Monday, September 22, 2014

চোরাকারবারিদের পকেটে দিনে ১২ কোটি টাকা:কালের কন্ঠ

বছর তিনেক আগে ২০১১ সালের জুলাই মাসে বিদেশ থেকে দেশে বৈধ পথে আসা (অন্তর্গামী) টেলিফোন কলের পরিমাণ ছিল ১৫৫ কোটি ৩৯ লাখ ৪৭ হাজার ৩৪৩ মিনিট। আর দেশ থেকে বিদেশে যাওয়া (বহির্গামী) কলের পরিমাণ ছিল তিন কোটি ২১ লাখ ২২ হাজার ৬৮৭ মিনিট। ওই সময় দেশে মোবাইল ফোন গ্রাহকের সংখ্যা ছিল সাত কোটি ৮০ লাখ ৭৫ হাজার ৬৬৬। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) বার্ষিক প্রতিবেদনগুলো থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে। এদিকে
বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের দাবি অনুযায়ী, প্রতিবছরই প্রবাসী বাংলাদেশির সংখ্যা বাড়ছে। বর্তমানে এ সংখ্যা প্রায় ৯০ লাখ। দেশে মোবাইল ফোনের গ্রাহক বেড়ে সাড়ে ১১ কোটি ছাড়িয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই এসবের সঙ্গে সংগতিপূর্ণভাবে বৈধ পথে বৈদেশিক কলের পরিমাণ বাড়ার কথা। কিন্তু হিসাবে ঘটছে উল্টোটা। গত তিন বছরে বেশির ভাগ সময়  অন্তর্গামী ও বহির্গামী দুই ক্ষেত্রেই বৈদেশিক কলের সংখ্যা কম পাওয়া গেছে। আর বলা বাহুল্য, এর প্রধান কারণ ভয়েস ওভার ইন্টারনেট প্রটোকল বা ভিওআইপির অবৈধ কারবার ছাড়া আর কিছু নয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ১৪ বছর ধরে ভিওআইপির অবৈধ কারবারসহ বিভিন্নভাবে বৈদেশিক কলের ক্ষেত্রে অরাজকতা অব্যাহত রয়েছে। এই দীর্ঘ সময় ধরে এ খাতে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে অনেক প্রচেষ্টা নেওয়া হলেও অবৈধ কারবারিদের পক্ষে রাজনৈতিক প্রভাব খাটানোর কারণে তা সফল হয়নি। প্রতিদিন যে পরিমাণ বৈদেশিক কল দেশে আসা ও দেশ থেকে বাইরে যাওয়ার কথা, তার অর্ধেকই থেকে যাচ্ছে সরকারি হিসাবের বাইরে। ফলে সরকার এ খাত থেকে বিপুল পরিমাণ টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে। বিটিআরসির প্রতিবেদনের তথ্য মতে, গত বছর জুন মাসে অন্তর্গামী বৈদেশিক কলের পরিমাণ ছিল ১২৪ কোটি ৮২ লাখ ৬৭ হাজার ৫১২ মিনিট আর বহির্গামী কলের পরিমাণ ছিল দুই কোটি ৪৬ লাখ ৯১ হাজার ২৪৯ মিনিট। এর আগে ২০১২ সালের ডিসেম্বরে অন্তর্গামী বৈদেশিক কল ছিল ১০৯ কোটি ৬৫ লাখ ৩৪ হাজার ৭৯৯ মিনিট এবং বহির্গামী কল ছিল দুই কোটি দুই লাখ ৭৭ হাজার ৪৮৮ মিনিট। ২০১২-১৩ অর্থবছরের অন্য মাসগুলোতেও বৈদেশিক কলের পরিমাণ ছিল ২০১১ সালের জুলাই মাসের চেয়ে অনেক কম। তবে সম্প্রতি বৈদেশিক  কলের  রেট  তিন সেন্ট থেকে কমিয়ে দেড় সেন্ট করার উদ্যোগ নেওয়ায় গত মাস থেকে অন্তর্গামী কলের পরিমাণ সামান্য বেড়েছে বলে বিটিআরসির দাবি। