Thursday, September 18, 2014

বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে:নয়াদিগন্ত

‘সংবিধান (ষোড়শ সংশোধন) বিল-২০১৪’ সংসদীয় কমিটির সুপারিশ আকারে গত রাতে সংসদে পাস হয়েছে। এই সংশোধনী বিলটি আইনে পরিণত হওয়ার মধ্য দিয়ে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা আবারো সংসদের কাছে ফিরে আসবে।  ’৭২-এর সংবিধানেও এই ক্ষমতা সংসদের হাতে ছিল। পরে তা সংশোধন করে প্রথমে রাষ্ট্রপতি এবং পরে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাছে ন্যস্ত করা হয়েছিল। মূলত বর্তমান সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে ’৭২-এর সংবিধানের সেই বিধা
নই হুবহু ফিরিয়ে আনা হলো। বিলটির ওপর জনমত যাচাই ও বাছাই কমিটিতে প্রেরণ এবং কিছু সংশোধনীর জন্য জাতীয় পার্টির সদস্যরা প্রস্তাব আনলেও বিলটিকে তারা সমর্থন করেন এবং বিলটির পক্ষে ভোট দেন।  সংসদের কার্যপ্রণালী অনুযায়ী প্রথমে বিলের দফাগুলো ও বিলটি কণ্ঠভোটে পাস হয় এবং বিধি ৯৯ (গ) অনুুযায়ী দুই দফায় বিভক্তি ভোট হয়। প্রথমে দফার ওপর বিভক্তি ভোটের পক্ষে হ্যাঁ ভোট পড়ে ৩২৮টি। বিপক্ষে কোনো না ভোট পড়েনি। এরপর বিলটি পাসের প্রস্তাবের পক্ষে কণ্ঠভোট হয়। কণ্ঠভোটের পর লবিতে গিয়ে সংসদ সদস্যরা আবার ভোট দেন। এতে বিল পাসের পক্ষে হ্যাঁ ভোট পড়ে ৩২৭টি এবং কোনো না ভোট পড়েনি। বিলটি পাসের পুরো প্রক্রিয়া শেষ হতে সময় লাগে সাড়ে তিন ঘণ্টা। সন্ধ্যা ৭টা ৪০ মিনিটে শুরু হয়ে রাত ১১টা ১০ মিনিটে বিলটি পাস হয় এর আগে বিলটির ওপর জনমত যাচাই ও সেটি বাছাই কমিটিতে প্রেরণের ১৩টি প্রস্তাব এবং বিলটির দু’টি দফায় সংশোধনীর ৩০টি প্রস্তাব সংসদে কণ্ঠভোটে নাকচ হয়ে যায়।।  বিলটি পাসের আগে আইনমন্ত্রী বলেন, বিলটি সংসদে উত্থাপন ও পাসের ব্যাপারে কেউ বিরোধিতা করেননি। তবে অনেকের আপত্তি এই সংসদে বিলটি পাস করা নিয়ে। মন্ত্রী বলেন, যারা এই সংসদে এটি পাস নিয়ে আপত্তি করেন আমি তাদেরকে বলব, আমি এই সংসদে বিলটি পাসের পক্ষে ১০১টি কারণ বলতে পারব। তার মধ্যে একটি হচ্ছে এই সংসদ সংবিধান অনুযায়ী জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সংসদ। সুতরাং আমরা এই সংসদে বিলটি পাস করতে পারি।  গতকাল সন্ধ্যার পর সংসদের বৈঠক শুরু হলে প্রথমে প্রধানমন্ত্রীর জন্য নির্ধারিত প্রশ্নোত্তর পর্ব অনুষ্ঠিত হয়। এরপরই দিনের অন্যান্য কর্মসূচি স্থগিত করে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী বিল পাসের প্রক্রিয়ায় চলে যান। আইনমন্ত্রী আইনটি বিবেচনার প্রস্তাব উত্থাপন করেন। বিলটির ওপর আনীত জনমত যাচাই ও বাছাই কমিটিতে প্রেরণের জন্য জাতীয় পার্টি ও স্বতন্ত্র সদস্যদের মধ্য থেকে ১৩টি নোটিশ দেন। তারা বিলটিকে অতীব গুরুত্বপূর্ণ এবং অধিকারের সাথে জড়িত আখ্যায়িত করে তড়িঘড়ি না করে সবার সাথে আলোচনা করে পাস করার পক্ষে বক্তব্য রাখেন।  