সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মোতাবেক বিশুদ্ধ খাদ্য সরবরাহে সম্প্রতি খাদ্য আদালত গঠন করেছে সরকার। যে কেউ এ আদালতে অভিযোগ নিয়ে গেলে যদি খাদ্যে ভেজাল বা রাসায়নিক উপাদান প্রয়োগের প্রমাণ মেলে তাহলে আদালত পিয়োর ফুড অর্ডিনেন্স অনুযায়ী শাস্তি দিতে পারবেন। তবে উচ্চ আদালতের রায় বাস্তবায়নে প্রতিটি জেলায় এখনো ফুড এনালিস্ট বা খাদ্য বিশ্লেষক নিয়োগ করা হয়নি। এ বিষয়ে আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, আদালতের রায় অনুযায়ী ফুড
এনালিস্ট নিয়োগ না হলে খাদ্য আদালতের কার্যক্রম সেভাবে শুরু হবে না। এ বিষয়ে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতি উচ্চ আদালতের নির্দেশ রয়েছে। গত বছরের ২০ নভেম্বর আইন মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, সুপ্রিম কোর্টের সাথে পরামর্শক্রমে সরকার পিয়োর ফুড অর্ডিনেন্স ১৯৫৯-এর উদ্দেশ্য পূরণকল্পে প্রতিটি জেলায় এবং ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও খুলনা মেট্রোপলিটন এলাকায় একটি করে পিয়োর ফুড কোর্ট স্থাপন এবং ওই বিধান অনুসারে উল্লিখিত জেলা ও মেট্রোপলিটন এলাকাকে স্থানীয় অধিক্ষেত্র নির্ধারণ করে এবং ওই আইন মোতাবেক বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় সদর আমলি আদালতের দায়িত্বপ্রাপ্ত জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটকে এবং ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও খুলনা মেট্রোপলিটন এলাকার ১ নম্বর আমলী আদালতের দায়িত্বপ্রাপ্ত মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটকে মামলা পরিচালনার দায়িত্ব প্রদান করা হলো। এই আদেশ অবিলম্বে কার্যকর হবে। সংশ্লিষ্টদের মতে, ফুড এনালিস্টদের কাজ হবে খাদ্যে ভেজাল বা রাসায়নিক উপাদান আছে কি না তা পরীক্ষা করা। বিএসটিআই ও সায়েন্স ল্যাবরেটরি কেন্দ্রীয়ভাবে খাদ্যের মান নির্ণয় বা রাসায়নিক দ্রব্যের পরিমাণ সম্পর্কে পরীক্ষা করে থাকে। এ ক্ষেত্রে প্রতিটি জেলায় ফুড এনালিস্ট না থাকলে খাদ্য পরীক্ষার জন্য ঢাকায় পাঠাতে হবে। এ বিষয়ে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, ফুড এনালিস্ট নিয়োগ করার জন্য ইতোমধ্যেই জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পত্র পাঠানো হয়েছে। এর জবাব পাওয়ার পরই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হবে। তবে খাদ্য পরীক্ষক কেন নিয়োগ করা হচ্ছে না বা এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ আছে কিনা তা জানার জন্য খাদ্যসচিব বেগম মুসফেকা ইকফার সাথে টেলিফোনে একাধিকবার গোযাযোগ করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলামের কাছে জানতে চাইলে তিনি বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত নন বলে জানান। বিশেষজ্ঞদের মতে, খাদ্যে বিষ প্রয়োগ প্রতিরোধে আইন প্রয়োগের পাশাপাশি সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। আইনের যখন প্রয়োগ শুরু হবে তখন সচেতনতা বৃদ্ধি পাবে। আর কৃষকপর্যায়ে হাতে কলমে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। ফল, সবজিসহ খাদ্যে কোন কোন রাসায়নিক প্রয়োগ করা যাবে না, আর যেগুলো প্রয়োগ করা যাবে তা কতটুকু প্রয়োগ করা যাবে এবং ক্ষতির মাত্রা ও গুণাগুণ সম্পর্কে কৃষকপর্যায়ে জ্ঞান দিতে হবে। স্বাস্থ্যবিদদের মতে, ভেজাল খাদ্য গ্রহণে ক্যান্সারে, ডায়াবেটিস, কিডনি রোগে আক্রান্ত হওয়া, গর্ভবতী মায়ের শারীরিক জটিলতাসহ গর্ভজাত শিশু বিকলাঙ্গ হতে পারে। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. খুরশীদ জাহান বলেন, ফরমালিনযুক্ত খাবারের কারণে মানুষের চোখে মুখে জ্বালাপোড়া হতে পারে। সহনীয় মাত্রার চেয়ে রাসায়নিক বেশি থাকলে লিভারের সমস্যাসহ শরীরের বিভিন্ন অর্গানের সমস্যা হতে পারে। গর্ভধারিণী মা খেলে তার অনেক সমস্যা হতে পারে। বুকের দুধের সাথে রাসায়নিক উপাদান আসতে পারে। সর্বোপরি খাবারের মাধ্যমে শরীরে বিভিন্ন রাসায়নিক উপাদান চলে আসতে পারে। তবে তিনি উল্লেখ করেন আমাদের ফরমালিনের মেশিন নিয়ে কথা আছে। এ ক্ষেত্রে সঠিক টেস্ট হওয়া উচিত। খাদ্য আদালতের ক্ষমতা ও এখতিয়ার : ‘নিরাপদ খাদ্য আইন ২০১৩ এর ৬৪ (১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, এ আইনের অধীন অপরাধ বিচারের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক আদালত থাকবে যা বিশুদ্ধ খাদ্য আদালত নামে অভিহিত হবে। (২) ফৌজদারি কার্যবিধিতে যা কিছুই থাকুক না কেন, উপ-ধারা (১) এর উদ্দেশ্য পূরণকল্পে, সরকার, সুপ্রিম কোর্টের সহিত পরামর্শক্রমে, সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা, প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট আদালত বা ত্রেমত, মেট্রোপলিটন এলাকার জন্য মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতকে বিশুদ্ধ খাদ্য আদালত হিসাবে নির্ধারণ করবে এবং একাধিক আদালত নির্ধারণ করা হলে তাদের প্রত্যেকটি আদালতের জন্য এলাকা নির্দিষ্ট করে দেবে। শাস্তি সম্পর্কে আইনের (৪) উপ-অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ফৌজদারি কার্যবিধিতে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, এই আইনের অধীন কোন ব্যক্তির উপর অর্থদণ্ড আরোপের েেত্র খাদ্য আদালতের এই আইনে উল্লিখিত যে কোন পরিমাণ অর্থদণ্ড আরোপ করার মতা থাকিবে।’ ১৯৫৯ সালের বাংলাদেশ বিশুদ্ধ খাদ্য অধ্যাদেশ আইনটি ২০০৫ সালে সংশোধনী এনে তাতে বলা হয়েছে ‘খাদ্যে ভেজাল পেলে যে কেউ স্থানীয় খাদ্য-আদালতে মামলা করতে পারেন। সে েেত্র ওই খাদ্যদ্রব্য বা খাদ্য উপাদান যে ভেজাল এ মর্মে খাদ্য বিশ্লেষকের সার্টিফিকেট আদালতে দাখিল করতে হবে। তবে মামলার কার্যক্রম শুরু করতে দরকার একই বিষয়ে খাদ্য পরিদর্শক বা খাদ্য বিশ্লেষক কিংবা সরকার অনুমোদিত কোনো ব্যক্তির লিখিত অভিযোগ। এ অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, সরকার যেকোনো এলাকায় খাদ্য