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত জুলাই মাসে অন্তর্গামী কলের পরিমাণ ছিল ১৪৫ কোটি মিনিটের কাছাকাছি। গত মাসে তা বেড়ে ১৬৫ কোটির কাছাকাছি পৌঁছেছে। তবে বহির্গামী কল বাড়েনি। এ খাতে অরাজকতা দূর করতে সরকার ২০১০ সালে বৈদেশিক কলের ক্ষেত্রে ২০০৭ সালের নীতিমালা সংশোধন করে নতুন ‘আইএলডিটিএস পলিসি’ গ্রহণ করে ঢালাওভাবে আইজিডাব্লিউ, আইসিএক্স, আইআইজি ও ভিএসপি লাইসেন্স দেয়। এতে পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়। রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার কারণে বর্তমানে ৯টি আইজিডাব্লিউ অপারেটরের কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। মামলাও হয়েছে কয়েকটির নামে। যেগুলো চালু রয়েছে সেগুলোও নিয়মিত রাজস্ব দিচ্ছে না। নিয়মিত বার্ষিক লাইসেন্স ফিও পাচ্ছে না সরকার। এই ফি কমিয়ে দিয়েও তেমন সুফল মিলছে না। সর্বশেষ ভিওআইপির  চোরাকারবার বা অবৈধভাবে কল টার্মিনেশন কমাতে বৈদেশিক কলের রেট কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। বিটিআরসি গত ১৮ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক অন্তর্গামী কল টার্মিনেশন রেট সর্বনিম্ন তিন সেন্ট (ইউএস ডলারের হিসাবে) থেকে কমিয়ে দেড় সেন্ট নির্ধারণ করেছে। একই সঙ্গে বিটিআরসি, আইজিডাব্লিউ, আইসিএক্স ও এএনএসের রেভিনিউ শেয়ারিং যথাক্রমে ৫১.৭৫, ১৩.২৫, ১৫ ও ২০ শতাংশ থেকে পরিবর্তন করে ৪০, ২০, ১৭.৫ ও ২২.৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। এ পরিবর্তন অস্থায়ী ও ছয় মাসের জন্য কার্যকর বলে বিটিআরসি জানিয়েছে। এ ছাড়া বলা হয়েছে, পরীক্ষামূলক সময়ের পর কলের পরিমাণ ও রাজস্ব আয়ের ভিত্তিতে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে। তবে এতে বৈধ পথে বিদেশি কল আসার পরিমাণ সামান্য বাড়লেও এ খাতে সরকারের রাজস্ব আয় আরো কমে যাবে বলেই সংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা। দিনে ১২ কোটি টাকা চোরাকারবারিদের পকেটে : প্রতিদিন কী পরিমাণ কল চোরাকারবারিদের মাধ্যমে দেশে আসছে, এ থেকে সরকার কী পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে, তা নিয়ে কিছুটা মতপার্থক্য রয়েছে। বিটিআরসির চেয়ারম্যান সুনীল কান্তি বোসের ধারণা, প্রতিদিন অবৈধভাবে কল টার্মিনেশনের কারণে সাড়ে তিন কোটি মিনিটের মতো আন্তর্জাতিক কল হিসাবের বাইরে থেকে যাচ্ছে। বৈধ পথে আসার কথা প্রতিদিন আট কোটি মিনিট আর আসছে সাড়ে চার কোটি মিনিট। সম্প্রতি টেলিকম রিপোর্টার্স নেটওয়ার্ক বাংলাদেশ (টিআরএনবি) আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে তিনি তাঁর এ ধারণার কথা জানান। তবে আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারগুলোর দাবি, প্রতিদিন বাংলাদেশে আসা আন্তর্জাতিক কলের পরিমাণ ১৪ কোটি মিনিট। অর্থাৎ প্রতিদিন প্রায় ১০ কোটি মিনিট কলের রাজস্ব চোরাকারবারিদের পকেটে চলে যাচ্ছে, যার পরিমাণ ১২ কোটি টাকার ওপরে। সম্প্রতি ব্যাংককের এক সেমিনারে ইন্টারন্যাশনাল ক্যারিয়ারদের পক্ষ থেকে এ তথ্য জানানো হয়। এদিকে ভিওআইপির অবৈধ কারবার চালু থাকায় মোবাইল