ইদানীং টাকা ছিনতাইয়ে ব্যবহার হচ্ছে সোর্স। ছিনতাই থেকে অর্জিত অর্থের কমিশন নিয়ে কাজ করছে তারা। এসব সোর্সের কেউ চাকরি করেন ব্যাংকে, পুলিশে আবার কেউ দেশী-বিদেশী কোম্পানিতে। লেখাপড়া জানা ভদ্রবেশী এসব সোর্স রাতারাতি টাকার মালিক হওয়ার জন্য অন্যায়ের পথে পা বাড়াচ্ছেন। এসব সোর্সের মূল কাজ তারা পেশাদার ছিনতাইকারীদের কাছে তথ্য বিক্রি করেন। ব্যাংকের গ্রাহক, বিকাশ এজেন্ট, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলো কখন কিভাবে কাদে
র মাধ্যমে টাকা লেনদেন, উত্তোলন, জমা দেয়া সংক্রান্ত সব ধরনের তথ্য প্রদান করেন। সেই অনুযায়ী ছিনতাইকারীরা নীলনকশা সাজায়। নতুন এ অপরাধ ফর্মুলা প্রতিরোধে কাজ করছেন এমন গোয়েন্দারা জানিয়েছেন, তারা ইতোমধ্যেই এ ধরনের বেশ কয়েকটি চক্রের সন্ধান পেয়েছে। তাদের তথ্য মতে, ব্যাংকের টাকা লেনদেনের সময় যে ছিনতাইগুলো হয় তার অধিকাংশ তথ্যই ব্যাংকের ভেতর থেকে দেয়া হয়। এমনটিও হতে পারে ব্যাংকের কাউন্টারে বসা কেশিয়ারই ছিনতাইকারীদের সোর্স হিসেবে কাজ করছেন। এতে ব্যাংকারদের ওপর থেকেও গ্রাহকদের আস্থা উঠে যাচ্ছে। অনেক গ্রাহকই মোটা অঙ্কের টাকা লেনদেনের ক্ষেত্রে আগে থেকে ব্যাংককে নোটিশ দিতে ভয় পাচ্ছেন। গোয়েন্দারা মনে করেন, ব্যাংকে ঢুকার পর সেখানকার স্টাফদের মোবাইল ফোন ব্যবহার বন্ধ করা না গেলে তথ্য পাচার বন্ধ হবে না। ব্যাংকগুলোর অধিকাংশই প্রাইভেট হওয়ায় এ ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কিছু করতে পারছে না। সূত্র জানায়, ঢাকার ব্যস্ততম বাণিজ্যিক এলাকাগুলোতে বছরের বিশেষ বিশেষ সময় অর্থাৎ ঈদ মওসুমে ছিনতাইকারীদের তৎপরতা বৃদ্ধি পায়। এ সময় ব্যাংক ও ব্যবসায়প্রতিষ্ঠানগুলোতে আর্থিক লেনদেনও বাড়ে। ফলে সোর্সদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে ছিনতাইকারীরা ব্যাংকগুলোর সামনে ওঁৎ পেতে থাকে। মোটা অঙ্কের টাকা ছিনতাইয়ের শীর্ষে রয়েছে গার্মেন্টগুলো। প্রায়ই গার্মেন্টকর্মীদের বেতনের টাকা উত্তোলন বা জমা দেয়ার সময় পরিকল্পিত ছিনতায়ের ঘটনা ঘটছে। গত কয়েক বছরের ছিনতাই পর্যালোচনা করে দেখা গেছে পূর্ব তথ্য না থাকলে এত সূèভাবে ছিনতাই সম্ভব নয়। বছরের দুই ঈদ ও পূজার মওসুমে পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে বড় অঙ্কের টাকার লেনদেনের ক্ষেত্রে পুলিশের সহায়তা নেয়ার পরামর্শ দিয়ে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়। কিন্তু সাধারণ মানুষ বা ব্যবসায়ীদের পুলিশের ওপর আস্থা না থাকায় তারা সে দিকে পা বাড়ান না। তা ছাড়াও টাকা লেনদেনের হেতু, উৎস, পরিমাণ ইত্যাদি আইনি জবাবদিহিতার ঝক্কি তো রয়েছেই। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, রাজধানীতে কয়েক ধরনে ছিনতাইকারী রয়েছে। এর মধ্যে উঁচু স্তরের ছিনতাইকারীরা অস্ত্র ও অত্যাধুনিক মোটরসাইকেল ব্যবহার করে। এরা সবচেয়ে ভয়ঙ্কর। এদের পেছনে রাজনৈতিক ছত্রছায়া রয়েছে। এ গ্রুপের সদস্যরা সোর্স ব্যবহার করে থাকে। এদের আরেক ধরনের নিজস্ব সোর্স রয়েছে। তারা গ্রাহকের ছদ্মবেশে বিভিন্ন ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ভেতরে বা আশপাশে অবস্থান নেয়। এ সময় কোনো গ্রাহক ব্যাংক থেকে মোটা অঙ্কের টাকা তুলে বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের টাকা ব্যাংকে জমা দিতে যাওয়ার পথে পিছু