Tuesday, September 16, 2014

বিধি আর হয় না!:কালের কন্ঠ

আইন করার ১২ বছর পরও বিধি না হওয়ায় ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০১৩ সালের ২৭ মে মন্ত্রিসভা বৈঠকের এজেন্ডা ছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইনের সংশোধন। এই এজেন্ডার ওপর আলোচনা করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী জেনেছিলেন ২০০১ সালে আইন হলেও এর বিধি হয়নি। আইনটি ভূমি মন্ত্রণালয়ের হলেও প্রধানমন্ত্রী ভূমি, আইন এবং পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী-সচিবদের কাছে জানতে চেয়েছ
িলেন কেন বিধি হয়নি। ক্ষুব্ধ প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘আইন করা কঠিন, না বিধি করা?’ জানা যায়, এক যুগ আগে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই আইনটি করা হয়েছিল। কিন্তু বিধি না করায় তা কার্যকর করা যায়নি। ফলে পার্বত্য এলাকার ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির যে উদ্দেশ্য নিয়ে আইনটি করা হয়েছিল তা সফল হয়নি। সংসদ, মন্ত্রিসভা, আইন মন্ত্রণালয়, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়সহ আইন করার যে দীর্ঘ প্রক্রিয়া তার পুরোটাই ব্যর্থ হয়েছিল বিধির অভাবে আইনটি কার্যকর করতে না পারায়। এ অবস্থায় ২০১৩ সালের ২৭ মে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী-সচিবদের বিধি করার জন্য নতুন করে তিন মাস সময় দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘এর কোনো ব্যত্যয় চলবে না।’ তিন মাস গেল, বছর ঘুরে ১৫ মাস চলে গেলেও বিধি আলোর মুখ দেখেনি। এ রকম প্রায় প্রতিটি মন্ত্রণালয়ে এক বা একাধিক আইন রয়েছে যেগুলো বিধির অভাবে কার্যকর করা সম্ভব হচ্ছে না। সাম্প্রতিক সময়ে যে দুটি আইন প্রণয়ন করে সরকার প্রশংসা কুড়িয়েছে সেগুলো হলো নিরাপদ খাদ্য আইন ও শ্রম (সংশোধন) আইন। এ দুটি আইনও কার্যকর করা যাচ্ছে না বিধি না হওয়ায়। পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব নব বিক্রম কিশোর ত্রিপুরা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইনের বিধিমালা হয়নি। বিধিমালা প্রণয়নের দায়িত্ব ভূমি মন্ত্রণালয়ের। এ আইনটির মূল ব্যবহারকারী আমরা। তাই ভূমি মন্ত্রণালয় এ-সংক্রান্ত বিধি প্রণয়ন করলে আমাদের অবগত করত।’ টিআইবির তথ্য অনুযায়ী এমপিরা সংসদে যে সময় দেন তার মাত্র ১২ শতাংশ ব্যয় হয় আইন প্রণয়নের পেছনে। এই অল্প সময়ের চেষ্টায় যেসব আইন প্রণয়ন করা হয় তার বেশির ভাগই অকার্যকর থাকছে বিধির অভাবে। সাবেক মন্ত্রিপরিষদসচিব আলী ইমাম মজুমদার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সব আইনের জন্য বিধি দরকার হয় না। যেসব আইনের জন্য বিধি করতে হয় তা আইনেই বলা থাকে। সংশ্লিষ্ট বিষয় আইনে সংক্ষেপে বলা হয়। আর বিধিতে বিস্তৃতভাবে ব্যাখ্যা করা হয়। তাই আইন কার্যকর করার জন্য বিধি জরুরি। অনেক সময় বিধির অভাবে আইন কার্যকর করা যায় না।’ মানুষের জীবন ও স্বাস্থ্য সুরক্ষায় নিরাপদ খাদ্য প্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিত করতে ২০১৩ সালের ১০ অক্টোবর প্রণয়ন করা হয় নিরাপদ খাদ্য আইন। প্রচলিত একাধিক আইন বিলুপ্ত করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতামত নিয়ে নিরাপদ খাদ্য আইন প্রস্তুত করা হয়েছিল। সংসদে আইনটি পাস হওয়ার ১১ মাস পরও আইনের বিধিমালা হয়নি। এ কারণে কার্যকর করা যাচ্ছে না আইনটি। খাদ্য মন্ত্রণালয় একটি খসড়া বিধিমালা করে মতামত দেওয়ার জন্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছে। এ বিষয়ে খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিধিমালার খসড়া হয়েছে। চূড়ান্ত করে তা জারি করা হবে। আইনটি খুব বিস্তৃত বলে বিধিমালা প্রণয়ন করতে সময় লাগছে।’ জানা যায়, নিরাপদ খাদ্য আইনের বিধিমালার বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। সম্প্রতি উচ্চ আদালত দুই মাসের মধ্যে এ-সংক্রান্ত বিধিমালা করার নির্দেশ দিয়েছেন। যেসব প্রতিষ্ঠানে ন্যূনতম ১০০ জন শ্রমিক রয়েছে সেসব প্রতিষ্ঠানে বীমা চালু বাধ্যতামূলক করা হয়েছে সংশোধিত শ্রম আইনে। কোনো শ্রমিকের চাকরির মেয়াদ ১২ বছর পূর্ণ হলেই প্রতিবছরের জন্য এক মাসের সমান এবং ১২ বছরের বেশি হলে বছরপ্রতি দেড় মাসের মজুরির সমান গ্রাচ্যুইটি পাবেন। এ ধরনের বিধান রেখে গত বছরের ১৬ জুলাই সংসদে আইনটি পাস হয়। এ ছাড়া আইনে ট্রেড ইউনিয়ন, গ্র“প বীমাসহ শ্রমিকদের স্বার্থ, নিরাপত্তা ও অধিকার সমন্বত রেখে বাংলাদেশ শ্রম (সংশোধন) আইন অনুমোদিত হয়েছে। এর আগে ২০০৬ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় আইনটি পাস করা হলেও তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ ৫৬টি সংশোধনী দিয়েছিল। সেগুলো গ্রহণ না করেই আইনটি পাস হয়। সেই আইনটিতে শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার স্পষ্ট না থাকায় তা নিয়ে সোচ্চার ছিলেন ট্রেড ইউনিয়ন নেতারা। গত বছর সংশোধিত আইনে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা ব্যাংকে দেওয়ার বিধান রাখা হয়েছে। পুরনো আইন অনুযায়ী ট্রেড ইউনিয়নের নামের তালিকা মালিককে দিতে হতো। সংশোধিত আইনে তা মালিকপক্ষকে দিতে হবে না। সাত বছর পর আইনটি সংশোধন হলেও এর বিধিমালা না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন শ্রম আইন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা সংশোধিত শ্রম আইনের বিধিমালা নিয়ে কাজ করছি। এক সপ্তাহের মধ্যেই তা চূড়ান্ত করে প্রকাশ করা হবে।’ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বাংলাদেশের সব কিছুতেই সিন্ডিকেট। সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি ক্রেতারা। সরকারকেও জিম্মি করে এ সিন্ডিকেট। তারা কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে পণ্যের মূল্য বাড়িয়ে দেয়। সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য ঠেকাতেই প্রতিযোগিতা আইন করা হয়। এ আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগের ওপরই নির্ভর করছে ভোক্তাস্বার্থ সুরক্ষার বিষয়টি। বিশেষ করে ঈদ ঘিরে প্রতিবছর ভোগ্যপণ্যের চাহিদা বেশি থাকায় ওই সময় দাম বেড়ে যায় উল্লেখযোগ্য হারে। প্রতিযোগিতা আইন করার উদ্দেশ্য হচ্ছে, যারা কোনো পণ্য বা সেবা সরবরাহ করতে সক্ষম, তারা তা অবাধে সরবরাহ করবে। এতে সরবরাহকারী বা বিক্রেতাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা হবে। এ অবস্থায় ভোক্তা বা ক্রেতা ন্যায্য বা সঠিক দামে পণ্য অথবা সেবা কিনতে পারবে। এ কারণেই প্রতিযোগিতা আইন প্রণয়ন করা হয়। ভোক্তাস্বার্থ সুরক্ষায় প্রতিযোগিতা আইন পাস হয় ২০১২ সালে। দুই বছর অতিবাহিত হলেও বিধিমালা আলোর মুখ দেখেনি। বিধিমালা প্রণয়ন না হওয়ায় এ-সংক্রান্ত কমিশন গঠন করা যাচ্ছে না। ফলে ভোক্তারা এ আইনের সুফল থেকে বঞ্চিত থাকছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের এক কর্মকর্তা বলেন, বিধিমালা তৈরি করতে দেরি হওয়ার কারণ হচ্ছে বিষয়টি জটিল এবং বাংলাদেশে নতুন। সিন্ডিকেট বলা সহজ, চিহ্নিত করা কঠিন। একজন ব্যবসায়ী সব কিছু মেনে যখন ব্যবসা করেন তখন তাঁকে সিন্ডিকেটের মধ্যে ফেলা কঠিন কাজ। অনেকের ধারণা, ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষায় বিধিমালা আটকে রেখেছে প্রশাসন। আসলে তা নয়। এমনিতেই আইনের কিছু দুর্বলতা রয়েছে। বিধিমালা প্রণয়ন ও কমিশন গঠন হলেই সব কাজ শেষ হয়ে যাবে না। আইনেও কিছু সংশোধনী আনতে হবে। তিনি জানান, ভোক্তাস্বার্থ রক্ষায় এবং মানসম্পন্ন পণ্য সরবরাহের লক্ষ্যে আইন, কমিশন, অধিদপ্তর, দপ্তরের অভাব নেই। কিন্তু এর কোনোটিই সুষ্ঠুভাবে কাজ করতে পারছে