অপারেটররাও নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে জানা যায়। বাংলালিংকের এক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মোবাইল ফোন অপারেটররা বৈধ পথে আসা প্রতি মিনিট আন্তর্জাতিক কল থেকে প্রায় ৪৮ পয়সা রাজস্ব আয় করে থাকে। কিন্তু ভিওআইপির অবৈধ কারবারিরা এসব কল স্থানীয় কল হিসেবে পাঠাচ্ছে। এতে প্রতি মিনিট কল থেকে আমরা পাচ্ছি ১৮ পয়সা। সে জন্য আমরা চাই, আন্তর্জাতিক কল বৈধ পথেই আসুক।’ ওই কর্মকর্তা আরো জানান, অবৈধ কল টার্মিনেশনে ব্যবহারের জন্য গত বছর প্রায় ৪৮ হাজার মোবাইল ফোনের সিম বন্ধ করা হয়। এতে মোবাইল ফোন অপারেটররা ব্যাপকভাবে আর্থিক ক্ষতির শিকার হচ্ছে। কারণ ভর্তুকি দিয়ে সিম বিক্রি করতে হয়। গ্রামীণফোনের চিফ করপোরেট অ্যাফেয়ার্স অফিসার মাহমুদ হোসেন বলেন, ‘যেসব আইজিডাব্লিউ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে তাদের কাছে গ্রামীণফোনের পাওনা ৮৭ কোটি টাকা। ২০১২ সালে সরকারি কম্পানি বিটিসিএলের কাছে পাওনা হয় ১২০ কোটি টাকা। সেই টাকারও কোনো হদিস নেই। আমরা এসব পাওনা আদায়ের জন্য আটটি আইজিডাব্লিউ অপারেটরের বিরুদ্ধে মামলা করেছি।’ মাহমুদ হোসেন আন্তর্জাতিক অন্তর্গামী কলের রেট কমানোর সিদ্ধান্ত সম্পর্কে বলেন, ‘আমরা একে স্বাগত জানাই। কারণ রেট বেশি থাকার কারণে ভিওআইপির অবৈধ কারবার কমছে না। যদিও এর কারণে বৈদেশিক কল থেকে আমাদের রাজস্ব আয় অর্ধেক কমে যাবে, তবু বিষয়টি আমরা সমর্থন করি।’ ভিওআইপি নিয়ে মামলা ২০০-এর বেশি নয় : সূত্র জানায়, এ বছর বিটিআরসি ও র‌্যাবের যৌথ অভিযানে ঢাকা ও চট্টগ্রামে মোট ১৪টি ভিওআইপির অবৈধ স্থাপনায় অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ ভিওআইপিসামগ্রী জব্দ এবং ১৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। কিন্তু এসব অভিযানে এ কাজের সঙ্গে যুক্ত সাধারণ কর্মীরাই গ্রেপ্তার হয়। এর পেছনে যেসব রাঘব বোয়াল রয়েছে তাদের চিহ্নিত করার কোনো চেষ্টার কথা শোনা যায়নি। এদিকে এসব অভিযানের পর সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে মামলা পরিচালনায় বিটিআরসির তেমন আগ্রহ রয়েছে বলেও শোনা যায় না। ভিওআইপির অবৈধ কারবারিদের বিরুদ্ধে কতটা মামলা রয়েছে, কতটা মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে তারও কোনো পরিসংখ্যান বিটিআরসির কাছে পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে বিটিআরসির সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, বিটিআরসি থেকে সম্প্রতি সব জেলার পুলিশ সুপার এবং মেট্রোপলিটন এলাকার দায়িত্বশীল পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছে ভিওআইপিবিষয়ক মামলার তথ্য চেয়ে চিঠি দেওয়া হয়। সেই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে বেশির ভাগ জেলা থেকে যে তথ্য বিটিআরসির কাছে পাঠানো হয়েছে তাতে ধারণা করা হচ্ছে, এ বিষয়ে মামলার সংখ্যা ২০০-এর বেশি হবে না।  