মহাসড়কে বিপর্যয় ও কোরবানির পশুবাহী ট্রাকের কারণে মাত্রারিক্ত যানজটের আশঙ্কায় চাপ বেড়েছে রেলপথে। এ ছাড়া বাস মালিকদের কারসাজিতে বাসের প্রায় ৯০ শতাংশ টিকিট চলে যায় কালোবাজারিতে। এ জন্য অন্যান্যবারের চেয়ে এবারের ঈদে বিভিন্ন রুটের প্রতিটি ট্রেনেই যাত্রীর চাপ স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি। তবে সে তুলনায় রেলওয়ের আয়োজন একেবারেই অপ্রতুল। এ ছাড়া টিকিট বিক্রিতে কোটা, ভিআইপি যাত্রীদের চাপ ও কালোবাজির কারণে দুর্ভ
োগে পড়েছে সাধারণ যাত্রীরা। আসন্ন ঈদুল আজহা ও দুর্গাপূজা উপলক্ষে রেলওয়ে বিভাগের তথ্য অনুযায়ী প্রতিদিন ২০ হাজার টিকিট বিক্রি হচ্ছে কমলাপুর স্টেশনে। কমলাপুর রেলস্টেশনে টিকিট প্রত্যাশীরা এসে উপস্থিত হচ্ছেন এক দিন আগেই। টিকিটের জন্য রাতভর অপোর পর যাত্রীদের মুখে থাকে কান্তি আর উদ্বেগ। সকাল ৯টা থেকে শুরু হয় টিকিট বিক্রি। লাইনের শুরুতেই যারা থাকেন তারা টিকিট পেয়ে আনন্দ-উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেও হাজারো মানুষকে ফিরতে হচ্ছে খালি হাতে। এই ােভে অনেকে হইচই শুরু করেন স্টেশনে। পুলিশের হস্তেেপ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। গতকাল রোববারও ফুটে ওঠে একই চিত্র। এদিন টিকিট বিক্রি করতে সময় লেগেছে ট্রেন ভেদে মাত্র তিন থেকে পাঁচ ঘণ্টা। কিন্তু এই বিপুল টিকিট এত অল্প সময়ে কিভাবে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে এমন প্রশ্ন তুলে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন টিকিট না পাওয়া যাত্রীরা। সরেজমিন দেখা যায়, শনিবার ২ অক্টোবরের টিকিট বিক্রি শেষ হওয়ার পর থেকেই ৩ অক্টোবরের টিকিট নিতে আসা যাত্রীরা লাইনে দাঁড়ান। সকাল ৯টায় দেয়া হয় ৩ অক্টোবরের টিকিট। বেলা বাড়ার সাথে সাথে বাড়তে থাকে যাত্রীদের চাপ। বেলা ২টার মধ্যে ধূমকেতু, দ্রুতযান, সুন্দরবন এক্সপ্রেসসহ বেশির ভাগ ট্রেনের টিকিট শেষ হয়ে গেছে বলে কাউন্টার থেকে জানানো হয়। এ সময় ক্ষোভ প্রকাশ করে সেøাগান দেন যাত্রীরা। কাউন্টারে কর্মরত ব্যক্তি ব্যস্ত থাকছেন মোবাইলফোনে কথা বলা নিয়ে। কাউন্টারে সিরিয়ালে থাকা একজন যাত্রীর টিকিট প্রিন্ট দেয়ার সাথে সাথে আরেকটি টিকিট প্রিন্ট দিয়ে পকেটে ঢুকাচ্ছেন। এভাবে সিরিয়ালের একটা টিকিট ছাড়তে তিন থেকে ১০ মিনিট পর্যন্ত সময় লাগছে। যাত্রীদের অভিযোগ, প্রতিটি কাউন্টার থেকে যদি প্রতি ঘণ্টায় ৩০ জনকেও টিকিট দেয় তাহলে প্রতিজন চারটি করে টিকিট ক্রয় করলে ঘণ্টায় ১২০টি আসন বিক্রি হচ্ছে। ১৫টি কাউন্টার থেকে প্রতি ঘণ্টায় সর্বোচ্চ এক হাজার ৮০০ আসনের টিকিট বিক্রি করা যেতে পারে। এভাবে ২০ হাজার টিকিট বিক্রি করতে সময় লাগবে কমপক্ষে ১০ ঘণ্টা। কিন্তু কিভাবে তিন থেকে পাঁচ ঘণ্টায় এ পরিমাণ টিকিট বিক্রি সম্ভব হচ্ছে তা বোধগম্য নয়। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাই টিকিট কালোবাজারিতে জড়িত বলে অভিযোগ করেন যাত্রীরা। রেলওয়ে সূত্র মতে, ঈদ ও দুর্গাপূজা উপলে ঘরমুখো মানুষের সুবিধার্থে গত শুক্রবার থেকে ট্রেনের অগ্রিম টিকিট বিক্রি শুরু হয়েছে। ট্রেনের অগ্রিম টিকিট বিক্রি চলবে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। আজ ২৯ সেপ্টেম্বর পাওয়া যাবে ৪ অক্টোবরের টিকিট। পরের দিন ৩০ সেপ্টেম্বর পাওয়া যাবে ৫ অক্টোবরের টিকিট। ৩ অক্টোবর থেকে দেয়া হবে ফিরতি যাত্রার অগ্রিম টিকিট। ফিরতি টিকিটের যাত্রা শুরু হবে ঈদের (৬ সেপ্টেম্বর) দুই দিন পর থেকে। ঈদে ট্রেনের বাড়তি ১৩০টি বগি সংযোজন করা হচ্ছে। ঈদ উপলে ঢাকা-দেওয়ানগঞ্জ (জামালপুর), ঢাকা-পার্বতীপুর, চট্টগ্রাম-চাঁদপুর, ঢাকা-খুলনা এবং ঈদের দিন ভৈরব-শোলাকিয়া ও ময়মনসিংহ-শোলাকিয়ায় ট্রেনের বিশেষ সার্ভিস চালু হবে। নারী ও প্রতিবন্ধী কাউন্টারে দুর্ভোগ: নারী ও প্রতিবন্ধীদের জন্য রয়েছে একটি কাউন্টার। কিন্তু টিকিট ক্রয় করতে প্রতিদিন স্টেশনে আসা নারীদের সংখ্যা কম নয়। ফলে তাদের জন্য তুলনামূলক পর্যাপ্ত কাউন্টার না থাকায় সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন তারা। ঈশ্বরদীর টিকিট কাটতে আসা তিশা বলেন, মহিলা ও প্রতিবন্ধীদের জন্য একটি কাউন্টার রাখা হয়েছে। অথচ কাউন্টারে পুরুষের তুলনায় নারীরাও কম নয়। তাই টিকিট সংগ্রহে অনেক সময় লেগেছে। দুই বছরের সন্তানকে ফেলে এসে টিকিট ক্রয় খুব কষ্টের। তিনি আরো দুটি কাউন্টার নারীদের জন্য বরাদ্দ দেয়ার দাবি জানান। কোটায় খেয়ে ফেলছে টিকিট : প্রতিদিন কমলাপুর থেকে ২৮টি ট্রেনের অগ্রিম টিকিট বিক্রি হচ্ছে। এই ট্রেনগুলোর মোট আসন আছে ১৭ হাজার ৯০৩টি। ঈদ উপলক্ষে অতিরিক্ত বগি সংযোজন করে তা বেড়ে দাঁড়াবে প্রায় ২০ হাজার। এই আসনের ৩৫ ভাগই কোটার মাধ্যমে বিক্রি করা হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে মোবাইলে এসএমএসের মাধ্যমে ২৫ ভাগ, ভিআইপি কোটা পাঁচ ভাগ, কর্মকর্তা-কর্মচারী কোটা পাঁচ ভাগ। দেখা গেছে, ঈদে কমলাপুর থেকে রাজশাহীগামী সিল্কসিটি এক্সপ্রেস ট্রেনের মোট আসন ৬৬৪টি। এর মধ্যে এসি ৪০৪টি ও শোভন চেয়ার ২৬০টি। এই টিকিটের মধ্যে মোবাইলে এসএমএসের মাধ্যমে ২৫ ভাগ অর্থাৎ ১২১টি, ভিআইপি কোটা পাঁচ ভাগ অর্থাৎ ৩৩টি, কর্মকর্তা-কর্মচারী কোটা পাঁচ ভাগ অর্থাৎ ৩৩টি এবং রেগুলার কোটায় ৮৩টি। মোট ২৭০টি বিভিন্ন কোটায়। বাকি ৩৯৪টি টিকিট কাউন্টারে বিক্রি হবে। এর ফলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও টিকিট না পাওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করছেন যাত্রীরা। ভিআইপি সামাল দিতে ব্যস্ত রেল কর্তৃপক্ষ : ঈদ উপলক্ষে রেলওয়েতে ভিআইপিদের চাপ বেড়েই চলেছে। বাসের যানজটে দীর্ঘ সময় নষ্ট করার চেয়ে রেলে বাড়ি ফেরাতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন ভিআইপি যাত্রীরা। ফলে তাদের কোটার বাইরে অতিরিক্ত টিকিটের জন্য তদবির আসছে প্রতিদিনই। ভিআইপিদের এসব তদবিরে বিব্রত হয়ে পড়ছেন রেল কর্মকর্তারা। তার পরও নিজেদের পদ ঠিক রাখতে টিকিট দিতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। গত ঈদুল ফিতরের সময় টিকিট দিতে ব্যর্থ হওয়ায় বদলি করা হয়েছে কয়েকজন কর্মকর্তাকে। প্রতিদিনই অগ্রিম ১৭ হাজার ৯০৩টি টিকিট বিক্রি করছে রেল কর্তৃপ। ২৮টি ট্রেনের মধ্যে এসিতে বার্থের ৪০৪টি আসন এর পাঁচ শতাংশ (২০টি) ভিআইপিদের