আলোচনায় অংশ নিয়ে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বলেন, বিলটা স্পর্শকাতর। পাস হলে স্বাধীন বিচারব্যবস্থার ওপর হস্তক্ষেপ হবে কি না দেখার বিষয়। বিচার আদালতের ব্যাপারে আমার অভিজ্ঞতা অনেক বেশি। ৭৪টি মামলা আমার বিরুদ্ধে। আমি ন্যায়বিচার পাইনি। স্বতন্ত্র সদস্য রুস্তম আলী ফরাজী বলেন, এটি গুরুত্বপূর্ণ বিল তাই আলোচনা করার দরকার ছিল। যারা সংবিধান প্রণয়ন করলেন তারা এর বিরোধিতা করলেন। মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। অপসারণের বড় কথা নয়, নিয়োগের নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। জাতীয় পার্টির রওশন আরা মান্নান বলেন, জনগণের মনে সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে। জনকল্যাণের জন্য হলে এটার জন্য আরো সময় দেয়া প্রয়োজন। সময় অনেক কিছু শিক্ষা দেয়। কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, বিলটি নিয়ে যাতে কোনো কথা না ওঠে সে জন্য সময় নিয়ে এটা পাস করা উচিত। কেউ ভুলের ঊর্ধ্বে নয়। এম এ হানান্ন বলেন, বিলটি সাংবিধানিক। তড়িঘড়ি করলে মানুষের অধিকার ক্ষুণœ হওয়ার সম্ভাবনা আছে। এরপর আইনমন্ত্রী বক্তব্য রাখেন এবং তিনি প্রস্তাবগুলো নাকচ করে দিলে সেগুলো কণ্ঠভোটে নাকচ হয়ে যায়। তবে সংসদের মাইক বিভ্রাটের কারণে সাংবাদিক গ্যালারিতে এবং টেলিভিশন ও বেতারে কার্যধারা শোনা যায়নি।  বিলটির দফা-১ ও দফা-২ এ ৩০টি সংশোধনী আনেন বেশ কয়েকজন সদস্য। অনেকে জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে তদন্তের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব দেন। একই সাথে বিচারক নিয়োগের নীতিমালা করারও প্রস্তাব করেন।  দফা-১ এ তিনজন সদস্য সংশোধনী আনেন। স্বতন্ত্র সদস্য রুস্তম আলী ফরাজী ৯৬ অনুচ্ছেদের (১) এর পরিবর্তে নতুন দফা (১) প্রতিস্থাপনের প্রস্তাব করেন এবং তাতে বিচারকের অবসরের বয়স ৭০ বছর করার কথা সংযুক্ত করেন। বাকি দু’জন সদস্য হাজী মো: সেলিম ও এম এ হান্নান দফা-১ এর শিরোনামের পর উপদফা-২ সংযুক্ত করে ‘ ইহা অবিলম্বে কার্যকর হবে’ যুক্ত করার প্রস্তাব করেন।  বিলের দফা-২য় আনীত সংশোধনীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোÑ রুস্তম আলী ফরাজী দফায় বিচারকের বিরুদ্ধে অভিযোগ সংসদে উত্থাপিত হলে এবং তা ১০০ জন সদস্য সমর্থন করলে প্রস্তাবটি সংসদ কর্তৃক গঠিত ‘জাজেস ইনকোয়ারি কমিশনে’ প্রেরণের বিধান যুক্ত করার প্রস্তাব করেন।  কাজী ফিরোজ রশীদ চৌধুরী উপদফা-১ প্রমাণিত শব্দের পরিবর্তে ‘জুডিশিয়াল ইনভেস্টিগেশন কাউন্সিল দ্বারা’ শব্দাবলি যুক্ত করার প্রস্তাব করেন।  এম এ হান্নান প্রমাণিত শব্দের পরিবর্তে ‘উপদফা-৩ এর অধীন প্রমাণিত’ শব্দাবলি যুক্ত করার প্রস্তাব করেন। একই ধরনের প্রস্তাব করেন আরো কয়েকজন সদস্য।  নুরুল ইসলাম মিলন দফা-২ এ সংসদের মোট সদস্যের তিন- চতুর্থাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার দ্বারা সমর্থিত সংসদের প্রস্তাবক্রমে বিচারপতির অপসারণের বিধানের প্রস্তাব করেন।  