ওই কর্মকর্তা জানান, বিটিআরসির জানার বাইরেও কিছু মামলা হয়েছে। এসব মামলার চার্জশিট বা ফাইনাল রিপোর্ট দেওয়ার সময় বিটিআরসির অনুমতি লাগে। জব্দকৃত ভিওআইপি সরঞ্জাম সম্পর্কে তিনি বলেন, বিটিআরসির স্টোররুমে এ ধরনের অনেক সরঞ্জাম জমা রয়েছে। সংশ্লিষ্ট থানাগুলোতেও মামলার আলামত হিসেবে এসব সরঞ্জাম রাখা হয়েছে। বিটিআরসি থেকে লাইসেন্সপ্রাপ্ত কোনো প্রতিষ্ঠান যেমন আইজিডাব্লিউ অপারেটররা এ কারবারে জড়িত থাকার প্রমাণ পেলে তাদের সরঞ্জামগুলো সরাসরি বিটিআরসির স্টোররুমে জমা রাখা হয়। এ ছাড়া মামলা নিষ্পত্তির পর আদালতের নির্দেশে তা বিটিআরসির হেফাজতে থাকে। যাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে তারা কিভাবে ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে- এ প্রশ্নে বিটিআরসির কমিশনার মো. আব্দুস সামাদ বলেন, এসব মামলা জামিনযোগ্য। লাইসেন্স নিয়ে বিপাকে প্রায় ১০০০ ভিএসপি : প্রায় ৬০ কোটি টাকা দিয়ে লাইসেন্স নিয়ে ভিওআইপি সার্ভিস প্রোভাইডার বা ভিএসপি অপারেটররা এখন এ দায়িত্ব থেকে পরিত্রাণের পথ খুঁজছে।  বিটিআরসির  কাছে ধরনা দিয়েও তারা কোনো সমাধান পাচ্ছে না। এই লাইসেন্স সম্পর্কে সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছিল, এর মাধ্যমে দেশে ভিওআইপি উন্মুক্ত হলো এবং ভিওআইপির অবৈধ কারবার বন্ধ হবে। গত বছর ২৫ মার্চ বিটিআরসি এ লাইসেন্স হস্তান্তর করে। শর্ত ছিল লাইসেন্স নেওয়ার ছয় মাসের মধ্যে এ সেবা চালু করতে হবে। সে সময় গত ২৫ সেপ্টেম্বর পার হয়ে গেছে। কিন্তু হাতে গোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ছাড়া বেশির ভাগ লাইসেন্সধারীই ওই সেবা চালু করতে পারেনি। অনেকে হতাশ হয়ে হাত গুটিয়ে বসে আছে। আর যারা এ আর্থিক ক্ষতি মেনে নিতে পারছে না তারা সাংগঠনিকভাবে সংকট নিরসনের পথ খুঁজছে। সম্প্রতি জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন কর্মসূচিও পালন করেছে তারা। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ভিএসপি অ্যাসোসিয়েশনের এক কর্মকর্তা খন্দকার রোমেল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আইজিডাব্লিউ বা ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়ে অপারেটরদের অসহযোগিতা এবং ভিএসপি নীতিমালার কিছু অসামঞ্জস্যপূর্ণ দিকের কারণে আমরা প্রায় এক হাজার লাইসেন্সধারী এখনো বাণিজ্যিকভাবে এ সেবা চালু করতে পারিনি। বিটিআরসি আমাদের প্রতি মিনিট তিন সেন্ট করে বিদেশি কল আনতে বলেছে। কিন্তু আইজিডাব্লিউ অপারেটররা বিদেশি ক্যারিয়ারদের সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রতি মিনিট দুই সেন্ট করে নেওয়ার শর্তে কল আনছে। এ ক্ষেত্রে আমাদের সমস্যা সমাধানের জন্য সরকার বা বিটিআরসির কোনো মাথাব্যথা আছে বলে মনে হচ্ছে না।’

No comments:

Post a Comment