না, যার সুযোগ নিচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। বাংলাদেশে বহু ভালো আইন থাকলেও সেগুলোর প্রয়োগ নেই বললেই চলে। এমন পরিস্থিতিতে প্রতিযোগিতা আইনটি কিভাবে কার্যকর হবে এবং কতটা হবে, তা নিয়ে সবার মধ্যে সংশয় রয়েছে। দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ আইন হচ্ছে মোবাইল কোর্ট আইন। এ আইনের বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কয়েকটি অপরাধ তাৎক্ষণিকভাবে আমলে নিয়ে দণ্ড দিতে পারেন। ২০০৭ সালে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথক হলে মোবাইল কোর্ট অধ্যাদেশ করা হয়। সেখানেই নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের এ ক্ষমতা দেওয়া হয়। পরে ২০০৯ সালে অধ্যাদেশটি আইনে পরিণত হয়। আইন প্রণয়নের ছয় বছর পরও এর বিধিমালা হয়নি। সম্প্রতি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের কাজের সুবিধার জন্য মোবাইল কোর্ট নির্দেশিকা প্রকাশ করেছে। কারণ মাঠপর্যায়ের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের তত্ত্বাবধানে কাজ করেন। কিন্তু মূল আইন যেহেতু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তাই বিধিমালা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কেই করতে হবে। গত ছয় বছরে এ-সংক্রান্ত বিধিমালা প্রণয়ন করেনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। মোবাইল কোর্টের বিধিমালা সম্পর্কে জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদসচিব মোশাররাফ হোসাইন ভূঁইঞা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারাও এ বিষয়ে কথা বলতে নারাজ। বাড়িভাড়া নেওয়ার বছরপূর্তিতে ভাড়া বৃদ্ধির জটিলতা ভোগ করছেন না এমন ভাড়াটিয়া খুঁজে পাওয়া যাবে না। ভাড়াটিয়ার আয় বাড়ুক বা না বাড়ুক, বাড়িভাড়া বাড়বেই। বছর শেষে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ হারে বাড়িভাড়া বাড়ে। ভাড়াটিয়াদের এ অসহনীয় অবস্থা থেকে মুক্তি দিতে ১৯৯১ সালে সংসদে আইন পাস করা হলেও আজও বিধিমালা হয়নি। আর বিধিমালার অভাবে আইনটিও কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। তামাক নিয়ন্ত্রণে ধূমপান ও তামাকজাতদ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন করা হয় ২০০৫ সালে। পরের বছর আইনটির একটি বিধিমালাও করা হয়। কিন্তু ২০১৩ সালের ২৯ এপ্রিল আইনটির ব্যাপক সংশোধনী আনা হয়। এক বছর পেরিয়ে গেলেও বিধিমালা সংশোধন করা হয়নি। এ কারণে কার্যকর করা যাচ্ছে না তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনটি। তামাক নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কর্মরত ১৩টি সংগঠন গত ২০ আগস্ট প্রেসক্লাবের সামনে অবস্থান কর্মসূচির মাধ্যমে দ্রুত এ বিধিমালা প্রণয়নের দাবি জানান। এ ছাড়া ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, উপজেলা আইন, মাতা-পিতার ভরণ-পোষণ আইনসহ অনেক আইন রয়েছে, যেগুলো বিধিমালা না থাকায় কার্যকর করা যাচ্ছে না। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আইন হবে অথচ বিধির জন্য তা কার্যকর করা যাবে না- এটা দুর্ভাগ্যজনক। সংসদ বসে জনগণের করের টাকায়। সংসদের সময় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেই সংসদে যদি আইন প্রণয়ন হয় তা কার্যকর করতেই হবে।’ কেন তা কার্যকর হচ্ছে না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সরকারি কর্মকর্তারা বদলির চাকরি করেন। আজ আছেন তো কাল নেই। দেখা গেল কোনো কর্মকর্তা বিধি তৈরির কাজে হাত দিয়েছেন, কাজ শেষ না হওয়ার আগেই তাঁকে বদলি করে দেওয়া হয়। এখানে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বা সচিবের যে দায়িত্ব পালন করার কথা তাঁরা তা করেন না। এসব কারণেই বিধি না করার প্রবণতা বাড়ছে।’

No comments:

Post a Comment