কয়েকজন সদস্য অসদাচরণ ও অসামর্থ্যদের পরিবর্তে ‘অসদাচরণ, অদক্ষতা, শারীরিক ও মানসিক অসামর্থ্যরে কারণে’ শব্দাবলি সন্নিবেশিত করার প্রস্তাব করেন।  ফজলে হোসেন বাদশা উপদফা-৩ এ ‘নিয়ন্ত্রণ করিতে পারিবেন’ শব্দাবলির পরে ‘একই সঙ্গে সংসদ বিচারক নিয়োগের নীতিমালা প্রণয়ন করতে পারিবেন’ শব্দাবলীয় সন্নিবেশ করার প্রস্তাব করেন। একই ধরনের শব্দাবলীয় সন্নিবেশ করার প্রস্তাব করেন আরো কয়েকজন সদস্য।  সংশোধনী প্রস্তাবের ওপর সদস্যরা বক্তব্য রাখেন। তবে আইনমন্ত্রী আনিসুল একটি সংশোধনী প্রস্তাবও গ্রহণ করেননি। পরে কণ্ঠভোটে সংশোধনী প্রস্তাবগুলো নাকচ হয়ে যায়। আইনমন্ত্রী সংশোধনী প্রস্তাবের জবাব দিতে দিয়ে বিচারপতিদের অপসারণের ব্যাপারে সংবিধানের ইতঃপূর্বেকার বিভিন্ন বিধানের কথা উল্লেখ করে বক্তব্য রাখেন। সংশোধনীর ওপর আলোচনা ও সংশোধনীগুলো নিষ্পত্তির পর কণ্ঠভোটের সাথে সাথে বিভক্তি ভোটের মাধ্যমে বিলটি পাসের প্রক্রিয়া শুরু হয়। সংসদ সদস্যরা লবিতে রাখা ব্যালটে স্বারের মাধ্যমেও ভোট দেন। পরে স্পিকার ভোটের ফলাফল ঘোষণা করেন।  বিদ্যমান সংবিধানে বিচারপতিদের অপসারণের জন্য সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে তদন্ত করার বিধান রয়েছে। এখন সংশোধনী বিল পাস হওয়ার পর এটি আইনে পরিণত হলে এ সংক্রান্ত একটি সহায়ক আইন পাস হবে। এই আইনে কোনো বিচারপতির অসদাচরণ বা অসামর্থ্যরে জন্য তদন্ত কমিটি গঠনের বিধান করা হবে। তদন্ত কমিটিতে কারা বা কতজন থাকবে তা-ও আইনে নির্ধারণ করা হবে। কমিটি কাউকে দোষী সাব্যস্ত করে সংসদে রিপোর্ট দেয়ার পর সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে তা অনুমোদিত হলে অভিযুক্ত বিচারপতিকে অপসারণের জন্য সংসদ থেকে তা রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো হবে। রাষ্ট্রপতিই অপসারণের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেবেন।  গত ৭ সেপ্টেম্বর আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বিলটি সংসদে উত্থাপন করেন। পরে সাত দিনের মধ্যে রিপোর্ট দেয়ার জন্য সংসদীয় কমিটিতে পাঠানো হয়। কমিটি গত ৯ ও ১০ সেপ্টেম্বর বৈঠকে বসে বিলটি চূড়ান্ত করে গত রোববার সংসদে রিপোর্ট দেয়। বিলটি পাসের তিন মাসের মধ্যে সহায়ক আইন পাস হবে বলে ইতোমধ্যেই আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জানিয়েছেন।  আওয়ামী লীগ সরকার তার আগের মেয়াদে ২০১১ সালে সংবিধানের মূলনীতিসহ অন্যান্য অনুচ্ছেদে ব্যাপক প্রতিস্থাপন ও পরিবর্তন এনে ‘সংবিধান (পঞ্চদশ) সংশোধন’ বিল পাস করে।  বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে ১৯৭২ সালের সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের দফা ২, ৩ ও ৪ পুনঃস্থাপন করেই সংবিধান (ষোড়শ সংশোধন) বিলটি আনা হয়।  বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে ১৯৭২ সালের সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের দফা ২, ৩ ও ৪ পুনঃস্থাপন করা হলো।  