Friday, September 5, 2014

বাংলাদেশ এগোচ্ছে, বিনিয়োগ করুন:প্রথম অালো

প্রাকৃতিক দুর্যোগ, রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যেও বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। পাঁচ বছর ধরে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের কাছাকাছি। রপ্তানি প্রবৃদ্ধি দুই অঙ্কের ওপরে। বিদ্যুৎ উৎপাদন ১১ হাজার মেগাওয়াটে পৌঁছেছে। ওষুধ, পোশাক, চামড়াসহ বিভিন্ন খাতের জন্য আলাদা শিল্পপার্কসহ অন্যান্য অবকাঠামো উন্নয়নে কাজ চলছে। সরকার বিনিয়োগকারীদের নীতি-সহায়তা দিচ্ছে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশ হতে যাচ্ছে এশিয়ার পরবর্তী ‘চীন’। বিদেশ
ি বিনিয়োগকারীদের জন্য বাংলাদেশ এখন একটি বিরাট সুযোগ।  এভাবেই ‘বাংলাদেশ বিনিয়োগ সম্মেলন’-এ বিভিন্ন দেশের বিনিয়োগকারীদের কাছে বাংলাদেশের ইতিবাচক গল্প তুলে ধরে বিনিয়োগের আহ্বান জানালেন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাসহ সরকারের বিভিন্ন কার্যালয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীরা। সুযোগ ও সম্ভাবনার এই গল্পের সঙ্গে কণ্ঠ মেলালেন বিশ্বব্যাংকসহ সিঙ্গাপুরের কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারাও। একই সঙ্গে তাঁরা বাংলাদেশকে অবকাঠামোর আরও উন্নতি, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা হ্রাস, স্বচ্ছতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার তাগিদ দিলেন। সিঙ্গাপুরের ফোর সিজনস হোটেলে গতকাল বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত হলো দ্বিতীয় বাংলাদেশ বিনিয়োগ সম্মেলন। দিনব্যাপী এই সম্মেলনে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সামনে বাংলাদেশকে তুলে ধরার এই আয়োজনটি করেছে ফিন্যান্সিয়াল জার্নাল ফাইন্যান্স এশিয়া। আর এতে পৃষ্ঠপোষকতা করেছে স্টান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক ও দি সিটি ব্যাংক লিমিটেড। স্থানীয় সময় সকাল পৌনে নয়টায় শুরুতেই স্বাগত বক্তব্য দেন সম্মেলনের চেয়ারম্যান ফাইন্যান্স এশিয়ার কন্ট্রিবিউটিং এডিটর রুপার্ট ওয়ার্কার, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জিম ম্যাককেইব ও সিটি ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসরুর আরেফিন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তর্জাতিকবিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভী বলেন, ‘পাঁচ বছর ধরে বাংলাদেশে ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। যদিও এতে আমরা সন্তুষ্ট না। বিদ্যুৎ ও গ্যাসের পর্যাপ্ততা বাড়াতে কাজ চলছে, তাতে প্রবৃদ্ধি আরও ১-২ শতাংশ বাড়ানো যাবে। পদ্মা সেতুর কাজ শুরু হয়েছে। এতে আরও ১ শতাংশ বাড়াবে।’ বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আমি নিশ্চিত করছি, প্রবৃদ্ধি আরও দ্রুত হবে। সরকার আগামী চার-পাঁচ বছরের মধ্যে বাস্তবায়নের জন্য রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র, মেট্রোরেলসহ ১০টি বিরাট প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এগুলো বাস্তবায়িত হলে কয়েক বছরের মধ্যে প্রবৃদ্ধি দুই অঙ্কের ঘরে পৌঁছে যাবে।’ গওহর রিজভী আরও বলেন, ‘বাংলাদেশে দুর্নীতি নেই বললে আপনারা বললেন, আমি মিথ্যাবাদী। আমি সেটা বলছি না। তবে দুর্নীতির পরিমাণ কমে আসছে। সব ক্ষেত্রে জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা বেড়েছে।’ এ সময় তিনি জাতীয় সংসদের দুই সদস্যের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্তের বিষয়টি উল্লেখ করেন। প্রায় একই রকম তথ্য দিয়ে ইস্টার্ন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আলী রেজা ইফতেখার বলেন, ঢাকা-চট্টগ্রাম ও পদ্মা সেতু হলে প্রবৃদ্ধি শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ বাড়বে। সময়মতো এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে ২০০৮ সালে প্রবৃদ্ধি দাঁড়াত ৮ শতাংশে। তাই প্রকল্প বাস্তবায়নে বিষয়ে জোর দিতে হবে। সিঙ্গাপুরে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার মাহবুব উজ জামান বলেন, ‘বাংলাদেশের সাফল্য একধরনের “মডেল”। তার পরও কিছু সমস্যা আছে। এক রাতের মধ্যে সব অর্জন করা যায় না। তবে আমরা একটি প্রক্রিয়ার মধ্যে আছি।’ স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক ভারতের অর্থনীতিবিদ রাধিকা কাক বাংলাদেশের সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করে বলেন, গত পাঁচ বছরে চীনের মোট জিডিপির মধ্যে বিনিয়োগের পরিমাণ ৩০ শতাংশ। এ ক্ষেত্রে ভারতে ৩০ শতাংশ এবং বাংলাদেশে ২৬ শতাংশ। ফলে নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের বিরাট সুযোগ আছে। সব ঠিকঠাক করতে পারলে আগামী ১০ বছরে দেশটির রপ্তানি ১০০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করা সম্ভব। রাধিকা আরও বলেন, বিনিয়োগ বাড়াতে হলে বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে হবে। এ জন্য আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূর ও অবকাঠামো নির্মাণে বাস্তবায়ন দক্ষতা বাড়াতে হবে। এ সময় তিনি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক নির্দিষ্ট সময়ে শেষ না হওয়ার উদাহরণ তুলে ধরেন। বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর জোহানেস জাট বলেন, সব ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ উন্নতি করেছে। তবে বিনিয়োগ বাড়াতে হলে শিল্প স্থাপনের জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। বিনিয়োগ নীতিমালার উন্নতি ও কর-ব্যবস্থার সংস্কার করতে হবে। আর অবশ্যই বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়ন ঘটাতে হবে এবং একই সঙ্গে দুর্নীতি কমিয়ে আনতে হবে। ডেইলি স্টার-এর সম্পাদক মাহ্ফুজ আনাম বলেন, ‘বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ইমেজ সংকট আছে। তবে ব্যবসায়ীরা সেটি কাটিয়ে উঠছেন।’ বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আমাদের অনেক সমস্যা আছে। সব দেশেই কমবেশি তা থাকে। তবে আমরা ব্যবসায়ীদের স্বাগত জানাতে প্রস্তুত। বাংলাদেশ ভারত ও চীনের সরকারের সঙ্গে “জিরো ট্যারিফ” চুক্তি করেছে। তার মানে বাংলাদেশ থেকে ব্যবসা করলে ওই দুই দেশে বিনা শুল্কে পণ্য রপ্তানি করা যাবে।’ দিনব্যাপী এই সম্মেলনে বিনিয়োগ নিয়ে তিনটি বক্তব্য উপস্থাপন করেন গওহর রিজভী, বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের সভাপতি ফারুক সোবাহান ও বাংলাদেশের সরকারি-বেসরকারি অংশীদারি কার্যালয়ের (পিপিপি) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ আফসর এইচ উদ্দিন। এ ছাড়া আটটি প্যানেল আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। এর মধ্যে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়েই ছিল তিনটি। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) কমিশনার আরিফ খান বলেন, গত তিন বছরে শেয়ারবাজারে বিশেষ কিছু কাজ হয়েছে। বিএসইসির মূল আইন পরিবর্তন, ডিমিউচুলাইজেশন কার্যকর করা হয়েছে। এ ছাড়া সরকার নিরীক্ষা পদ্ধতির পরিবর্তন করেছে। ফিন্যান্সিয়াল আইন করছে। তিনি বলেন, সব দেশের শেয়ারবাজারেই উত্থান-পতন থাকে। তার পরও বাংলাদেশের শেয়ারবাজার এখন প্রস্তুত। শেয়ারবাজারের তালিকাভুক্ত কোম্পানির ৩০ শতাংশই বিনিয়োগের শতভাগ তুলে নিতে সক্ষম হয়েছে। চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের সাবেক সভাপতি এম কে এম মহিউদ্দিন বলেন, ‘ছোট ছোট বিনিয়োগ এলেও বড়রা আসছে না। তবে আমাদের পুঁজিবাজারের কাঠামো খুবই ভালো। আপনারা আসুন, দেখুন।’ এ ছাড়া তথ্যপ্রযুক্তি খাতের সম্ভাবনা নিয়ে বক্তব্য দেন বেসিসের সভাপতি শামীম আহসান ও মাইক্রোসফটের কান্ট্রি ডিরেক্টর সোনিয়া বশির কবির, পাট নিয়ে বলেন সাদাত জুট ইন্ডাস্ট্রির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহমুদুল হক, কৃষিজাত পণ্য নিয়ে বলেন সিমার্ক গ্রুপের চেয়ারম্যান ইকবাল আহমেদ প্রমুখ। সিঙ্গাপুরে বিভিন্ন দেশের ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, রেটিং এজেন্সির কার্যালয় আছে। সিঙ্গাপুরের ব্যবসায়ীরা ছাড়াও এসব প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা সম্মেলনে অংশ নেন। এ ধরনের আয়োজন প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সম্মেলনে যোগ দিতে আসা বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরী পারভেজ প্রথম আলোকে বলেন, সিঙ্গাপুরের ব্যবসায়ীরা পরিসংখ্যান দিয়েই সবকিছু বিচার করতে চান। সে জন্য তাঁদের দুয়ারে এসে বাংলাদেশকে তুলে ধরলে ইতিবাচক ফল পাওয়া যায়। তা ছাড়া ইমেজ গড়ারও একটি বিষয় আছে। ফলে এ ধরনের আয়োজন আরও বেশি বেশি করা দরকার। সম্মেলনে আসা জনসন জাং নামে সিঙ্গাপুরের এক ব্যবসায়ী বলেন, ‘বাংলাদেশ সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারলাম। বিনিয়োগের বিষয়ে এখনই কোনো চিন্তাভাবনা নেই। তবে ভবিষ্যতে বিনিয়োগ করার ইচ্ছা আছে।’

No comments:

Post a Comment