Monday, September 1, 2014

খেলা বন্ধ, স্থবির রংপুরের ক্রীড়াঙ্গন:প্রথম অালো

মৃদুমন্দ হাওয়ায় মাথা দোলাচ্ছে নিবিড় কাশগুচ্ছ। অচিরেই ছেয়ে যাবে শুভ্র ফুলে। আকাশে ছেঁড়া ছেঁড়া সাদা মেঘের টুকরা। শরৎকালের চিরচেনা এই দৃশ্য কোনো নদীতীরের নয়। রংপুর স্টেডিয়ামের। গত ছয় বছর এই স্টেডিয়ামে ফুটবল গড়ায়নি। দুই বছর হতে চলল বন্ধ ক্রিকেট লিগ। ভলিবল লীগ হয় না ১০ বছর। শেষবার হ্যান্ডবল লিগ হয়েছে তিন বছর আগে। আর সাত বছর পেরিয়ে গেছে শেষ কাবাডি লিগের পর। খেলাধুলা বন্ধ। স্থবির হয়ে পড়ে
ছে রংপুরের ক্রীড়াঙ্গন। রংপুরের ক্রীড়াঙ্গনের আছে গৌরবময় অতীত। সোনালি সময় ছিল এককালে। এখান থেকে উঠে আসা জাতীয় পর্যায়ে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখা ক্রীড়াবিদদের তালিকা দীর্ঘ। ফুটবলে জাতীয় পর্যায়ের খেলোয়াড়দের মধ্যে ছিলেন কাজী আনোয়ার, কাজী সাত্তার, রহমান সান্টু, কোহিনুর, মোছাব্বের, মাসুদার রহমান স্বপন, এ কে এম নাজমুল হক মন্টুসহ অনেকে। ভলিবলে রফিকুল হক, বাবু কামাল, রাজু আহমেদ, মশিউর, জাতীয় দলের দলনায়কসহ অনেকেই ছিলেন রংপুরের। মহিলা হ্যান্ডবলে জাতীয় দলে একচেটিয়া ছিল রংপুরের নারীদের প্রধান্য। নব্বইয়ের দশকে জাতীয় দলে ময়না, লিমা, কাকলী, শান্তা, ইরিনা, কলি, রাশেদা—এই সাতজন ছিলেন রংপুরের। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে জাতীয় দলে ছিলেন হিরা, রোজিসহ অনেকে। শিরিন, আজমেরী, ময়না, লিমা ও হিরা খেলেছেন জাতীয় মহিলা ভলিবল দলে। ক্রিকেটে এখন জাতীয় দলে রয়েছেন নাসির হোসেন। বিভিন্ন সময়ে জাতীয় দলে ও ঢাকার লিগে খেলেছেন সোহরাওয়ার্দী শুভ, আরিফুল হক, আলাউদ্দিন বাবু, শহিদুল ইসলামরা। রংপুর থেকে উঠে আসা কৃতী ক্রীড়াবিদদের দীর্ঘ তালিকাটি হঠাৎ করেই যেন বন্ধ হয়ে গেছে। নতুন প্রজন্মের আর কোনো সম্ভাবনাময় খেলোয়াড় তৈরি হচ্ছে না এখান থেকে। একটা সময় বছরজুড়ে ফুটবল, ক্রিকেট, ভলিবল, হ্যান্ডবলসহ বিভিন্ন লিগে মুখর থাকত রংপুরের ক্রীড়াঙ্গন। সেখান থেকে উঠে আসতেন প্রতিভাবান খেলোয়াড়েরা। সেই চর্চা বন্ধ হওয়ায় হতাশা নেমে এসেছে স্থানীয় খেলোয়াড়, ক্রীড়া সংগঠক ও ক্রীড়ামোদী জনতার মধ্যে। রংপুরের বিভিন্ন পর্যায়ের ক্রীড়াবিদ, সংগঠক ও জেলা ক্রীড়া সংস্থার কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে দেখা গেল, এখানে খেলাধুলার অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধার বিশেষ ঘাটতি নেই। বড় আয়োজন হলে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার প্রতিষ্ঠানও আছে যথেষ্ট। মোটা অঙ্কের টাকা জমা জেলা ক্রীড়া সংস্থার তহবিলে। অভাব কেবল উদ্যোগের। জেলা ও বিভাগীয় ক্রিকেট আম্পায়ার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক জিয়াউর রহমান, ক্রীড়া সংগঠক ও জেলা ক্রীড় সংস্থার (ডিএসএ) দীর্ঘ দিনের সদস্য শুভ রঞ্জন দেব, ডিএসএর বর্তমান যুগ্ম সম্পাদক শামসুল আলম, প্রিমিয়ার লীগের ক্রিকেটার আলাউদ্দিন বাবুসহ অনেকেই ক্ষোভের সঙ্গে জানালেন, একেবারেই অথর্ব নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে ডিএসএ। জেলায় প্রথম বিভাগের ফুটবল দল ১৫টি। ডিএসএর আয়োজনে শেষ প্রথম বিভাগ লিগ হয়েছে ২০০৫ সালে। ডিএসএ থেকে ২০০৭ সালে ফুটবলকে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বিএফএ) আওতায় আনার পরের বছর একবারই লিগ হয়েছে তাদের উদ্যোগে। এরপর জেলা বা