নেয় সোর্সরা। এরপর টার্গেটকৃত লোকের বর্ণনা দিয়ে কোন গাড়িতে কোন পথে যাচ্ছে তা জানিয়ে দেয়া হয় ছিনতাইকারী গ্রুপটিকে। তারপর শুরু হয় অপারেশনের প্রস্তুতি। অনেক সময় সোর্সরাও ছিনতাইয়ের কাজে অংশ নেয় বলে জানা যায়। এর পাশাপশি আরো একটি ভয়ঙ্কর গ্রুপ আছে যারা দামি প্রাইভেটকার ও সিএনজি নিয়ে ঢাকা শহর দাপিয়ে বেড়ায়। এরা মূলত রাতে অপারেশনে নামে। কখনো লঞ্চ ঘাট। কখনো বা বাস ও রেল স্টেশনে তারা অবস্থান করে। এদের টার্গেট থাকে দূরপাল্লার যাত্রী। ছদ্মবেশে চালক সেজে যাত্রীদের গাড়িতে তুলে নিরাপদ স্থানে নিয়ে সর্বস্ব লুট নেয়। তিনি বলেন, এক ধরনের ছিনতাইকারী আছে ভাসমান। যাদের স্থায়ী কোনো ঠিকানা নেই। এরা বেশির ভাগই বস্তি, ফুটপাথ অথবা টোকাই থেকে ছিনতাইকারী। কেউ কেউ আছে মাদকের সাথে জড়িত। নেশার টাকা জোগাতে ছিনতাই করে। এ ছাড়াও একটা গ্রুপ আছে যাদের ঠেলা বা ধাক্কা পার্টি বলা হয়। এরা একটি গ্রুপে ৮ থেকে ১০ জন করে চলাফেরা করে। টার্গেটকৃত ব্যক্তিকে গ্রুপের একজন ধাক্কা দিয়ে ঝগড়া শুরু করে। অন্যরা পথচারী সেজে সামাল দিতে ছুটে আসে। এই ফাঁকে গ্রুপের অন্য সদস্য নির্ধারিত ব্যক্তির টাকা বা টাকার ব্যাগ নিয়ে পালিয়ে যায়। এরা মধ্যবিত্ত শ্রেণী বা ঢাকায় আগন্তুকদের সাথে বেশি প্রতারণা করে। জানা গেছে, রাজধানীর চাঁদাবাজ গ্রুপগুলোও ছিনতাইয়ে নেমেছে। এদের অধিকাংশই রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকে। এরা কোনো ব্যবসায়ীর কাছে চাঁদা না পেলে পরে ছিনতাই করে সব কিছু লুটে নেয়। ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া সেন্টারের উপ-কমিশনার মাসুদুর রহমান বলেন, ছিনতাইকারীদের ধরতে পুলিশের নিয়মিত অভিযান চলছে। বিভিন্ন সময় ছিনতাইকারীদের গ্রেফতার করে জেলে পাঠানো হয়। এরা জামিনে বের হয়ে আবার একই পেশায় ফিরে আসে। তবে তাদের গ্রেফতারের জন্য গোয়েন্দাদের একাধিক টিম কাজ করছে। অপর এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, রাজধানীর দুর্ধর্ষ কয়েকজন অস্ত্রধারী ছিনতাইকারী গত কয়েক মাসে বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছে। ওই ছিনতাইকারীদের শিষ্যরা নতুন করে সংগঠিত হচ্ছে। তবে সাম্প্রতিক ছিনতাইগুলো রাজধানীর বাইরে থেকে এসে করা হয়েছে। গোয়েন্দারা ওই চক্রগুলোকে শনাক্তের চেষ্টা করছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের দেয়া তথ্যানুযায়ী, রাজধানীতে প্রতি মাসে গড়ে ২৩টি ছিনতাই ও দস্যুতার ঘটনা ঘটছে। তবে ছিনতাইয়ের অনেক ঘটনাই অজানা থেকে যায় পুলিশের। অনেক ভুক্তোভোগী পুলিশি ঝামেলায় নিজেকে জড়াতে চান না বলে মামলা করেন না। চলতি বছরের গত আট মাসের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, পুলিশের হিসাবেই রাজধানীতে ছিনতাইয়ের ঘটনা বেড়েই চলেছে। এর মধ্যে গত জানুয়ারি মাসে রাজধানীর থানাগুলোতে ছিনতাই ও দস্যুতার ঘটনায় ১৯টি মামলা হয়েছে। ফেব্রুয়ারি মাসে মামলা হয় ২০টি। মার্চে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৬টি। এপ্রিলে ১৯টি, মেতে ২১টি। গত জুন মাসে রাজধানীর থানাগুলোতে ছিনতাই ও দস্যুতার ঘটনায় ৩১টি মামলা হলেও জুলাই মাসে এ মামলার সংখ্যা ২৩টি। এ ছাড়া আগস্ট মাসে ২৫টি মামলা হয়েছে। কয়েকটি মামলায় আসামি গ্রেফতার হলেও বড় বড় ছিনতাইয়ের রহস্য উদঘাটন করতে পারেনি পুলিশ।
No comments:
Post a Comment