সংরতি। একইভাবে এসি চেয়ার আছে এক হাজার ৩৯৮টি। যার মধ্যে ভিআইপিদের জন্য সংরক্ষিত ৭০টি। প্রথম শ্রেণীর ঘুমানোর কিংবা বসার আসন (নন-এসি) ৫৫৪টির মধ্যে ২৮টি। বিশেষ ধরনের ৪৪২টি প্রথম শ্রেণীর আসনের মধ্যে ২২টি আসন। আর শোভন চেয়ার ও শোভন মিলে আসন ১৫ হাজার ৫০টির পাঁচ ভাগ ৭৫৩টি আসন। সব মিলিয়ে ভিআইপিদের জন্য এক দিনে ৮৯৩টি টিকিট রয়েছে। কিন্তু ঈদের আগে ভিআইপিদের টিকিটের চাহিদা আরো অনেক বেশি বলে জানান রেল কর্মকর্তারা। আবার অনেক ভিআইপি শোভন চেয়ার বা শোভন শ্রেণীর কোনো টিকিট নেন না। তাদের সব চাহিদা এসি ও ঘুমানোর আসনের। ভিআইপিদের জন্য রতি পাঁচ শতাংশের মধ্যে এসি, ঘুমানো আর প্রথম শ্রেণীর সব টিকিটের অনুপাতে বরাদ্দ মাত্র ১৪০টি। কিন্তু প্রতিদিন গড়ে ৫০০টি উচ্চ শ্রেণীর আসন ভিআইপিদের দিতে হয়। এর বাইরে সাধারণ শ্রেণীর টিকিটও নেন সহস্রাধিক। টিকিট দিতে ধীর গতি, যাত্রীদের ােভ : কাউন্টার থেকে ধীর গতিতে টিকিট বিক্রি হচ্ছে এমন অভিযোগ করছেন টিকিট প্রত্যাশীরা। এ জন্য তারা কাউন্টার মাস্টারদেরই দায়ী করেন। লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট সংগ্রহকারীরা জানিয়েছেন, টিকিট চাওয়ার পর টিকিট পেতে তিন থেকে ১০ মিনিট পর্যন্ত সময় লেগেছে। এর কারণ হলো কাউন্টারের সার্ভার ধীরগতির। এ ছাড়া সাধারণ যাত্রীদের টিকিট দেয়ার পাশাপাশি কাউন্টারের ভেতরে আসা তদবিরকারীদের টিকিট দিচ্ছে। এ জন্য সময় বেশি লাগছে। এ ছাড়া লাইনে না দাঁড়িয়ে টিকিট নেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। লাইনের সামনে গিয়ে কর্তব্যরত আনসারদের সাথে আঁতাত করে টিকিট কালোবাজারি করছেন অনেকেই। সক্রিয় কালোবাজারি চক্র : কমলাপুর রেলস্টেশনে সারা বছরই সক্রিয় থাকে কালোবাজারি চক্র। গতকাল কমলাপুর থেকে কালোবাজারি সন্দেহে একজনকে আটক করে রেলওয়ে পুলিশ। সূত্র জানায়, কালোবাজারি চক্রের সদস্যরা মোবাইলে এসএমএসের মাধ্যমে টিকিট বুকিং দিয়ে পাওয়া টিকিট তারা কিছু বেশি দামে বিক্রি করে দেয়। এ ছাড়া কাউন্টারের সেলসম্যানের সাথে আগে থেকে চুক্তি থাকে। চুক্তি অনুযায়ী টিকিট চাইলে চারটি আসনের পরিবর্তে তাদের চুক্তি অনুযায়ী ১৫-২০টি টিকিট দেয়া হয়। বাড়তি দামে বিক্রি থেকে টাকা ভাগাভাগি করে নেয় তারা। অনলাইন মোবাইলেও বিড়ম্বনা : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের ছাত্র আসিফ। তিনি ঈদে গ্রামের বাড়ি রাজশাহীতে ফিরতে মোবাইলে রেলের টিকিট ক্রয়ের চেষ্টা করেন। বারবার তার মোবাইলে ভেসে ওঠে ‘সার্ভার ইরর’ বিষয়টি নিয়ে তিনি গ্রামীণফোনের কাস্টমার কেয়ারে যোগাযোগ করলে সেখান থেকে জানানো হয়, এটি রেলওয়ের সার্ভারের সমস্যা। এখানে আমাদের কিছু করার নেই। এরপর তিনি রেলবিভাগের ওয়েবসাইট ই-সেবায় চেষ্টা করেন। কিন্তু সেখানেও ব্যর্থ হয়ে স্টেশনে এসে টিকিটের জন্য লাইনে দাঁড়ান। মতিঝিলের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত পার্থ বলেন, অনলাইনে তিন ঘণ্টা ধরে টিকিট ক্রয়ের চেষ্টা করেও ওয়েবসাইটে অ্যাকসেস পাইনি। পরে যখন অ্যাকসেস পেয়েছি তখন বলা হচ্ছে, ‘মোবাইল কোটায় কোনো আসন নেই।’
No comments:
Post a Comment