বিলের দফা ২ এ বলা হয়েছে “২। সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের সংশোধন। --গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের দফা (২), (৩), (৪), (৫), (৬), (৭), (৮) এর পরিবর্তে নি¤œরূপে দফা (২), (৩), (৪) প্রতিস্থাপিত হইবে, যথা:...” (২) প্রমাণিত অসদাচরণ বা অসামর্থ্যরে কারণে সংসদের মোট সদস্য সংখ্যার অন্যূন দুই-তৃতীয়াংশ গরিষ্ঠতার দ্বারা সমর্থিত সংসদের প্রস্তাবক্রমে প্রদত্ত রাষ্ট্রপতির আদেশ ব্যতীত কোনো বিচারককে অপসারিত করা যাইবে না।  (৩) এই অনুচ্ছেদের (২) দফার অধীন প্রস্তাব সম্পর্কিত পদ্ধতি এবং কোনো বিচারকের অসদাচরণ বা অসামর্থ্য সম্পর্কে তদন্ত ও প্রমাণের পদ্ধতি সংসদ আইনের দ্বারা নিরূপণ করিতে পারিবেন। (৪) কোনো বিচারক রাষ্ট্রপতিকে উদ্দেশ করিয়া স্বাক্ষরযুক্ত পত্রযোগে স্বীয় পদত্যাগ করিতে পারিবেন।” সংশোধনের আগে সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদে যা ছিল বর্তমান সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের এই সংক্রান্ত বিধানটি নি¤œরূপ : “৯৬। (১) এই অনুচ্ছেদের অন্যান্য বিধানাবলী সাপেে কোন বিচারক সাতষট্টি বৎসর বয়স পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত স্বীয় পদে বহাল থাকিবেন। (২) এই অনুচ্ছেদের নি¤œরূপ বিধানাবলী অনুযায়ী ব্যতীত কোন বিচারককে তাঁহার পদ হইতে অপসারিত করা যাইবে না।  (৩) একটি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল থাকিবে যাহা এই অনুচ্ছেদে ‘‘কাউন্সিল’’ বলিয়া উল্লেখিত হইবে এবং বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি এবং অন্যান্য বিচারকের মধ্যে পরবর্তী যে দুইজন কর্মে প্রবীণ তাঁহাদের লইয়া গঠিত হইবে : তবে শর্ত থাকে যে, কাউন্সিল যদি কোন সময়ে কাউন্সিলের সদস্য এইরূপ কোন বিচারকের সামর্থ্য বা আচরণ সম্পর্কে তদন্ত করেন, অথবা কাউন্সিলের কোনো সদস্য যদি অনুপস্থিত থাকেন অথবা অসুস্থতা কিংবা অন্য কোনো কারণে কার্য করিতে অসমর্থ হন তাহা হইলে কাউন্সিলের যাহারা সদস্য আছেন তাঁহাদের পরবর্তী যে বিচারক কর্মে প্রবীণ তিনিই অনুরূপ সদস্য হিসাবে কার্য করিবেন।  (৪) কাউন্সিলের দায়িত্ব হইবেÑ (ক) বিচারকগণের জন্য পালনীয় আচরণ বিধি নির্ধারণ করা; এবং (খ) কোন বিচারকের অথবা কোন বিচারক যেরূপ পদ্ধতিতে অপসারিত হইতে পারেন সেইরূপ পদ্ধতি ব্যতীত তাঁহার পদ হইতে অপসারণযোগ্য নহেন এইরূপ অন্য কোন পদে আসীন ব্যক্তির সামর্থ্য বা আচরণ সম্পর্কে তদন্ত করা। (৫) যে েেত্র কাউন্সিল অথবা অন্য কোন সূত্র হইতে প্রাপ্ত তথ্যে রাষ্ট্রপতির এইরূপ বুঝিবার কারণ থাকে যে কোন বিচারকÑ (ক) শারীরিক বা মানসিক অসামর্থ্যরে কারণে তাঁহার পদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করিতে অযোগ্য হইয়া পড়িতে পারেন, অথবা (খ) গুরুতর অসদাচরণের জন্য দোষী হইতে পারেন, সেইেেত্র রাষ্ট্রপতি কাউন্সিলকে বিষয়টি সম্পর্কে তদন্ত করিতে ও উহার তদন্ত ফল জ্ঞাপন করিবার জন্য নির্দেশ দিতে পারেন। (৬) কাউন্সিল তদন্ত করিবার পর রাষ্ট্রপতির নিকট যদি এইরূপ রিপোর্ট করেন যে, উহার মতে উক্ত বিচারক তাঁহার পদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালনে অযোগ্য হইয়া পড়িয়াছেন অথবা গুরুতর অসদাচরণের জন্য দোষী হইয়াছেন তাহা হইলে রাষ্ট্রপতি আদেশের দ্বারা উক্ত বিচারককে তাঁহার পদ হইতে অপসারিত করিবেন।  (৭) এই অনুচ্ছেদের অধীনে তদন্তের উদ্দেশ্যে কাউন্সিল স্বীয় কার্য-পদ্ধতি নিয়ন্ত্রণ করিবেন এবং পরওয়ানা জারি ও নির্বাহের ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টের ন্যায় উহার একই মতা থাকিবে।  (৮) কোন বিচারক রাষ্ট্রপতিকে উদ্দেশ্য করিয়া স্বারযুক্ত পত্রযোগে স্বীয় পদ ত্যাগ করিতে পারিবেন।” ষোড়শ সংশোধনের উদ্দেশ্য ও কারণ বিলে উল্লেখিত উদ্দেশ্য ও কারণ সম্বলিত বিবৃতিতে বলা হয়েছে-গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সংবিধানের প্রস্তাবনা, ৭ ও ১১ অনুচ্ছেদ এর বিধান অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ এবং তাহাদের পক্ষে এ ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হইবে। ইহার প্রতিফলনে ১৯৭২ সনে প্রণীত সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদে সুপ্রিম কোর্টের কোন বিচারককে তাঁহার বিরুদ্ধে প্রমাণিত অসদাচারণ বা অসামর্থ্যরে কারণে সংসদের মোট সদস্য সংখ্যার অন্যূন দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার দ্বারা সমর্থিত সংসদের প্রস্তাবক্রমে রাষ্ট্রপতির আদেশের মাধ্যমে অপসারণের বিধান ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে এই পদ্ধতির পরিবর্তে রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসনব্যবস্থায় সুপ্রিম কোর্টের কোন বিচারকের অসদাচরণ বা অসামর্থ্যরে কারণে রাষ্ট্রপতির আদেশ দ্বারা কোন বিচারককে তাহার পদ হইতে অপসারিত করা যাইবে বলিয়া বিধান করা হয়। উক্ত বিধানে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ ছিল যে, কোন বিচারককে তাহার সম্পর্কে প্রস্তাবিত ব্যবস্থা গ্রহণের বিরুদ্ধে কারণ দর্শাইবার যুক্তিসঙ্গত সুযোগদান না করা পর্যন্ত তাহাকে অপসারিত করা যাইবে না। ১৯৭৭ ও ১৯৭৮ সনের সামরিক ফরমান দ্বারা সুপ্রিম কোর্টের কোন বিচারকের অসদাচরণ বা অসামর্থ্যরে অভিযোগে অপসারণের ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এবং অপর দুইজন প্রবীণ বিচারকের সমন্বয়ে গঠিত সুপ্রিম জডিশিয়াল কাউন্সিলের সুপারিশসাপেক্ষে রাষ্ট্রপতির ওপর ন্যস্ত করিবার বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয় যাহা সংবিধানের অন্যতম মূলনীতি গণতান্ত্রিক চেতনার পরিপন্থী। জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা গঠিত সংসদে রাষ্ট্রের অন্যান্য অঙ্গের ন্যায় উচ্চ আদালতের বিচারকদের দায়বদ্ধতা ও স্বচ্ছতার নীতি বিশ্বের অধিকাংশ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিদ্যমান রহিয়াছে। বর্ণিত প্রেক্ষাপটে সংবিধানের বিদ্যমান ৯৬ অনুচ্ছেদের দফা ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৭, ৮ এর পরিবর্তে ১৯৭২ সনে প্রণীত সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের দফা ২, ৩, ৪ প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের কোন বিচারককে সংসদের মাধ্যমে অপসারণের বিধান পুনঃপ্রবর্তনের লক্ষ্যে জাতীয় সংসদে সংবিধান (ষোড়শ সংশোধন) আইন, ২০১৪ এর বিল উত্থাপন করা হয়েছে। উক্ত বিলের ৩ দফার বিধান অনুযায়ী কোন বিচারকের অসদাচরণ বা অসামর্থ্য সম্পর্কে তদন্ত ও প্রমাণের পদ্ধতি সংসদ আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করিতে পারিবেন। সুতরাং উক্ত আইনে সুনির্দিষ্টকৃত পদ্ধতি অনুসরণে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টের কোন বিচারককে অপসারণের সুযোগ থাকিবে না। এমতাবস্থায় বিলটি আইনে পরিণত হইলে স্বচ্ছতা দৃশ্যমান হইবে এবং স্বাধীন বিচার বিভাগের প্রতি জনগণের আস্থা আরো বৃদ্ধি পাইবে। ফলশ্রুতিতে, বিচারকগণ তাহাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব অবাধ ও সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে প্রতিপালনের মাধ্যমে সংবিধানের মৌলিক কাঠামো সমুন্নত রাখিতে পারিবেন। প্রথম থেকে পঞ্চদশ সংশোধনী এর আগে সংবিধানে মোট পনেরোবার সংশোধনী আনা হয়েছে। সে সংশোধনীগুলো হচ্ছেÑ প্রথম সংশোধনী : ১৫ জুলাই ১৯৭৩ সংসদে ‘সংবিধান (প্রথম সংশোধনী) বিল ১৯৭৩’ পাস হয়। ওই সংশোধনীর মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিধান করা হয়।  দ্বিতীয় সংশোধনী : দ্বিতীয় সংশোধনী আনা হয়, ১৯৭৩ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর। অভ্যন্তরীণ বা বহিরাক্রমণে গোলযোগে দেশের নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক জীবন বিপন্ন হলে ‘জরুরি অবস্থা’ ঘোষণার বিধান করা হয় ওই সংশোধনীর মাধ্যমে।  তৃতীয় সংশোধনী : ১৯৭৪ সালের ২১ নভেম্বর সংবিধানে তৃতীয় সংশোধনী আনা হয়। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত চুক্তি অনুযায়ী বেরুবাড়িকে ভারতের নিকট হস্তান্তরের বিধান করে সংবিধানে সংশোধনী আনা হয়। সংশোধনী বিলটি পাস হয় ১৯৭৪ সালের ২৩ নভেম্বর।  চতুর্থ সংশোধনী : সংসদীয় শাসনপদ্ধতির পরিবর্তে রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসনপদ্ধতি চালু এবং বহুদলীয় রাজনীতির পরিবর্তে একদলীয় রাজনীতি প্রবর্তনের বিধান করে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী বিল পাস হয় ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি। বিলটি একই দিন উত্থাপন হয়, পাস হয় এবং রাষ্ট্রপতিও একই দিনে তা অনুমোদন করেন।  পঞ্চম সংশোধনী : ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে ১৯৭৯ সালের ৫ এপ্রিল পর্যন্ত সামরিক সরকারের যাবতীয় কর্মকাণ্ডকে বৈধতা দানের বিধান করে ১৯৭৯ সালের ৬ এপ্রিল পাস হয় সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বিল।  