণ অনুমোদন করে। এর চার দিন পর ২৯ জুলাই শাখাকে ঋণ অনুমোদনের কথা জানানো হয়। শাখা থেকে ৩১ জুলাই ও ৫ আগস্ট দুটি চেকের মাধ্যমে সাড়ে ২৭ কোটি টাকা করে মোট ৫৫ কোটি টাকা ওই হিসাবে স্থানান্তর করে। ৩১ জুলাই স্থানান্তর হওয়া টাকার মধ্যে ১৭ কোটি টাকা এবি ব্যাংকের প্রিন্সিপাল শাখার মাধ্যমে কারওয়ানবাজার শাখায় নিউ ঢাকা ইন্ডাস্ট্রিজের হিসাবে এবং বাকি ১০ কোটি আইএফআইসি ব্যাংকের ধানমণ্ডি শাখা ঢাকা ইন্ডাস্ট্রিজের হিসাবে স্থানান্তর করা হয়। এছাড়া ৫ আগস্ট জমা হওয়া টাকা ওই দিন ও পরের দিন মোট দু’দিনে ৫টি চেকে ২৮ কোটি টাকা এবি ব্যাংকের প্রিন্সিপাল শাখার মাধ্যমে ঢাকা ইন্ডাস্ট্রিজের কারওয়ানবাজার শাখার হিসাবে স্থানান্তর করা হয়। এবি ব্যাংকের কারওয়ানবাজার শাখায় ঢাকা ইন্ডাস্ট্রিজের হিসাবে স্থানান্তর করা টাকা পুনরায় পাঠানো হয়েছে প্রিন্সিপাল শাখায়। ওই শাখা থেকে টাকা নগদ তুলে নেয়া হয়েছে। মাত্র ২৫ কার্য দিবসের মধ্যে এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে, যা অস্বাভাবিক মনে করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পরে উত্তরা ট্রেডার্স স্থানীয় ট্রেডিং ব্যবসা বাড়ানোর জন্য ২৫ আগস্ট আরও ২৫ কোটি টাকা চেয়ে আবেদন করে এলিফ্যান্ট রোড শাখায়। এর দু’দিন পর ২৭ আগস্ট শাখা থেকে প্রস্তাব পাঠানো হয় প্রধান কার্যালয়ে। এর দু’দিন পর ২৯ আগস্ট প্রধান কার্যালয় থেকে শাখায় পাঠানো হয় ঋণ মঞ্জুরিপত্র। কিন্তু এই ঋণ মঞ্জুরের আগে সিআইবির ছাড়পত্র নেয়া ও পর্ষদের অনুমোদন নেয়া হয়নি। পর্ষদের অনুমোদন ছাড়াই ব্যাংকের প্রধান কার্যায় থেকে শাখাকে ঋণ প্রদানের নির্দেশনা দেয়াতে প্রমাণিত হচ্ছে, এই জালিয়াতির সঙ্গে ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জড়িত। ওই অর্থ উত্তরা ট্রেডার্সের এলিফ্যান্ট রোড শাখার হিসাবে ২ সেপ্টেম্বর জমা করার পর ২, ৩ ও ৪ সেপ্টেম্বর তিনটি চেকের মাধ্যমে আবার প্রিন্সিপাল শাখায় স্থানান্তর করা হয়। ওখান থেকে কারওয়ানবাজার শাখায় ঢাকা ইন্ডাস্ট্রিজের হিসাবে স্থানান্তর করা হয়। ওই টাকা আবার প্রিন্সিপাল শাখায় স্থানান্তর করে নগদ তুলে নেয়া হয়। মাত্র ৮ কার্য দিবসে টাকা তুলে নেয়া হয়, যা অস্বাভাবিক মনে করা হচ্ছে। কেননা, ঋণের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতে কমপক্ষে ২/৩ মাস সময় লাগে। উত্তরা ট্রেডার্সের ঋণের টাকা তোলার পর গত ৩ অক্টোবর ঢাকা ইন্ডাস্ট্রিজের হিসাবটি বন্ধ করে দেয়া হয়। এর মাধ্যমে বেনামে ঋণ নেয়ার জন্যই ঢাকা ইন্ডাস্ট্রিজের নামে হিসাবটি খোলা হয়েছিল। ঋণের বিপরীতে জামানত হিসেবে বন্ধক রাখা সম্পত্তির মালিকানা উত্তরা গ্র“পের হাতে নেই। ওই সম্পত্তির মালিক ঢাকা ইন্ডাস্ট্রিজ। এর মাধ্যমে উত্তরা ট্রেডার্সের নাম ব্যবহার করে বেনামে ঋণ সুবিধা ভোগ করেছে ঢাকা ইন্ডাস্ট্রিজ। যেসব অনিয়ম : প্রচলিত নিয়মে হিসাব খোলার আগে শনাক্তকারীর মাধ্যমে গ্রাহকের পরিচয় নিশ্চিত হতে হবে। এছাড়া হিসাব খোলা যাবে না। এই ক্ষেত্রে গ্রাহকের