বিভাগীয় পর্যায়ের ফুটবলের বড় কোনো আয়োজনই হয়নি। বলতে গেল টানা ছয় বছরে বড় কোনো ফুটবল লিগই হয়নি। খুবই বাজে অবস্থা জেলায় ভলিবলের। জেলায় দল ১২টি। সর্বশেষ লিগ ২০০৪ সালে, আগের লিগ হয়েছিল ১৯৯৮ সালে। মহিলা ও পুরুষের আটটি করে হ্যান্ডবল দল ১৮টি। সর্বশেষ দুটি লিগ হয়েছে ২০১০ ও ২০১২ সালে। রংপুরে ক্রিকেট দলের সংখ্যাই বেশি। প্রথম বিভাগের দল ২৭টি। এ ছাড়া বাছাইপর্বের ৪০টি। নগরে ক্রিকেট স্টেডিয়াম না থাকলেও ‘ক্রিকেট গার্ডেন’ নামে যে মাঠটি ক্রিকেটের জন্য বরাদ্দ, সেখানে সব সুবিধাই আছে। ড্রেসিংরুম, তিনটি ম্যাচ উইকেট, চারটি অনুশীলনের উইকেট আছে। কিন্তু লিগ হয় না। শেষ দুটি লিগ হয়েছে ২০০৯ ও ২০১২ সলে। প্রতিবছর একটি বাছাই লিগসহ প্রিমিয়ার, প্রথম বিভাগ ও দ্বিতীয় বিভাগ—এই চারটি নিয়মিত লিগ হওয়ার কথা। প্রথম বিভাগের প্রতিটি দলে ২০ জন ও বাছাইপর্বে ১৫ জন খেলোয়াড় নিবন্ধিত রয়েছেন। শুধু নিবন্ধিত ক্রিকেটারের সংখ্যাই এগারো শতাধিক। তাঁরা বলতে গেলে বেকার সময় কাটাচ্ছেন। নিবন্ধিত কাবাডির দল ১২টি। শেষ লিগ হয়েছে ২০০৭ সালে। নিয়ম অনুসারে জেলা ক্রীড়া সংস্থার প্রতিবছর ফুটবল, ক্রিকেট, ভলিবল, হ্যান্ডবল ও কাবাডি—এই পাঁচটি নিয়মিত লীগ হওয়ার কথা। রংপুরে এই পাঁচ খেলার নিবন্ধিত দল ৮২। নিবন্ধিত খেলোয়াড় দুই হাজারের মতো। আপাতত তাঁরা মাঠের বাইরে। দিন যাচ্ছে হতাশায়। নির্ধারিত এই পাঁচটি খেলা ছাড়া ডিএসএগুলোর সুযোগ-সুবিধা অনুসারে সাঁতার, দাবা, হকি, কুস্তি, জিমন্যাস্টিক ও অ্যাথলেটিক্সের প্রতিযোগিতা আয়োজন করার কথা। মূল লিগগুলোই যেখানে হয় না, সেখানে অতিরিক্তগুলোর অবস্থা কেমন, তা সহজেই অনুমেয়। ক্রীড়া প্রতিযোগিতা আয়োজনের উদ্যোগহীনতার পাশাপাশি ডিএসএর সাংগঠনিক কার্যক্রমও স্থবির বলে অভিযোগ উঠেছে। নিয়মিত বিরতিতে নির্বাহী কমিটির সভা হওয়ার কথা। বছরে অন্তত একটি সাধারণ সভা হওয়ার নিয়ম। কিছুই হচ্ছে না। উপরন্তু এবার বয়সভিত্তিক মহিলা হ্যান্ডবল দলটি বিভাগীয় পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হয়ে জাতীয় দলে অংশ নেওয়ার সুযোগ পোলেও প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ না করায় তারা জাতীয় পর্যায়ে অংশ নিতে পারেনি। সর্বশেষ এ বিষয়টি খুবই ক্ষোভ ও হতাশার সৃষ্টি করেছে জেলার ক্রীড়াঙ্গনে। এসব অভিযোগ সম্পর্কে ডিএসএর সাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুল ইসলাম প্রথম আলোকে জানান, বিভিন্ন কারণে অনেক দিন থেকেই রংপুরের ক্রীড়াঙ্গনে সাময়িকভাবে কিছুটা মন্থরতার সৃষ্টি হয়েছে। তিনি নতুন দায়িত্ব নিয়েছেন। এই মন্থরতা কাটিয়ে ওঠার জন্য ব্যাপক কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। ফুটবল লিগ দিয়েই ক্রীড়াঙ্গনকে চাঙা করে তোলা হবে। সাংগঠনিক কার্যক্রমের স্থবিরতা প্রসঙ্গে আনোয়ারুল ইসলাম জানান, গত ২২ আগস্ট একটি সাধারণ সভা হওয়ার কথা ছিল। ডিএসএর কোষাধ্যক্ষ হজে যাওয়ায় তা হয়নি। তিনি ফিরলেই সাধারণ সভা হবে। আর অনূর্ধ্ব ১৯ বয়সভিত্তিক দলটির জাতীয় পর্যায়ে অংশগ্রহণের জন্য ৬০ হাজার টাকা চাওয়া হয়েছিল। ডিএসএর সভাপতি জেলা প্রাশাসক ১৫ হাজার টাকা বরাদ্দ করেন। এ ছাড়া তিনি নিজে অতিরিক্ত পাঁচ হাজার টাকা দিতে চেয়েছিলেন। তবে এই টাকায় দল নিয়ে ঢাকায় যেতে ফেডারেশন রাজি হয়নি। রংপুর ডিএসএর তহবিলে এখন ২৫ লাখ টাকা মজুত রয়েছে বলে তিনি জানান।

No comments:

Post a Comment