ষষ্ঠ সংশোধনী : উপরাষ্ট্রপতি পদ থেকে রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচনের বিধান নিশ্চিতকরণ করে ১৯৮১ সালের ৮ জুলাই পাস হয় ৬ষ্ঠ সংশোধনী বিল।  সপ্তম সংশোধনী : ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ থেকে ১৯৮৬ সালের ৯ নভেম্বর পর্যন্ত সামরিক আইন বলবৎ থাকাকালীন প্রণীত সব ফরমান, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের আদেশ, নির্দেশ ও অধ্যাদেশসহ অন্যান্য আইন অনুমোদনের বিধান করে ১০ নভেম্বর ১৯৮৬ সালে পাস হয় সংবিধানের সপ্তম সংশোধনী বিল।  অষ্টম সংশোধনী : রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামকে স্বীকৃতিদান ও ঢাকার বাইরে ৬টি জেলায় হাইকোর্টের স্থায়ী বেঞ্চ স্থাপনের বিধান করে ১৯৮৮ সালের ৭ জুন পাস হয় সংবিধানের অষ্টম সংশোধনী বিল।  নবম সংশোধনী : ১৯৮৯ সালে সংবিধানের নবম সংশোধনী পাস হয়। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সাথে একই সময়ে উপরাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচন অনুষ্ঠান করা, রাষ্ট্রপতি পদে কোনো ব্যক্তিকে পর পর দুই মেয়াদ সীমাবদ্ধ রাখার বিধান করা হয় এই সংশোধনীর মাধ্যমে। ওই বছরের ১০ জুলাই বিলটি পাস হয়।  দশম সংশোধনী : রাষ্ট্রপতির কার্যকালের মেয়াদ শেষ হওয়ার পূর্বে ১৮০ দিনের মধ্যে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ব্যাপারে সংবিধানের ১২৩(২) অনুচ্ছেদের বাংলা ভাষ্য সংশোধন ও সংসদে মহিলাদের ৩০টি আসন আরো ১০ বছরকালের জন্য সংরণের বিধান করে ১৯৯০ সালের ১২ জুন পাস হয় সংবিধানের দশম সংশোধনী বিল। একাদশ সংশোধনী : এর বিষয়বস্তু ছিলÑ অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের স্বপদে ফিরে যাবার বিধান করে ১৯৯১ সালের ৬ আগস্ট পাস হয় সংবিধানের একাদশ সংশোধনী বিল।  দ্বাদশ সংশোধনী : সংসদীয় পদ্ধতির সরকার পুনঃপ্রবর্তন ও উপরাষ্ট্রপতির পদ বিলুপ্তি করে সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনী বিল পাস হয় ১৯৯১ সালে।  ত্রয়োদশ সংশোধনী : ১৯৯৬ সালের ২৭ মার্চ অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নিরপে-নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তনের বিধান করে ক্রয়োদশ সংশোধনী বিল পাস হয়।  চতুর্দশ সংশোধনী : ‘সংবিধান (চতুর্দশ সংশোধনী) বিল ২০০৪’ পাস হয় ২০০৪ বছরের ১৬ মে। নারীদের জন্য ৪৫টি আসন সংরণ, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ছবি সংরণ, অথ বিল, সংসদ সদস্যদের শপথ, সাংবিধানিক বিভিন্ন পদের বয়স বৃদ্ধির বিধান করা হয় ওই সংশোধনীর মাধ্যমে।  পঞ্চদশ সংশোধনী : সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনী আনা হয় ২০১১ সালের ২৫ জুন। এর শিরোনাম ছিল- সংবিধান (পঞ্চদশ সংশোধনী) বিল ২০১১। ৩০ জুন পাস হয় এটি। সংবিধানের মূলনীতিতে পরিবর্তন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার বিলুপ্তিসহ সংবিধানে অনেকগুলো মৌলিক পরিবর্তন আনা হয় এই সংশোধনীর মাধ্যমে। 

No comments:

Post a Comment