পরিচয় নিশ্চিত না হয়েই হিসাব খোলা হয়েছে। হিসাব খোলার আগেই ঋণের জন্য আবেদনকারীর নামে ঋণ প্রস্তাব প্রধান কার্যালয়ে পাঠানো, ঋণ অনুমোদন এবং টাকা ছাড় করা হয়েছে। পর্ষদের অনুমোদন এবং হালনাগাদ ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরোর (সিআইবি) তথ্য ছাড়াই গ্রাহককে দেয়া হয়েছে সীমাতিরিক্ত ঋণ। প্রচলিত নিয়মে হালনাগাদ সিআইবির তথ্য ছাড়া ঋণ দেয়ার সুযোগ নেই। ঋণের টাকা ছাড়া অন্য কোনো লেনদেন না করেই হিসাব বন্ধ করা হয়েছে। ঋণের টাকা আদায় না হলেও ৮ কোটি ৩৯ লাখ টাকা সুদ আয় দেখানো হয়েছে। এর মাধ্যমে মুনাফা জালিয়াতি করে বেশি দেখানো হয়েছে শাখার আয়। ঋণ আদায় না হওয়ায় এটিকে খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়নি। ঋণের বিপরীতে বন্ধকি সম্পত্তি যথাযথভাবে যাচাই না করে ঋণ দেয়ার মাধ্যমে আর্থিক ঝুঁকি নিয়েছে ব্যাংক- যা সম্পূর্ণ বিধিবহির্ভূত। ঋণের প্রকৃত সুবিধাভোগীকে আড়াল করতে তিনটি শাখায় ঋণের টাকা স্থানান্তর করে নগদ তুলে নেয়া হয়েছে। এলিফ্যান্ট রোড শাখা থেকে ঋণের টাকা স্থানান্তর করা হয়েছে প্রিন্সিপাল শাখায়, ওখান থেকে কারওয়ানবাজার শাখায়। ওই শাখা থেকে আবার প্রিন্সিপাল শাখায়। এ শাখা থেকে নগদ তোলা হয়েছে। ব্যাংকিং ব্যবস্থায় এই ধরনের অহেতুক স্থানান্তর অসৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তিন এমডি অপসারিত হয়েছিল : উত্তরা ট্রেডার্সের মালিক গিরিধারী লাল মোদি। তার বিরুদ্ধে রয়েছে নানা ধরনের অভিযোগ। মুদ্রা পাচার ও হুন্ডি ব্যবসার মতো অভিযোগও আছে। দীর্ঘদিন ধরে তিনি গণমাধ্যমে আসেননি। সম্প্রতি এবি ব্যাংকে এক জালিয়াতির ঘটনায় তার নাম আবার উঠে এসেছে। ঘটনা জানার পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকও নড়েচড়ে বসেছে। তারা কঠোরভাবে তদারকি করছে। এর আগে ২০০২ সালে ব্যাংকিং খাতে বড় ধরনের এক কেলেংকারির সঙ্গে তার নাম জড়িত ছিল। ওই সময়ে ওম প্রকাশ আগারওয়াল ও গিরিধারী লাল মোদি নামের দুই ব্যক্তি তিনটি ব্যাংক থেকে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছিলেন। ওই ঘটনার পর প্রথমে দু’জনই উধাও হয়ে গিয়েছিলেন। পরে অবশ্য গিরিধারী লাল মোদি ফিরে এসেছেন। এখন তিনি দেশে ব্যবসা করছেন। ওই সময়ে এই ঘটনায় বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংক, ন্যাশনাল ক্রেডিট অ্যান্ড কমার্স (এনসিসি) ব্যাংক এবং ওয়ান ব্যাংকের তৎকালীন তিন এমডিকে একদিনেই অপসারণ করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এছাড়া প্রায় একডজন ব্যাংক কর্মকর্তা চাকরিচ্যুত হয়েছিল। ওই ঘটনায় জড়িত ব্যাংক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শাস্তি হলেও যারা এর সুবিধাভোগী ছিলেন তাদের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। উল্টো ওই আলোচিত কেলেংকারির নায়ক গিরিধারী লাল মোদি এবি ব্যাংকের প্রায় সাড়ে ৮৮ কোটি টাকা জালিয়াতি করে হাতিয়ে নিয়েছেন।
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment