Friday, September 5, 2014

সভা ছাড়া পরিচালকদের ব্যাংকে ঢুকতে মানা:কালের কন্ঠ

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে সংঘটিত বিভিন্ন ধরনের আর্থিক অনিয়মের তথ্য তুলে ধরে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, এসব অনিয়ম বন্ধে পরিচালনা পর্ষদের নিয়োগে রাজনৈতিক বিবেচনার বদলে অভিজ্ঞতা, সততা ও যোগ্যতাকে প্রাধান্য দিতে হবে। পর্ষদের সভা ছাড়া পরিচালকদের ব্যাংকে প্রবেশের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করতে হবে। কোনো ধরনের ঋণ প্রস্তাবে পরিচালকরা যাতে সুপারিশ করতে না পারেন, সে জন্য ব্যবস্থা নিতে হবে। একই সঙ্গে পর্ষদ সভায় কোন পরি
চালক কেমন বক্তব্য  দিচ্ছেন তা হুবহু রেকর্ড করে পর্যালোচনা করতে হবে। এ ছাড়া ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) বা ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) পদে একই ব্যক্তিকে দীর্ঘদিন দায়িত্বে না রাখারও সুপারিশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে নতুন জনবল নিয়োগ দিতে স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার কথাও বলেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত ২৭ আগস্ট অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কাছে এমন বেশ কিছু সুপারিশসংবলিত একটি প্রতিবেদন পাঠিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এসব পরামর্শ খতিয়ে দেখতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব ড. এম আসলাম আলমকে লিখিতভাবে নির্দেশ দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর বিপুল পরিমাণ আর্থিক অনিয়মের পরিপ্রেক্ষিতে এসব ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের কার্যক্রম নিয়মিতভাবে মূল্যায়ন করতে প্রতিটি ব্যাংকের পর্ষদের সঙ্গে আলাদাভাবে সমঝোতা চুক্তি (এমওইউ) স্বাক্ষর করার উদ্যোগ নিয়েছে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। ওই এমওইউতে এসব শর্ত জুড়ে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পরিচালনা পর্ষদের দায়িত্ব ও ক্ষমতা সুনির্দিষ্ট করে দেওয়ার সুপারিশ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, প্রচলিত আইন ও বিধিবিধান অনুসরণ করে সুষ্ঠু ব্যাংকিং কর্মকাণ্ড পরিচালনার ক্ষেত্রে পরিচালনা পর্ষদকে দায়বদ্ধ করতে হবে। একই সঙ্গে ব্যাংকের ঋণ ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনাসহ সামগ্রিক ব্যবসায়িক কার্যক্রম, অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ, মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়ন, আয়-ব্যয় বৃদ্ধিসহ ব্যাংকগুলোর সার্বিক আর্থিক, পরিচালনাগত ও প্রশাসনিক নীতি গ্রহণ পর্ষদের দায়িত্ব। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে কোন কোন ধরনের অনিয়ম হচ্ছে, তার নমুনা তুলে ধরে বলা হয়েছে, ব্যাংকগুলোর হিসাব বহিতে বিপুল পরিমাণ ঋণের তথ্য রয়েছে, বাস্তবে যার কোনো হদিস নেই। ঋণ গ্রহীতার ব্যবসায়িক অভিজ্ঞতা যাচাই না করে ও পর্যাপ্ত জামানত গ্রহণ না করেই ঋণ অনুমোদন, ঋণের পরিমাণ বাড়ানো ও মেয়াদ বারবার নবায়ন করা হচ্ছে। ঋণ প্রস্তাবে শাখা ও প্রধান কার্যালয়ের ক্রেডিট (ঋণ) কমিটির সুস্পষ্ট নেতিবাচক মন্তব্য থাকা সত্ত্বেও পরিচালনা পর্ষদ তা আমলে না নিয়ে অপরিপালিত বিষয়াবলি ভবিষ্যতে পরিপালনসাপেক্ষে ঋণ অনুমোদন দিচ্ছে। ব্যাংকের পর্ষদ যেসব ঋণের অনুমোদন দিচ্ছে, সেগুলোর বিপরীতে জামানতি সম্পত্তির মূল্য বিশেষ বিবেচনায় অতিমূল্যায়িত করে দেখানো হচ্ছে। এক খাতে ঋণ বিতরণের পর ঋণ গ্রহীতাকে ইচ্ছা করেই তা অন্য খাতে ব্যবহারে সাহায্য করা, ঋণ অনুমোদনপত্রে সহায়ক জামানত হিসেবে উল্লিখিত জমি মর্টগেজ না করেই বা আংশিক মর্টগেজ করে ঋণ অনুমোদনপত্রের শর্ত লঙ্ঘন করে ঋণ দেওয়া এবং গ্রাহকের ইচ্ছামাফিক ঋণের জামানত পরিবর্তন করা হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা ও ব্যাংকের নিজস্ব ঋণ নীতিমালার পরিপালন করছে না। ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরোর (সিআইবি) রিপোর্ট পাওয়ার আগেই ঋণ অনুমোদন করা হচ্ছে। ক্ষেত্রবিশেষে সিআইবি রিপোর্টে গ্রাহককে খেলাপি দেখানো সত্ত্বেও তাকে ঋণ দিচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো। অনেক ক্ষেত্রে সীমাতিরিক্ত বকেয়া থাকা সত্ত্বেও নিয়মনীতি লঙ্ঘন করে একের পর এক ঋণ নবায়ন ও মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অমান্য করে শ্রেণিকৃত (খেলাপি) ঋণকে অশ্রেণিকৃত হিসেবে দেখানো হচ্ছে। ব্যাংকের শাখার জন্য মাত্রাতিরিক্ত আগাম ও অস্বাভাবিক ভাড়া পরিশোধের নামে বিপুল পরিমাণ সরকারি অর্থের অপচয় করা হচ্ছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদ কার্যকরভাবে ব্যাংকের দায়-সম্পদ ঝুঁকি পরিস্থিতি বিবেচনা না করে এবং তারল্য-সংক্রান্ত ঝুঁকি দূর করতে নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কোনো ভূমিকা রাখে না। ব্যাংকের ফরেন বুকে বিপুল পরিমাণ আনরিকনসাইলড সম্পদ দীর্ঘ সময় যাবৎ দেখানো হচ্ছে, যা ব্যাংকের প্রকৃত সম্পদ ও দায়কে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করছে। ব্যাংকের নিট হিসাবের ওপর প্রধান কার্যালয়ের সার্বিক কন্ট্রোল না থাকায় তা ফান্ড ফ্রড ও ড্রেনেজজনিত অনিয়ম সংঘটনের সুযোগ সৃষ্টি করছে। এ ছাড়া ব্যাংকভেদে মোট আমানতের ৯৫ শতাংশই উচ্চ সুদবাহী মেয়াদি আমানত ব্যাংকের মুনাফায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এ ক্ষেত্রে দায়-সম্পদ ব্যবস্থাপনা তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছে না। এসব অনিয়ম বন্ধে রাষ্ট্রায়ত্ত বিভিন্ন ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সঙ্গে সরকারের সমঝোতা স্মারকে বেশকিছু ‘কে পারফরম্যান্স ইনডিকেটর (কেপিআই) বা প্রধান সক্ষমতা সূচক নির্ধারণের সুপারিশ করে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, পর্ষদকে বার্ষিক কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। সিইও ও অন্যান্য সিনিয়র অফিসারকে কেপিআই নির্ধারণ মনিটর ও ছয় মাস অন্তর তা মন্ত্রণালয়কে জানাতে হবে। ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালা মেনে চলতে হবে। অডিট আপত্তি পর্যালোচনা করে নিষ্পত্তির মাধ্যমে তা কমিয়ে আনতে হবে। বিভিন্ন মামলা মাসিক ভিত্তিতে পর্যালোচনা করতে হবে। মাসিক ভিত্তিতে তারল্য পরিস্থিতি এবং ঋণ আদায় পরিস্থিতি পর্যালোচনা করতে হবে। পর্ষদ সভা নিয়মিত ভিত্তিতে হতে হবে। ব্যাংকের পাঁচ বছরব্যাপী কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ, সংশোধন, বাস্তবায়ন ও নিয়মিতভাবে তা মূল্যায়ন করতে হবে। এ ছাড়া ব্যাংকের রেটিং উন্নীতকরণ, মূলধন সংরক্ষণ ও মূলধন পর্যাপ্ততা নিশ্চিতকরণ এবং পর্ষদ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন নিয়মিত ভিত্তিতে মূল্যায়নের পরামর্শ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকগুলোতে অনিয়ম কমাতে চাকরি শেষে একই ব্যক্তিকে প্রতিষ্ঠানে ভিন্নভাবে নিয়োগ না দেওয়ার সুপারিশ করে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, সিইও হিসেবে একজনকে দীর্ঘদিন দায়িত্বে রাখা পরিহার করা উচিত। বিদেশ ভ্রমণে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে একই অনুষ্ঠানে একাধিক কর্মকর্তাকে ভ্রমণ করতে না দেওয়ার কথাও বলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

No comments:

Post a Comment