পরিদর্শক নিয়োগ দেবে। আর এ খাদ্য পরিদর্শক খাদ্য-সংশ্লিষ্ট যেকোনো প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন, ভেজাল খাদ্যদ্রব্য জব্দ, ধ্বংসসহ অধ্যাদেশে বর্ণিত যেকোনো মতা প্রয়োগ করতে পারবেন। দেশের প্রতিটি জেলা ও মহানগরে খাদ্যে ভেজাল রোধে এক বা একাধিক খাদ্য আদালত থাকবে। সরকার গেজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে এসব আদালত প্রতিষ্ঠা করবে। এ ছাড়া প্রতিটি আদালতের ভৌগোলিক এখতিয়ার নির্ধারণ করবে। প্রতিটি খাদ্য আদালতে বিচারকাজ পরিচালনার দায়িত্বে থাকবে। অপরাধ প্রথমবারের মতো ঘটলে দুই হাজার ৭৫ টাকা জরিমানা এবং দুই থেকে ১২ মাস সশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করতে পারবেন খাদ্য আদালত। একই অপরাধ পরের বার ঘটলে ২৫ হাজার থেকে দুই লাখ টাকা জরিমানা এবং তিন মাস থেকে তিন বছর সশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করতে পারবেন। সেই সাথে দোকান, কারখানা ও সরঞ্জামাদি জব্দ করার মতা রাখেন। এ বিষয়ে পরিবেশ ও মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) প্রেসিডিন্ট অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয় সব ফল ও খাবারেই আছে। এটা না-ও হতে পারে। বর্তমানে ফল, শাক-সবজিসহ খাদ্যপণ্য বাজারে সরবরাহের ক্ষেত্রে অধুনিক ব্যবস্থা রয়েছে। এ জন্য সুন্দর ও টাটকা শাকসবজি বাজারে আসছে। এরপরও বাজারের পণ্যের বিষয়ে স্বাস্থ্যঝুঁকিসহ আতঙ্কের বিষয় রয়েছে। এ ব্যাপারে আমরা প্রয়োজনীয় গবেষণা পাচ্ছি না। মানুষের কাছে এ বিষয়ে স্বচ্ছ ধারণা থাকা প্রয়োজন। আমরা ধারণা করছি ফল, সবজি ও মাছে ফরমালিন ও রাসায়নিক উপাদান থাকতে পারে। তবে আমরা নিশ্চিত নই। খাদ্য আদালতের বিষয় মনজিল মোরসেদ বলেন, খাদ্য আদালত গঠন করা হয়েছে। কিন্তু এই বিষয়ে জনগণের জ্ঞান নেই। তিনি বলেন, প্রতিটি জেলায় আমলি আদালতে এবং মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটকে খাদ্য আদালতের মামলা পরিচালনার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। তবে আদালতের রায় বাস্তবায়নে প্রতিটি জেলায় ফুড এনালিস্ট নিয়োগ করা হয়নি। আমরা এ বিষয়ে প্রয়োজনে আদালতের দ্বারস্থ হতে পারি। তিনি আরো বলেন, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সহজে হয়ত ফুড এনালিস্ট নিয়োগ করবে না। এজন্য আমরা আদালতের দ্বারস্থ হওয়ারও চিন্তা করছি। ২০০৯ সালের ১ জুন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ বনাম বাংলাদেশ, রিট পিটিশন নং ৩২৪/২০০৯ মামলায় হাইকোর্ট সরকারকে দেশের প্রতিটি জেলা ও মহানগরে খাদ্য আদালত (ফুড কোর্ট) স্থাপন এবং খাদ্য বিশ্লেষক ও খাদ্য পরিদর্শক নিয়োগের আদেশ দিয়েছিলেন। এ রায় কার্যকরের জন্য আদালত সরকারকে দুই বছরের সময়সীমাও বেঁধে দিয়েছিল। উচ্চ আদালত একই রায়ে জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা উপদেষ্টা পরিষদ গঠনেরও আদেশ দিয়েছিলেন।
No comments:
Post a Comment